কুলাউড়া ও রাজনগর ফিরে দেখা ২০১৭: হত্যা-গণধর্ষণ বন্যা আর হাতির আক্রমনে জর্জরিত ছিলো মানুষ
বিশেষ প্রতিনিধি॥ কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলায় ২০১৭ বছর ছিলো আলোচনা মুখর। এই দুটি উপজেলায় উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে হত্যা ও গণধর্ষণের ঘটনা। সেই সাথে এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও কাউয়া দিঘীর হাওর তীরের এই দুটি উপজেলার মানুষকে ৮মাস জুড়ে ভয়াল বন্যার সাথে লড়াই করতে হয়েছে। সেই সাথে খরস্রোতা মনু নদীর দু’দফা ভাঙণে লন্ডভন্ড ছিলো উপজেলার গ্রামীণ জনপদের রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর। পোষা হাতির আক্রমনেও ৩ জনের মৃত্যু ছিলো আলোচনার অন্যতম বিষয়।
২০১৭ সালের শুরুতে ২৬ জানুয়ারি রাজনগর উপজেলার ঘড়গাঁও গ্রামে চাকুরিচ্যুত আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য শফিক মিয়ার এলোপাতাড়ি দায়ের কুপে একই বাড়ির শামছুল ইসলামের স্ত্রী সায়রা বেগম (৩০) ও আব্দুল হান্নানের স্ত্রী নজরুন বেগম (৪৫) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া ৩ নারী গুরুতর আহত হন। কুলাউড়া উপজেলার সদর ই্উনিয়নের গুতগুতি গ্রামের পানচাষি রিমন মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয় ৬ ফেব্রুয়ারি। নিহত রিমনের মাথায় ও শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিলো। এঘটনায় রিমনের বাবা এলাইছ মিয়া কুলাউড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এদিকে উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের তেলিবিল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বাইরে বেরুলে মুখে গামছা দিয়ে বেঁধে অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়। কুলাউড়া পৌর এলাকার দতর মুড়ি গ্রামের এক গৃহবধুকে সৌদি আরবে নিয়ে ঘরে আটকে গণধর্ষণ করা হতো। ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই গৃহবধু দেশে ফিরে ৮ মার্চ এই ঘটনার জন্য জয়চন্ডি ইউনিয়নের কামারকান্দি গ্রামের শাহজাহান মিয়াকে অভিযুক্ত করে কুলাউড়া থানায় অভিযোগ দেন।
রাজনগর উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের কাছাড়ী গ্রামের হারুন মিয়ার মেয়ে তারাপাশা উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড করেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী শাম্মী আখতার (১৮) কে ১৮ মে রাতের আধারে ৪ প্রেমিক মিলে গণধর্ষণের হত্যা করে। এঘটনায় শাম্মীর বাবা ৪ জনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করেন।
কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের পাবই গ্রামের মৃত মছলু মিয়ার মেয়ে রায়না বেগমের স্বামী সালাউদ্দিন তার স্ত্রী সন্তানকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। এতে ক্ষুব্ধ সালাউদ্দিন তার শ্যালিকা মনি বেগমকে ছোরাদিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এসময় তার স্ত্রী রায়না বেগম ও তাদের ৬ মাসের শিশু সন্তান মাছুম আহত হয়। পরে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। এলাকাবাসী ঘাতক সালাউদ্দিনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। ২৬ মে কুলাউড়া হাসপাতালে রুমি বেগম (২০) নামক এক তরুণীর লাশ ফেলে পালিয়ে যায় ২ যুবক। নিহত রুমি বেগম ও তার পরিবারের লোকজন কুলাউড়া পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের পরিনগর এলাকায় বসবাস করলেও তাদের মুল বাড়ি হবিগঞ্জ পৌরসভার উমেদনগর গ্রামে। রাজনগর উপজেলার মনসুর নগর ইউনিয়নের তাহারলামু গ্রামের সৌদিআরব প্রবাসী সুরুক মিয়ার স্ত্রী বাবলী আখতার (২৬)কে শ^শুড় বাড়ির লোকজন ১৬ জুন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এঘটনায় নিহত বাবলী আখতারের দুলাভাই হারুন আহমদ বাদী হয়েরাজনগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এঘটনায় নিহত বাবলী আখতারের শাশ^ড়ি মাখন বিবি, জা রুমা বেগম, ননদ মিলন বেগম, জা’র পরকিয়া প্রেমিক তুহিন মিয়া এবং বাড়ির কেয়ারটেকার লেছু মিয়াকে আটক করে পুলিশ।
কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুর চা বাগানে ৫ জুলাই চিকিৎসার নামে এক চা শ্রমিকের কিশোরি কন্যাকে ধর্ষণ করে কবিরাজ বেশি প্রতারক ও তার সহযোগি।
উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব কর্মধা গ্রামের ছেলের লাঠির আঘাতে আহত বাবা ইসমাইল আলী (৬৫) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ সেপ্টেম্বর সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের শশুড় বাড়িতে ২৩ অক্টোবর রাতে ঘুমন্ত স্ত্রী নাছিমা বেগম (৩০) কে গলাকেটে হত্যা করে তার স্বামী রফিক মিয়া। এসময় রফিক মিয়ার ছুরিকাঘাতে শাশুড়ি সোনাজান বিবি (৫৫) শ্যালিকা নাজমা বেগম (১২) আহত হয়। ঘাতক রফিক মিয়াকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ও পুলিশ আটক করতে সক্ষম হয়।
উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের পূশাইনগর বাজারে ৪ নভেম্বর শনিবার রাতে ছোট ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে বড় ভাই (চাচাতো ভাই) কয়ছর মিয়া (২৫) এর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২৮ নভেম্বর রাতে উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুর চা বাগানের স্মরণ বাউরী (৪৫)কে তার শ্যালক শশ ধন বাউরী দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ১০ ডিসেম্বর চাতলাপুর চা বাগান থেকে তেলিবিল উচ্চ বিদ্যালয়ে কান্তি হৃদন (১৫) এর লাশ উদ্ধার করা হয়।
রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে ৭ ডিসেম্বর জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে মোকামবাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে সৎ ভাইদের হামলায় রমজান চৌধুরী নামক মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীর মৃত্যু হয়।
কুলাউড়া উপজেলার ৩ সেপ্টেম্বর রাতে পুটিছড়া বনবিটের এলাপুর নামক স্থানে পথচারিদের উপর হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই মঙ্গল খাড়িয়া (৪৫) নামক এক ব্যক্তি মারা যান। এর ২০ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর মেরিনা চা বাগানের ৮নং সেকশনে ওই রসগোল্লার আক্রমনে কর্মধা ইউনিয়নের মনছড়ার গ্রামের গণি মিয়া (৫০) নামক একজন মাহুত মারা যান। এছাড়া টিলাগাঁও ইউনিয়নের বাংলারবাজার নামক স্থানে ০৫ নভেম্বর রোববার বিকেল ৫টায় একটি পোষা হাতির আক্রমনে ইউছুফ আলী ওরফে খাজা (৭০) নামক এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। কুলাউড়া পৌরসভার দক্ষিণ জয়পাশা এলাকার বাসিন্দা ইয়াবাসেবী পিতা খায়রুল আলমের নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৭ নভেম্বর মাত্র ৪০ দিন বয়সী শিশু কন্যা রাশেদা আক্তার রাইদার মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহত শিশু কন্যার মা মুসলিমা বেগম এই অভিযোগ করেন।
এছাড়া রাজনগর উপজেলায় ১৪ জানুয়ারি রাজনগর চা বাগান, ২৬ মে মুন্সিবাজার ইউনিয়নের সুনাটিকি গ্রামের পশ্চিম পাশের সিঙ্গুয়ার বিল ও ১০ জুন রাজনগর বালাগঞ্জ সড়কের ভুরবুরি ব্রিজের দক্ষিণ পাশের খাল থেকে পৃথক ৩ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারি বর্ষণে অকাল বন্যা দেখা দেয় এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে। এতে হাওর ও হাওর তীরের কুলাউড়াসহ ৫ উপজেলার শতভাগ বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাছাড়া ধান পচে মাছ ও পরবর্তীতে হাঁস মারা যায়। ৪ জুন ভারি বর্ষণের ফলে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলায় খরস্রোতা মনু নদীর ৭টি স্থানে বিশাল ভাঙন দেখা দেয়। অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখে ২য় দফায় মনু নদীর ৪টি স্থানে নতুন করে ভাঙন দেখা দেয়।
এছাড়া কাউদিঘি হাওর তীরের রাজনগর উপজেলার বন্যাকবলিত আমিরপুর গ্রামে জ¦রে আক্রান্ত হয়ে ৩ ও ৬ জুলাই জ¦রে আক্রান্ত হয়ে তামান্না আক্তার (৯) ও রুমা বেগম (১৩) নামক ২ কিশোরির মৃত্যু হয়। এছাড়া গ্রামের শতাধিক নারী পুরুষ ও শিশু আক্রান্ত হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
মন্তব্য করুন