কোভিড-১৯ ও শিক্ষা বিভাগ

May 6, 2020,

সায়েক আহমদ॥ সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস মহামারী রূপধারণ করায় বাংলাদেশেও এর ঢেউ ভয়াবহভাবে আঘাত করেছে। বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবকবৃন্দ, শিক্ষার্থীগণ হতভম্ব। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রশাসন ও সংস্থাপন শাখা থেকে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। উক্ত ছুটিকালীন সময়ে জনসাধারণ ও সকল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশমালা কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। আরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে সাধারণ ছুটিকালীন সময়ে কোন অবস্থাতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলা রাখা যাবে না। আরেকটি প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে শিক্ষকণ্ডলীকে প্রশাসনের উদ্যোগে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় গৃহীত সকল কর্মসূচিতে সহায়তা করতে হবে। এছাড়া সারাদেশে কৃষকদেরকে সাধ্যমত সহযোগিতার করার জন্যও শিক্ষকণ্ডলীকে অনুরোধ করা হয়েছে।
সারাদেশের শিক্ষকগণের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন শিক্ষকগণ সেভাবেই চলছেন। তারা সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয়ের অনুরোধে সারাদেশে শিক্ষকবৃন্দ ধান কাটায় সহযোগিতাসহ কৃষকদের পাশেও এসে দাঁড়িয়েছেন। একদিনের বেতন কর্তন করে করোনা মোকাবেলা তহবিলে অর্থ প্রদানও করেছেন। এছাড়াও শিক্ষকদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা নিজেরাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সারাদেশে অসহায় ও গরীব প্রতিবেশিদেরকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করে সরকারকে সহযোগিতা করছেন। প্রতিটি কর্মসূচিতে শিক্ষকবৃন্দকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেই দেখা গেছে।
সংসদ টিভিতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশের স্বনামধন্য শিক্ষকবৃন্দের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস রেকর্ডিং করে তা প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া একটি দুঃসাধ্য কাজ। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে এ বিশাল উদ্যোগ গ্রহণ করে সাফল্যের সাথে তা বাস্তবায়নও করেছেন। এছাড়া টিভিতে লাইভ ক্লাসসহ শিক্ষার্থীবৃন্দের পড়াশোনা সংক্রান্ত সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকদের কাজ শুধু শিক্ষাদান করাই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মত কঠিন দায়িত্বও শিক্ষকবৃন্দ আন্তরিকতার সাথে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বৈশ্বিক এ মহামারীর কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হচ্ছে স্বেচ্ছায় গৃহে অন্তরীণ থেকে ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সহায়তা করা। দেশের সিংহভাগ জনগণ তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলায় বাংলাদেশে মহামারীটি আশংকাজনকভাবে এখনো বিস্তারলাভ করেনি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিশাল সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠি অধ্যূষিত দেশে তা কল্পনাও করা যায় না। তারপরও জনগণের সচেতনতায় বাংলাদেশ সে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। সারাবিশ্বে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ স্বল্প সময়ে প্রাণ হারালেও বাংলাদেশে এখনো সে অবস্থা মোকাবেলা করতে হচ্ছে না। বিচ্ছিন্ন কিছু দৃষ্টান্ত ছাড়া এটাকে বিরাট সাফল্য বলাটাই সমীচিন হবে।
এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও শিক্ষকবৃন্দ কিন্তু ঘরে বসে নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ শিক্ষাই হোক সকল বিভাগের শিক্ষকগণই স্ব স্ব উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যাতে ব্যাহত না হয় সে প্রচেষ্টাই সার্বক্ষণিক করে যাচ্ছেন।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরী, মাদ্রাসা কিংবা উচ্চ শিক্ষাই হোক, সকল বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের ভূমিকাও এখানে লক্ষণীয়। সবাই নিজ নিজ দূরদর্শী চিন্তাভাবনায় প্রতিনিয়ত শিক্ষা বিভাগে গঠনমূলক নির্দেশনা প্রদান করে যাচ্ছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না। এর মধ্যে একটি নির্দেশনা হচ্ছে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারাদেশকে অল্প সময়ের মধ্যেই ডিজিটালাইজেশন করতে সক্ষম হয়েছেন। