ক্যালিওগ্রাফি-ইসলামি লিপিকলা ও মুসলিম সংস্কৃতির অনুপম নিদর্শনঃ ইতি কথা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গঁ জীবন বিধান। মনব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ-বিবর্তন ও অগ্রাভিযানের ইতিহাসে ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান স্বীকৃত। খ্যাত। মুসলিম পন্ডিত-দার্শনিক-আলেম-ওলামা-জ্ঞানী-গুনীজন যেমনি শিক্ষা জ্ঞান, বিজ্ঞান, স্থাপত্য শিল্পে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন ঠিক তেমনি ইসলামী লিপি কলায় ও মুসলমানদের অনুপম অবদান অনস্বিকার্য্য।
ক্যালিওগ্রাফি- লিপিকলা- প্রসঙ্গেঁ আলোচনার প্রেক্ষিতে ক্যালিওগ্রাফি প্রসঙ্গেঁ কিঞ্চিত আলোকপাত করা একান্তই প্রাসঙ্গিঁক। ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে গ্রীক Calio graphia শব্দ থেকে Cally graphy শব্দের উৎপত্তি। Calio- – শব্দার্থ লিখা- graphia মানে সুন্দর হস্তাক্ষর। অতএব গ্রীক ক্যেলিওগ্রাফি শব্দার্থ সুন্দর হস্ত লিখন। ইসলামি ও মুসলিম ক্যালিওগ্রাফি বলতে মুসলিম সুন্দর হস্ত লিখন পদ্ধতি বুঝায়। আরবি অক্ষরে অলংকরন এবং হস্তলিখন প্রসঙ্গেঁ Christবলেন Arabic script the sole contribution to Islamic art is a universal mark of Muslim dominance of influence where ever it spread” সপ্তম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত মুসলিম জাহানে লিপি শিল্প লালিত কলা রূপে চর্চিত হয়। লোকপ্রিয়তা পায়।
আরবি বর্নমালাকে কেন্দ্র করেই ইসলামি লিপি কলার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ। আরবি ভাষাও সংস্কৃতি, আরবি লিপি-বর্ন হরফ-জের-জবর-পেশের সঙ্গেঁ মুসলিম জাহানের একটি আলাদা আবেগ অনুভূতি স্বতন্ত্র স্বকিয়তা বৈশিষ্ট স্বাতন্ত্র বিদ্যমান। কারন আরবি পবিত্র আলকোরআনের ভাষা। আরবি ইসলাম ধর্মের প্রচারক-মহামানব মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) এর মাতৃভাষা আরবি ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ সঃ) এঁরও ভাষা। আরবিতেই আল্লাহর ফেরেশতা মহা নবীকে বলেন “ইকরা বিসমি রাব্বুকাললাজি খালাক্ক-খালাকাল ইনসানা মিন আলাক।” এই প্রেক্ষিতে সহজেই বলা চলে আমাদের মহান স্্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার ভাষাও আরবি। এই আরবি ভাষাও সংস্কৃতিও খুবই প্রাচীন। “ মুসলিম স্থাপত্য ও শিল্পকলা”- মতে কথিত যে, মানবজাতির আদি পিতা ও আল্লাহর নবী আদম (আঃ) আরবি, সিরিও ও অন্যান্য বর্নমালার উদ্ভাবন করেন। হযরত আব্দুল্লা বিন আব্বাসের বর্ণনামতে হযরত ইসমাইল (আঃ) মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েস থেকেই আরবি বর্নমালায় লিখন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। কারো কারো মতে হযরত ইদ্রিস (আঃ) আরবি লিখন পদ্ধতির প্রবর্তক। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে আরবি লিপি কলা মুসলিম জাহান কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে।
ইসলামিক লিপি কলার ইতিহাসে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক একটি চীর স্মরনীয় ও শ্রদ্ধেয় নাম। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রীয় কাজে রোমান ও পারসিক হরফের পরিবর্তে আরবি হরফ ব্যবহার করায় ইসলামি লিপি কলার স্বর্ন যুগের শুভ সূচনা। ঠিক তেমনি আব্বাসীয় শাসনামলে ও আরবি লিখন পদ্ধতির প্রচলন ছিল।
