কুলাউড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ সেতু রেখে এক পরিবারের সুবিধার্থে নির্মাণ হচ্ছে সেতু
মাহফুজ শাকিল : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার লক্ষীপুর-হাসিমপুর সড়কে ফানাই নদীর ওপর প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় আগে একটি পাকা সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে ওই সেতুটি এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সেই সেতুটি নির্মাণ না করে স্থানীয় এলাকায় এক পরিবারের লোকদের চলাচলের সুবিধার্থে নতুন করে একটি সেতু নির্মাণ কাজ চলমান আছে। এ নিয়ে স্থানীয় ১০-১৫টি গ্রামের মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এদিকে গত অক্টোবর মাসে ওই ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে দুর্ঘটনায় স্থানীয় হাসিমপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজী আব্দুল্লাহ (৬০) ও রাঙ্গিছড়া বাজারের ব্যবসায়ী হাসিম মহাজন (৫৮) নামে একই পরিবারের দুই ভাই মারা যান। সেতু নির্মাণ না হওয়ায় এখন মৃত্যু আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের।
এদিকে নতুন সেতু নির্মাণের দাবিতে গত ৩১ অক্টোবর কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন ও কর্মধা ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ স্বাক্ষরিত একটি লিখিত আবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে দেওয়া হয়েছে।
লিখিত আবেদন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষীপুর-হাসিমপুর সড়কে ফানাই নদীর ওপর তিনবছর ধরে একটি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয় লোকজন চলাচল করছেন। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সময় ২০১৮ সালে কুলাউড়া আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের মনোনীত মানুষ দিয়ে কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য নরসামলু রাজভর ওরফে ছমি বাবুর বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় চলাচলের জন্য স্থানীয় দেওছড়ার ওপর প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের মাধ্যমে নতুন সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রকল্প অনুমোদন হলেও কাজ শুরু হয়নি। পরবর্তীতে ছমি বাবুর ছেলে কর্মধা ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক গোপাল রাজভর আওয়ামীলীগ সরকারের সময় কুলাউড়া আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের সাথে যোগাযোগ করলে তাঁর প্রভাবে কাজটি শুরু করতে নানা তৎপরতা চালান। কারণ শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের সাথে গোপাল রাজভরের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। পরে চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে সেতুটির টেন্ডার হলে ছমি বাবুর বাড়ির সামনে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ায় স্থানীয় এলাকার লোকজন ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। যদি ওই সেতুর কাজ বন্ধ করে লক্ষীপুর-হাসিমপুর সড়কে ফানাই নদীর ওপর নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ সেতু নির্মাণ না করা হয় তাহলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী দেন স্থানীয়রা।
সূত্র আরো জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ফানাই নদী খননের সময় অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামলে ওই সেতুর মধ্যবর্তী স্থান দেবে যায়। একই সময় সেতুর পূর্ব পাশের বাঁধে রাঙ্গিছড়া-লক্ষ্মীপুর-গুতগুতি সড়কের প্রায় ২০০ ফুট জায়গা ধসে পড়ে। গত বন্যায়ও ফের সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়। এ অবস্থায় সেতুসহ ওই সড়ক দিয়ে মরণঝুঁকি নিয়ে যানসহ লোকজন চলাচল করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে এলজিইডি’র উদ্যোগে প্রায় ২৪ মিটার দীর্ঘ পাকা ওই সেতুটি নির্মাণ করা হয়। লক্ষ্মীপুর-হাসিমপুর সড়কে ফানাই নদীর ওপর ওই সেতু দিয়ে কর্মধা ইউনিয়নের হাসিমপুর, বেড়ী, গুতুমপুর, রাঙ্গিছড়া, কুলাউড়া সদর ইউনিয়নের লক্ষীপুর, প্রতাবী, গুতগুতি, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের পুরশাই, ভাটগাঁও ও দেওগাঁও, এবং রাউৎগাঁও ইউনিয়নের নর্তন, কবিরাজী ও পালগ্রামের অন্তত ৪০ হাজার লোকজন প্রতিদিন বিভিন্ন কাজে কর্মধা ইউনিয়নের রাঙ্গিছড়া বাজারে চলাচল করেন। এছাড়া লক্ষীপুর, গুতগুতি, প্রতাবী এলাকার শিক্ষার্থীরা সেতুর ওইপারে কর্মধা ইউনিয়নের বাবনিয়া হাসিমপুর নিজামিয়া দাখিল মাদরাসায় গিয়ে পড়ালেখা করে। অন্যদিকে বাবনিয়া, গুতুমপুর, বেড়ীসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার শিক্ষার্থীরা সেতুর এপারে লক্ষীপুর মিশন ও অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ালেখা করে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেবে যাওয়া সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় লোকজন হাঁটার সময় সতর্কভাবে সেতু পারাপার হচ্ছেন। সীমিত পরিসরে ওই সড়ক দিয়ে একইভাবে ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ছোট যানও চলাচল করছে। যেকোনো মুহূর্তে সেতুটি ভেঙে নদীতে পড়ে যাবে এতে বন্ধ হয়ে যাবে সবধরনের চলাচল।
কর্মধা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল আহমদ, লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক আলাউদ্দিন কবির, সমাজকর্মী রাহেল আহমদ, জুবের হান্নান, বাবুল আহমদসহ অন্তঃত ২৫-৩০ জন মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফানাই নদীর ওপর ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটি নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার আবেদন করেছি। এলজিইডি’র উর্দ্ধতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনেকবার সেতুটি পরিদর্শন করে দ্রুত সেতুটি নির্মাণের আশ^াস দিলেও সেতুটি নির্মাণে কোন কার্যত উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এদিকে জনগুরুত্বপূর্ণ সেতুটি রেখে রাঙ্গিছড়া এলাকায় ছমি বাবুর পরিবারের ১৫-২০ জন লোক চলাচলের সুবিধার্থে নতুন করে সেতু নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে অথচ এলাকার লোকজন ওই বিষয়ে কিছুই জানেন না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, সরেজমিনে সেতু নির্মাণের সম্ভাবতা যাচাই করে মানুষের উপকারে আসে এমন সেতু নির্মাণ করা।
স্থানীয় বাসিন্দা প্রবাসী আতিকুল রহমান বলেন, ওই ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে চলাচলের সময় আমার পিতা ও চাচা আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরে হাসপাতালে নেয়ার পর তারা মৃত্যুবরণ করেন। অচিরেই মানুষের মৃত্যুঝুঁকির কথা চিন্তা করে সেতুটি নির্মাণে যেন উদ্যোগ নেয়া হয়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী বলেন, তৎকালীন এমপি সুলতান মনসুর মহোদয়ের সময়কালে প্রথমে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে গার্ডার সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে এখন ১ কোটি টাকার কাজ হবেনা। বর্তমানে ওই প্রস্তাবটি সংশোধন করে ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে বক্স কালভার্ট করার জন্য উর্দ্ধতন দপ্তরে চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে।
এলজিইডি’র মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহমেদ আব্দুল্লাহ জানান, তিনি সরেজমিনে ওই ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ও সড়কটি পরিদর্শন করে সেতু নির্মাণের ব্যাপারে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে সেতু ও সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত স্থান মেরামত করে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। সরেজমিনে পরিদর্শন করে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্তব্য করুন