কোরআনময় হোক আমাদের রমজান
এহসান বিন মুুজাহির॥ পবিত্র রমজান মাস হলো কোরআন চর্চার মাস। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাসজুড়ে বিশুদ্ধ তেলাওয়াতে কোরআনের প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়েছে। ব্যস্ততা থেকে অবসর হয়ে কোরআন প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হয়ে বিশুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন শিখা আবশ্যক। অথবা নুরানী পদ্ধতিসহ বেশ কিছু কার্যকরী মেথড আবিষ্কৃত হয়েছে যা স্বল্প সময়ে আল কোরআন সহিহশুদ্ধভাবে শিখার সুব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে বয়স্কদের জন্যও বয়স্ক কোরআন শিক্ষা কোর্স রয়েছে। এছাড়াও বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষাদানের জন্য দেশে বিভিন্ন কুরআন শিক্ষা বোর্ড পবিত্র রমজানুল মোবারকে দারুল ক্বিরাত নামে কোরআন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছে। সিলেটের আঞ্জুমানে তা’লীমুল কোরআন বাংলাদেশ, দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, আল খলীল কোরআন শিক্ষা বোর্ড, মাদানিয়া কোরআন শিক্ষা বোর্ডসহ আরো অনেক শিক্ষা বোর্ড সারাদেশে বিশুদ্ধ কুরআনের খেদমত অব্যাহত রেখেছে।
পুরো রমজান মাস সারাদেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমুহে সকল শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অভিভাবকগণ ইচ্ছা করলে এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সন্তানকে রমজান মাসব্যাপী বিশুদ্ধ কোরআন প্রশিক্ষণ কোর্সের যে কোন কেন্দ্রে ভর্তি করাতে পারেন। শিক্ষার্থীরা ইচ্ছে করলেই রমজান মাসব্যাপী দারুল কিরআত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে বিশুদ্ধ কোরআন শিখতে পারবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কুরআন শেখার ব্যাপারে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে তেমন আগ্রহ নেই মুসলিম সমাজে। একজন মুসলিম নর-নারী হিসেবে কোরআন শিক্ষা এবং পাঠের প্রতি আগ্রহ না থাকা খুব দুঃখজনক বিষয়। তবে কিছু শিক্ষার্থী আগ্রহী হলেও কোচিং এবং প্রাইভেট শিক্ষকদের কারণে তাও সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী এবং সচেতন অভিভাবক সুত্রে জানা যায়-রমজানে স্কুলের ক্লাস না থাকলেও সকাল ১০টা থেকে ছেলে- মেয়েরা কোচিং শিক্ষকের কাছে পড়তে হয় এবং দুপুরে বাসার প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে হচ্ছে। কোরআন শিক্ষা কোর্সের মূল সময়টুকু কোচিং এবং প্রাইভেট এর শিক্ষকরা বরাদ্দ রেখে শিক্ষার্থীদের বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষার প্রশিক্ষণ কোর্স থেকে বঞ্চিত করছেন!
বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা শৈশব থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে রয়েছে। এক যুগ আগে দেখেছি প্রতিটি পাড়া মহল্লার মসজিদ থেকে সকালে কানে আওয়াজ আসতো আলিফ, বা, তা, ছা আর কালিমা পাঠের মিষ্টি মধুর সুর। শিশু-কিশোরের মুখ থেকে পবিত্র কোরআন পাঠ ও সূরা মশকের সেই আওয়াজে তখন মুখরিত থাকতো মক্তবগুলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিশুরা আরবি কায়েদা, আমপারা এবং পবিত্র কোরআন শরিফ বুকে নিয়ে মক্তবে ছুটে যেতো। ইদানিংকালে শহরে তো এমন দৃশ্যেরকল্পনাও করা যায় না এমনকি গ্রামেও নেই এমন চিত্র। এখন শিশুরা মক্তবে পড়ার সময় পায় না। কারণ সকাল থেকে ব্যাগ নিয়ে ছুটে কোচিংয়ে কিংবা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। সকাল-বিকাল, সন্ধা প্রাইভেট, কোচিং এবং হোম ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। ন্যাশনাল কারিকুলম অনুয়ায়ী পরিচালিত দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ ইসলাম শিক্ষা। তৃতীয় শ্রেণি থেকে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা নামে একটি পাঠ্যপুস্তক পাঠ্যসূচিতে থাকলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ধর্মীয় শিক্ষা নেই।
অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতেও নেই আরবি পড়ার বিশেষ সুব্যবস্থা। আজ থেকে এক যুগ আগেও আলাদাভাবে নামাজ রোজার নিয়ম কানুন, জরুরি মাসআলা-মাসায়েল, দোয়া-কালাম ইত্যাদি শিখানো শিখানো হতো মসজিদের মক্তবগুলোতে। সকালের মক্তব বিলীন হওয়ার কারণেই আরবি এবং ধর্মীয় শিক্ষা থেকে এ প্রজন্মের শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে। সকালের মক্তব বন্ধ হওয়ার পেছনে কেউ কেউ কিন্ডারগার্টেন স্কুলসমুহকে দায়ি করছেন। কারণ হিসেবে বলছেন শিশুদের উপর কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বাড়তি পড়ার চাপ। রমজান মাসে পড়া-শোনার চাপ কিছুটা কম থাকলেও কোচিং এর চাপে আরবি পড়ার সুযোগ মিলছে না শিক্ষার্থীর। রমজান মাসে মুসলিম সন্তানরা যাতে কওে পবিত্র কোরআন শেখার সুযোগ পায় এ ব্যপারে সংশ্লিষ্টদেও সুদৃষ্টি কামনা করছি।
যে ব্যক্তি নিজেকে একজন প্রকৃত মুমিন হিসাবে দাবি করবে তাকে অবশ্যই পবিত্র কোরআন শিক্ষা করতে হবে। কোরআন শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ তাআলা কোরআন শিক্ষা করা ফরজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আলাক : ১)। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, মহান আল্লাহ বলেন-‘আমি কালামুল্লাহকে পৃথক পৃথক পাঠের উপযোগী করেছি, যাতে আপনি একে লোকদের কাছে ধীরে ধীরে পাঠ করেন এবং ওহি যথার্থভাবে অবতীর্ণ করেছি’। )সূরা বনি ইসরাইল : ১০৬)। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-‘রমজান হলো এমন একটি মাস, যে মাসে কোরআন কারীম অবতীর্ণ করা হয়েছে লোকদের হিদায়াতের জন্য এবং সত্যপথযাত্রীদের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও সত্যমিথ্যার মাঝে পার্থক্য নিরূপণকারী হিসেবে’। (সূরা বাকারা : ১৮৫)। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আর আমি তো কোরআন শেখার জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি? (সূরা আল ক্বামার : ১৭)। কুরআনে এরশাদ হয়েছে-‘তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়’। (সূরা আল মুযযাম্মিল : ২০)। আল্লাহ বলেন-‘নিশ্চয়ই এ কুরআন বিশ্ব জাহানের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে’। (আশ-শুআরা ১৯২)।
নবীজী বলেন-রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ৬৬২)। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন-‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যিনি কোরআন শিক্ষা করেন এবং অপরকে শিক্ষা দেন। (বুখারি : ৫০২৭। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন-তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কারণ, কোরআন কেয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে। (মুসলিম: ১৯১০)।
হাদিসে বর্ণিত, রোজা ও কুরআন কিয়ামাতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, রোজা বলবে হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব,আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে (মুসনাদ আহমাদ: ৬৬২৬)। নবিজী বলেন-যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ। (তিরমিজি : ২৯১০)। হজরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- কোরআনের বিষয়ে তোমাদের উপর অবশ্য পালনীয় এই যে, কোরআন শিক্ষা করা এবং তোমাদের সন্তানদের কোরআন শিক্ষা দেয়া। কেননা এ বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তার প্রতিদানও দেয়া হবে। (বুখারি : ৪৬)। কোরআন শিক্ষা এবং পাঠের প্রতি অবহেলা করা যাবে না। আসুন রমজানকে কোরআনময় করি। কুরআন নাযিলের এই মহিমান্বিত মাসকে কুরআন পাঠ ও চর্চার মাধ্যমে কাটানোর চেষ্টা করি।
লেখক: প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন