কোরবানির ইতিহাস ও মুসলিমজীবনে কোরবানির গুরুত্ব

July 19, 2021,

এহসান বিন মুজাহির॥ কোরবানি গুরুত্বপুর্ণ একটি ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানির গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন কারিমে এরশাদ করেন-‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি যাতে তাঁরা হালাল পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। (সূরা হজ : ৩৪)। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে আরও বলেছেন-‘নিশ্চই আমার নিকট কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই কবুল হয় না, তবে আমার নিকট পৌছে একমাত্র তাকওয়া। (সূরা হজ : ৩৭)। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন-‘কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগে কোরবানিদাতার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তাঁর অতীতের সকল গুনাহ মোচন করে দেয়া হয়। (তিরমিজি : ১/১৮০)। মহানবী (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘তোমরা মোটা তাজা পশু দেখে কোরবানি কর, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে। (মুসলিম : ২৬৩৯)। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল (সা.) পবিত্র মদিনায় দশ বৎসর জীবন-যাপন করেছেন প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি : ১/১৮৯)।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর নিকট কোরবানি অপেক্ষা উত্তম কোন আমল আর নেই। (মেশকাত : ১৯৩৭)। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানির দিন কোরবানি করে না, সে যেন ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের ময়দানের কাছে না যায়। (ইবনে মাজাহ : ১৭২১)। একদিন হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) রাসূলুল্লাহর (সা.) নিকট জিজ্ঞাসা করলেন হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কি? তখন উত্তরে রাসুল (সা.) এরশাদ করলেন কোরবানি হচ্ছে ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.) এর ‘জীবনাদর্শ’, সাহাবি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন কোরবানির ফজিলত কি? রাসুল (সা.) বললেন-পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি করে নেকি দেয়া হয়’। (মেশকাত : ১/১২৯)। কোরবানি শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য, সান্নিধ্য, আত্মত্যাগ, জবেহ, রক্তপাত ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুুষ লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হালাল কোন পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা। কোরবানি নতুন কোনো প্রথা নয়, বরং এটা আদিকাল থেকে চলে আসছে। হজরত আদম (আ.) এর যুগে কোরবানির সুচনা হয়েছিল। আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল কাবিলের মধ্যে বিবাহ-শাদী নিয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দিল তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ইখলাসের সঙ্গে হালাল পশু কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি আমার নিকট কবুল হবে তার নিকট মেয়ে বিবাহ দেয়া হবে। হাবিল এবং কাবিল কোরবানির নির্দেশ পেয়ে কোরবানি করল। হাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হল, কাবিলের হলো না। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে বলল আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-‘হে নবী আপনি তাদের নিকট যথাযথভাবে আদম (আ.) এর পুত্রদ্বয়ের কথা আলোচনা করেন, যখন তারা মহান রবের নিকট তাদের কোরবানিকে পেশ করল, তখন একজনের কবুল হল অন্যজনের হলো না। যার কোরবানি কবুল হলো না সে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে বলল আমি তোমাকে খুন তথা হত্যা করে ফেলবো। পালনকর্তা একমাত্র মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন। (সূরা মায়িদা : ২৭)।
কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : প্রথমে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর কোন সন্তান ছিল না তাই তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বললেন ‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনি নেককার সন্তান দান করেন। তাঁর এ দুয়া মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কবুল হয় এবং তিনি তাঁকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিলেন। ইবরাহিম (আ.) একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁর কলিজার টুকরা পুত্র সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দেয়ার জন্য। কোন কোন রেওয়াত থেকে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন ইবরাহিমকে (আ.) পরপর তিনদিন দেখানো হয়। এ প্রসঙ্গে তাফসিরের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে যে, হজরত ইবরাহিম (আ.) এর বয়স যখন তের অথবা পুর্ণবয়স্কে পৌঁছেছিল তখন তাকে এ স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল । ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নের মাধ্যমে এ নির্দেশ পেয়ে চিন্তিত হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন ইসমাঈল কি মেনে নিবে। সে কি আল্লাহর রাস্তায় জান বিলাতে রাজি হবে। তিনি তার ছেলের কাছে গেলেন এবং বললেন আমি স্বপ্নের মাধ্যমে তোমাকে কোরবানি করার নির্দেশ পেয়েছি তোমার কি মতামত? তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন, আব্বা আপনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশ পেয়েছেন তা বাস্তবায়ন করেন। ইনশাল্লাহ আমাকে আনুগত্য ও ধৈর্যশীলদের অর্ন্তভুক্ত পাবেন। পুত্র ইসমাইল (আ.) এর মুখ থেকে প্রাণভরা কথা শুনে তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তাকে কোরবানি করার জন্য ময়দানে নিয়ে গেলেন। ইসমাঈল (আ.) এর হাত, পা বেঁধে জমিনে শুয়ে দিলেন। ধারালো চাকু দ্বারা তাঁর গলাতে পোঁচ দিতে লাগলেন, কিন্তু আল্লাহর কি অপার মহিমা ছুরি তথা চাকু দ্বারা গলা কাটবে তো দূরের কথা তার গলায় দাগও বসাতে পারেনি। ইবরাহিম (আ.) নতুন আরেকটি ছুরি হাতে নিলেন এবং পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন তখন গায়েবীভাবে একটি আওয়াজ তার কানে পৌঁছলো, হে ইবরাহিম তুমি মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছো, তোমার কলিজার টুকরা সন্তানকে আর কষ্ট দিও না, এবার তাকে ছেড়ে দাও। তোমার কোরবানি হয়ে গেছে। পুত্রের বদলে তুমি একটি তরতাজা দুম্বা কুরবানি করো। তখন ইবরাহিম (আ.) একটি দুম্বা কোরবানি করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন। (তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন)। হজরত ইবরাহিম (আ.) ইসমাইল (আ:) কে কোরবানি করতে গিয়ে শয়তান অনেক কুমন্ত্রণা ও প্রতারণা দেয়ার প্রাণপণ প্রচেষ্টা করেছিলো কিন্তু খলিলুল্লাহ শয়তানের সব প্ররোচনাকে পেছনে ফেলে মহান রবের নির্দেশ পালনে মনযোগী হলেন। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বললেন যখন ইবরাহিম ছুরি চালালেন তখন জিবরাইল আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, না জানি আমি পৌঁছার আগেই জবাই কাজ শেষ হয়ে যায় কিনা তাই তিনি জোরে জোরে আল্লাহু আকবারের ধ্বনি বলে আসছিলেন, আর এ তাকবিরের আওয়াজ ইবরাহিম (আ.) এর কানে পৌছলো তিনি উপরের দিকে তাকালেন এবং বুঝতে পারলেন যে, জিবরাইল আল্লাহু আকবার তাকবির ধ্বনি দিয়ে আসছেন তখন তিনি বলে উঠলেন ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ আর এই তাকবীর শুনার পর ইসমাঈল (আ.) পরবর্তী লাইন ‘ওয়ালিল্লাহিল হামদ’বলে উঠলেন। (তাফসিরে মাজহারি)। পিতা পুত্রের এই মহা আত্মত্যাগ আজও আমাদের প্রেরণা যোগায়। এই অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণ রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মোহাম্মদির উপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অধ্যক্ষ, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার ahsanbinmujahir@gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com