কোথাও নেই সাম্প্রদায়িক হামলা : মৌলভীবাজারেই গুজবের ভয়ভীতি তোলপাড়
ইমাদ উদ দীন॥ নানা গুজব আর অপপ্রচারেই বিভ্রান্তি। প্রকৃত দৃশ্যপট ভিন্ন। ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠনের অনেক নেতাদের প্রতি ক্ষমতার অপপ্রয়োগের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা,ভাংচুর ও লুট হলেও ধর্মীয় চিন্তায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কোনো ঘটনাই ঘটনি। হয়নি কোনো সংখ্যালঘুর বাসাবাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা,ভাংচুর কিংবা লুট। ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি কোনো মন্দির বা ধর্মীয় উপাসনালয়।
কিন্তু ঘটনা ভিন্ন খাতে নিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে একটি চক্র ফাঁয়দা নিতে মরিয়া। এতে চরমভাবে মর্মাহত হচ্ছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় কাজ করা নানা শ্রেণী ও পেশার লোকজন। এমনটি বলছেন জেলার সচেতন নাগরীক সমাজ। তারা ক্ষোভের সাথে জানান দলীয় পদবী,আগেকার ক্ষমতার দাপট ও নিজেদের নানা অপকর্মের দায় আড়াল করে তা সাম্প্রদায়িক হামলা বলে চালিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আবেগ পুঁজি করে প্রতিশোধ পরায়ণ হতে চাইছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী আওয়ামী লীগের পদবীধারী গুটি কয়েক নেতা।
জানা যায় দেশের সাম্প্রতিক চলমান অবস্থায় ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনের ঐতিহ্য বিন্দুমাত্র বিনষ্ট হয়নি প্রবাসী ও পর্যটন অধ্যুষিত মৌলভীবাজারে। সম্প্রীতির এই বন্ধন অটুট রাখতে নানা পেশার মুসলিম সম্প্রদায় ও মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক ঐক্য হয়ে সংখ্যালঘুদের বাসাবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় পাহারা দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশের চলমান পরিস্থিতে মৌলভীবাজার জেলার ৭টি উপজেলায় কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়নি।
৫ আগষ্ট বিকেল থেকে পরদিন রাত পর্যন্ত জেলা শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যে সকল অনাকাঙ্খিত হামলা ভাংচুরের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে তা কেবল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতাদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এই ধারাবাহিকথায় মুসলীম নেতাদের পাশাপাশি হাতে গুনা কয়েকজন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটির দলীয় পদবীধারী হিন্দু ধর্মাবলম্বী আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা বাসাবাড়িতে হামলা ও ভাংচুর চালিয়েছিলো বিক্ষুব্দ জনতা ও দুষ্কৃতিকারীরা। জেলা পূঁজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দরা জানান জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা ছাড়া অন্যান্য উপজেলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেকেই হামলা ও ভাংচুরের শিকার হয়েছেন। তাদের দেওয়া তালিকানুযায়ী জেলার সবকটি উপজেলার প্রতিনিধিরা স্থানীয় বাসিন্দা,রাজনীতিবীদ,সমাজকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে তথ্য নিয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্য মতে ও সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলে জানা যায় মৌলভীবাজার শহরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অজয় সেনের (মুদি দোকান) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান,জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি সমেশ দাশ যিশুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ম্যানেজার স্টল,জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক আড্ডাস্থল পারুল মেডিকেল ফার্মেসী,কামালপুর ইউনিয়নের সক্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা অনুকুল দেবের কামালপুর বাজার ফামের্সী হামলা ও ভাংচুর করে দূর্বৃত্তরা। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এমন চিন্তায় কোনো হামলা হয়নি। তারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিরোধে দলীয় পরিচয়ে সর্বত্রই সক্রিয় ভূমিকা রাখেন বলেই তাদের আচরণের উপর বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ ঘটেছে বলে সবাই তথ্য দেন।
