কিংবদন্তী ‘Surgeon’s judge’ এর নীরব প্রস্থান

May 13, 2020,

সায়েক আহমদ॥ সিলেট নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের ছাত্র মুদহাম্মাতান মাহদি জানালো একটি হৃদয়বিদারক সংবাদ। তাদের সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে কমরত এবং সার্জারীর ইতিহাসে জীবন্ত কিংবদন্তী অধ্যাপক ডা. মীর মাহবুবুল আলম আর নেই। মাহদির আর্তনাদ আমাকে জানিয়ে দিল মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন দেবতুল্য একজন চিকিৎসক। সার্জনদের মধ্যে ‘Surgeon’s judge’ নামে পরিচিত এ জীবন্ত কিংবদন্তীর বিদায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসাজগতের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেল।

গতকাল ফেসবুকে একের পর এক স্ট্যাটাসে দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের আহাজারি এটাই প্রমাণ করছে বাংলাদেশ হারিয়েছে জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। যিনি ছিলেন সারা দেশের ২-৩ জন সার্জনের মধ্যে তিনি। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক ডা. মীর মাহবুবুল ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের গাইনি এবং মেডিসিন বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সাইন্সের ডিন হিসেবেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মেডিক্যালের যেকোন সাবজেক্টে তাঁর দক্ষতা এতই ব্যাপক ছিল যে দেশ বিদেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাও তাকে এক বাক্যে কিংবদন্তী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন।

করোনার সংক্রমনের পিক টাইমে তিনি অবশ্য করোনায় আক্রান্ত হননি। যদিও উপসর্গগুলো কভিড-১৯ এর সাথে হুবহু মিলে গিয়েছিল। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, কিছু উপসর্গ থাকলেও ডা. মীর মাহবুবুল আলম করোনা আক্রান্ত ছিলেন না। চারবার তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, প্রতিবারই ফলাফল নেগেটিভ এসেছে।

চিকিৎসকরা জানান, ডা. মীর মাহবুবুল আলম দীর্ঘদিন ধরেই ডায়বেটিস ও লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ৬ মে বুধবার প্রথমে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর সেখান থেকে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার নমুনা সংগ্রহ করে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হলেও রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সেই রাতেই তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। টানা ছয় দিন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে থাকার পর গতকাল ১২ মে, মঙ্গলবার ভোররাত ৩টা ২৫ মিনিটে সার্জারীর ইতিহাসে জীবন্ত কিংবদন্তীতুল্য এ মহামানব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি নিশ্চিত করেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এ্যানেসথেশিয়া বিভাগের প্রধান ডা. মাইনুল ইসলাম ডালিম। মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে পারিবারিকভাবে সিলেট নগরীর মানিক পীর (রহ.) কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

অধ্যাপক ডা: মীর মাহবুবুল আলম ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী এবং বহুবিধ গুণের অধিকারী। তাঁর জীবনকাহিনী অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। তিনি বিবিএ করেছেন, আবার এমবিএও করেছেন। আরও অবাক করা ব্যাপার হল তিনি এলএলবি করেছেন, আবার এমএলবিও করেছেন। এ যেন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতই আরেক মেধাবী মহাপুরুষ। এখানেই শেষ নয়, তিনি গবেষণা করেছেন ভূমিকম্প নিয়ে। সিলেট ভুমিকম্প বিষয়ক গবেষণা কমিটির সভাপতির দায়িত্বও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বায়োস্ট্যাটিস্টিকস এর মত মারাত্মক কঠিন বিষয়ের উপরেও গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কেও ছিল তাঁর অগাধ ধারনা। তিনি রোটারী আন্দোলনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

এবার আসা যাক মেডিক্যাল জগতের কাহিনীতে। তিনি সার্জারীতে একাধারে করেছেন কয়েকটি উচ্চতর ডিগ্রী। হাতে গোনা যে ২/৩ জন প্রফেসর এফসিপিএস পরীক্ষা নিতে বিদেশ যান তিনি তাদের মধ্যেও একজন । সার্জারির কিংবদীতুল্য প্রফেসর মীর মাহবুবুল আলম সার্জনদের মধ্যে ‘Surgeon’s judge’ নামে পরিচিত ছিলেন। সারাদেশের মেডিক্যালের ইন্টার্ণশীপের লগবুক তিনিই তৈরী করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারালো একজন চিকিৎসাজগতের একজন জীবন্ত কিংবদন্তীকে। মুদহাম্মাতান মাহদির মত মেডিক্যালের শিক্ষার্থীর পিতা হারানোর মত কষ্টের নীরব কান্নায় বুক ভাসাচ্ছে। মাহদি বলল, ‘আমাদের মত শিক্ষার্থীদের জন্য স্যারের বিশাল প্রয়োজনীয়তা ছিল। আমরা আশায় বুক বাঁধছিলাম স্যারের কাছ থেকে চিকিৎসাজগতের অসাধারণ সব শিক্ষা অর্জনের জন্য। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে আমাদের সে আশা আর জীবনেও পূর্ণ হবে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন স্যারকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন এই দোয়া করি।’

সার্জারীর ইতিহাসে জীবন্ত কিংবদন্তী অধ্যাপক ডা. মীর মাহবুবুল আলম এর বয়স ছিল ৭২ বছর। এ বয়সে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারতো এ কথা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু করোনা মহামারীর ভয়াবহ সময়ে তাঁর নীরব প্রস্থান কেউই মেনে নিতে পারছে না। তাঁর মৃত্যু এ মেসেজ দিয়ে গেল, করোনা পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য জটিল রোগীদের জীবনের আশংকা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অধ্যাপক ডা. মীর মাহবুবুল আলম এর ডায়বেটিস ছিল, লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। কাশি ও শ্বাসকষ্ট ছিল। কাজেই করোনা কি না তা পরীক্ষা করার দরকার ছিল। ৪ বার পরীক্ষা করা হয়েছিল। ৪ বারই নেগেটিভ রেজাল্ট এসেছে। কাজেই নিঃসন্দেহে বলা তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় তিনি যে রোগগুলোতে ভূগছিলেন, সেগুলো তো কোন ভয়াবহ রোগ নয়। সময়োপযোগী চিকিৎসা গৃহীত হলে হয়তো এভাবে তাঁকে বিদায় জানাতে হতো না। হয়তো তিনি নিজেও ভেবেছিলেন করোনা মহামারীর এ সময়ে এসব অসুখ এমন ভয়াবহ কিছুই নয়। বাসায় থাকলেই সেরে যাবে। কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে যেতেই হল। হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। আইসিইউতে থাকতে হল। অতঃপর চিরবিদায় নিতে হল। এ ট্র্যাজেডিটুকু স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে চাইলেও মন তো মানে না।

করোনা মহামারীর ভয়বহতার এ সময়ে একের পর এক চলে যাচ্ছেন চিকিৎসা জগতের নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলো। যারা আমাদের প্রাণ রক্ষায় সর্বদা নিয়োজিত তাদেরকে রক্ষা করবে কে? কে দিতে পারবে এর উত্তর।

[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক। ০১৭১২৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com