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহও এ ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম হতে বাদ পড়েনি। জনগণও বাদ যায়নি। এর অভূতপূর্ব সাফল্য এখন দৃশ্যমান। সারাদেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সকল বিভাগের শিক্ষকগণই এখন স্ব স্ব উদ্যোগে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। কোথাও বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কোথাও বা নিজ নিজ উদ্যোগে এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও প্রতিনিয়ত লাইভ ক্লাস গ্রহণ করে শিক্ষকগণ বিস্ময়কর সাফল্যও অর্জন করেছেন। হয়ত করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় জাতীয় পত্রিকাসমূহ হাতে না পাওয়ায় এ অভূতপূর্ব সাফল্যের সংবাদ সবাই জানতেও পারছে না।
সাফল্যের মধ্যেও কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে হয়ত কেউ নিজস্ব উর্বর মস্তিষ্কের অদ্ভুত অদ্ভুত সিদ্ধান্তে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করে থাকেন। এরকম একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে জানা যায়। ইতোমধ্যে অনলাইন পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচরে এসেছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (নজরুল ইসলা রনি) ও এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার একজন ইউএনও এর এরকম একটি ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্তে শিক্ষকসমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ইউএনও মহোদয়া হয়ত ভেবেছেন শিক্ষকরা মহানন্দে বাড়িতে বসে আছেন, বাড়িতে বসে বসেই বেতন পাচ্ছেন, ফাঁকিবাজি করছেন। তাই তিনি শিক্ষকগণকে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রশ্নপত্র দিয়ে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। পরীক্ষা গ্রহণের জন্য আদেশ দিয়েছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কীভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেন? সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষকগণ কীভাবে বাড়ি হতে বের হবেন? তারা কি নিজেরা করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হবেন নাকি শিক্ষার্থীদেরকে সংক্রমিত করবেন? যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে অবশ্যই সরকারি নির্দেশনা মেনে নির্দেশ প্রদান করতে হবে। আশা করি ইউএনও মহোদয়া বিষয়টি উপলব্ধি করে নিজের ভুলটি বুঝতে পারবেন এবং তা দ্রুত সংশোধন করবেন। শিক্ষার্থীদের উপকার করতে গিয়ে কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ করা যাবে না।
ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে একটি গল্প আছে। সে গল্পটির সারমর্ম হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মনে করে পাকস্থলী কোন কাজ না করে বসে বসে খায়। অথচ তারা কত কষ্ট করে খাদ্য সংগ্রহের কাজটি করে থাকে। চোখ দুটো খাদ্যের সন্ধান দেয়, পা দুটো খাদ্য সংগ্রহে অবদান রাখে, হাতদুটো খাদ্য খেতে সহযোগিতা করে, জিহ্বা স্বাদ গ্রহণের মত গুরুত্বপুর্ণ কাজ করে, দাঁতগুলো সে খাবার চর্বিত চর্বন করে পাকস্থলীতে প্রেরণ করে আর পাকস্থলী মহানন্দে তা খেতেই থাকে। অবশেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল পাকস্থলীকে আর খাবার দেয়া যাবে না। সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলে দেখা যায় পাকস্থলী দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সাথে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে সবার উপলব্ধি হল আসলে পাকস্থলী তো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করছে। অথচ বেঁচে থাকার জন্য তারা শুধু যোগান দেয়ার মত স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ কাজই করছে।
শিক্ষা বিভাগ বিপর্যস্ত হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীবৃন্দ পথভ্রষ্ট হয়ে দেশকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যাবে। কাজেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই সচল রাখতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী এবং তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এখন পর্যন্ত শিক্ষা বিভাগ সঠিক পথেই চলছে। অগ্রপথিকের সার্থক ভূমিকা রাখছে। এর চেয়ে যদি আর কোন উন্নত চিন্তাভাবনা থাকে তাহলে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। নয়তো নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। [সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com