জুড়ীতে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মনি কিশোর রায় চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ-সম্পাদক রিংকু রঞ্জন দাস, পশ্চিমজুড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান শ্রীকান্ত দাস, গোয়ালবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি রাজ কুমার বাড়ৈ, উপজেলা যুবলীগের সদস্য নির্মল কান্দি দাস নিলু, গোয়ালবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সদস্য অলোক রঞ্জন দাস। দলীয় পরিচয়ে অতিমাত্রায় দাপটের কারণে তাদের অনেকেরই বাড়ি,মোটরসাইকেল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষুব্দ জনতা ও র্দূবৃত্তরা হামলা ও ভাংচুর চালায় বলে জানা যায়। এছাড়া ওই উপজেলায় মনি মুক্তা হোটেল ভাংচুর হয়। কারণ হিসেবে তথ্য মিলে ওই হোটেলের ম্যানেজার তাপস ৩ আগস্ট অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছিলেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বড়লেখায় রতুলীবাজারের ফল ব্যবসায়ী দীপক দাস পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। তিনি আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। দীপক ফাঁসির রায় ও বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের দমন নিপিড়নের সময় ফেসবুকে লাইভ করে উল্লাস করতেন। তার এমন আচরণে ভাই নিপেশও হামলা ও ভাংচুরের শিকার হন। তবে স্থানীয় অনেকেই তাদেরকে আর্থিক সহায়তা করেছেন ও করছেন। দক্ষিণভাগ বাজারের ফল ব্যবসায়ী সাধন পাল ঐ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ছিলেন। কুলাউড়ায় উপজেলা যুবলীগের সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ও ব্রাহ্মণবাজার ইউপি যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ ইন্দ্রজিৎ ভট্রাচার্য্য,ব্রাহ্মণবাজার ইউপি আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি সুর্দশন চৌধুরী, ইউপি আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শান্ত শেখর ভট্রাচার্য্য, সমু দাসের পুত্র বিপ্লব দাস সাবেক সদস্য উপজেলা ছাত্রলীগ ও বর্তমানে ইউপি যুবলীগর সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। আর গাজিপুর চা বাগানের বাবুল গোলায়ালা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পঞ্চায়েত সভাপতি তারা সকলে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী দমন নিপিড়নে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন।
রাজনগরে পাঁচগাঁও এলাকায় ভাংচুরকৃত লোকনাথ স্টোরের মালিক মহেশ দাস তিনি আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। এঘটনায় অনেক মুসলামান প্রতিবাদ জানান এনকি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও গুলিতে নিহত হন। হীরা সেন তিনি উপজেলা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তার গৃহপালিত গরু লুট হয়নি চুরি হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে নেপাল দত্তের গরু পূর্ব বিরোধের কারণে এই সময়ে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়।
জেলা পূঁজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মহিম দে মধু জানান জেলা জুড়ে কমলগঞ্জ উপজেলা ছাড়া অন্য ৬টি উপজেলায় হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের তালিকা এখনো হাতে আসেনি তবে পরিস্থিতি এখন শান্ত। তার দেওয়া উপরোক্ত তালিকা যাচাই বাচাঁই করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
জেলা পূঁজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশু রঞ্জন দাস জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় বলেন বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া জেলায় বড় ধরনের কিছু হয়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় সকলের ভূমিকায় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আগামীতেও শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সকলের সার্বিক সহযোগিতা চান।
এ বিষয়ে জেলা জামায়াতের আমীর ইঞ্জিনিয়ার মো: শাহেদ আলী ও সেক্রেটারী প্রিন্সিপাল মো: ইয়ামীর আলী বলেন আমরা জেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়ে মাঠে কাজ করছি। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাই বোনেরা যাতে কোনো ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে না থাকেন এবিষয়ে তাদের কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ সাথে মতবিনিয় অব্যাহ রয়েছে। কেউ গুজব ছড়িয়ে যাতে আমাদের মূল্যবান সম্প্রীতির ঐতিহ্য নষ্ট না করে সে দিকেও সকলের সর্তক দৃষ্টি ও উদার আন্তরিকতার আহবান জানান।
জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও সাবেক এম নাসের রহমান বলেন দলের নেতাকর্মীদের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে যাতে দূর্বৃত্তরা কোনো ধরনের অঘটন ঘটিয়ে ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সে বিষয়ে সর্তক থাকতে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সর্বোচ্ছ নিরাপত্তা ও সহযোগিতা দিতে দলীয় নেতাকর্মীরা মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষায় সচেষ্ঠ রয়েছি।
মন্তব্য করুন