আরবি লিপি কলার বিকাশের আরো কতেক ধর্মীয় কারনও বিদ্যমান ছিল। মুসলিম সমাজে জানদার প্রানির ছবি তথা চিত্র শিল্পের নিষেধাজ্ঞায় মুসলমান লিপি কলাবিদগন ধর্মীয় কারনেও পবিত্র আলকোরআনের ভাষা আরবি হরফে সৃজনশীল-শিল্পসম্মত লিখন পদ্ধতি তথা ইসলামিক ক্যালিওগ্রাফিতে আত্বনিয়োগ করেন। রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রশংসাপ্রাপ্ত হন। চিত্র শিল্পের চাইতে ইসলামিক লিপি শিল্পও ছিল সহজ, সরল, মার্জিত, রুচীশিল। চিত্র শিল্পে নগ্নতায় অশ্লীলতায় শিল্পের শ^াস্বত সৌন্দর্য ও সৌকর্য্য প্রশ্নবিদ্ধ, যা ইসলামি লিপি কলায় নেই।
“ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি: মুসলিম শিল্প ও চিত্রকলার বিকাশ” গ্রন্থের লেখক ত্রয় অধ্যাপক মোঃ সফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম শিশির এবং অধ্যাপক মোঃ জাহিদুল ইসলামের মতে মুসলিম লিপিকলাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বিভাগ ত্রয় হল: ১. কুফি বা কুফিক রীতি, ২. নাসখ রীতি, ও ৩. নাসতালিক রীতি। কুফিক রীতি আরবি লিপির প্রধান ও প্রাচীন রীতি। প্রাচীন ইরাকের ঐতিহাসিক কুফা- নগরে এই রীতির উদ্ভব বলে এই পদ্ধতি কুফিক পদ্ধতি নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে খ্যাত ও স্বীকৃত মেসোপটেমীয় সভ্যতা বিশে^র একটি প্রাচীন সভ্যতা। এই মেসোপিটেমীয় লিখন পদ্ধতির অনুকরণে কুফিক রীতির বিকাশ। প্রাক ইসলামি এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই পদ্ধতির প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। খোলাফায়ে রাশেদীন এর অন্যতম শ্্েরষ্ট খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এর শাসনামলে কুফিক রীতি সর্বপ্রথম সরকারী স্বীকৃতি লাভ করতঃ লোক প্রিয়তা অর্জন করে। ডোমঅবদি রকের পিলারাভ্যন্তরে কুফিক রীতিতে স্থাপিত পবিত্র আল কোরআনের একটি আয়াত একটি অনুপম ঐতিহাসিক নিদর্শন। ঢাকার ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লা এবং যাদুঘরে কুফিক রীতি সংরক্ষিত। কুফিক লিপি কলার বিকাশে খলিল ইবনে আহমদ, আলী ইবনে কুশাইর, আসওছাদ কুতুবাই প্রমুখ লিপিকারক গন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও অবদান রাখেন বলে জানা যায়। নাসখ রীতি কুফিক রীতির পরিবর্তিত আধুনিক রূপ ও পদ্ধতি। হিজরি চতুর্থ সন থেকে এই পদ্ধতি প্রচলিত ও ব্যবহৃত। এই লিখন রীতি প্রসঙ্গেঁ M. Ziauddin তার ÒA monograph of Muslim caliographyÓ গ্রন্থে যথার্থই বলেন “ মুসলিম লিপি শিল্পের ইতিহাসে নাসখি পদ্ধতির আবির্ভাব এক রেঁনেসা যুগের সূচনা করে।” এই লিপি শিল্পের প্রধান শিল্পি ছিলেন ইয়াকুত মুসতা সিমি। তাঁর লিপিকলা সমগ্র মুসলিম জাহানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
তাব্রিজি চিত্র কলার প্রধান চিত্রকর খাজামীর আলী উদ্ভাবিত আরবি লিপি কলার অনুপম ও আধুনিক পদ্ধতি- নাসতালিক রীতি- ইসলামি লিপি শিল্পের ইতিহাসে নবতর রূপ প্রদান করেছে। আরবি লিখন পদ্ধতির নাসখ আর পারসিক পদ্ধতির তালিকের সমন্বিত সৌন্দর্য মন্ডিত রূপ ও নামই নাসতালিখ রীতি। তাজ সুলমানী নাসতালিক রীতির ব্যাপক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ইরানের তৈমুরী, সাফাভি এবং অভিবক্তভারত বর্ষের মুঘল শাসনামলে এই পদ্ধতি চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। ইতিহাস স্বাক্ষী আধুনিক চিত্রশিল্পে মুঘল স¤্রাটগন শিল্পসংস্কৃতির শুধুমাত্র পৃষ্ট পোষকই ছিলেন না, ছিলেন চিত্রকর ও। বিশেষত মুঘল স¤্রাট বাবর, হুমায়ুন এবং স¤্রাট জাহাঙ্গীর স্বয়ং চিত্র শিল্পী ছিলেন।
ইতিহাসের আলেচিত ও স্বীকৃত সত্যযে ক্যালিওগ্রাফি-লিখন শিল্পের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান ঐতিহাসিক। অনুপম। অপরিসীম। পৃথিবীর কোন সভ্যজাতি মুসলমানদের মত লিপি শিল্প-লিপি কলার ইতিহাসে অবদান রাখতে পারেন নি। চীন, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইটালিতে লিপি শিল্পের চর্চা থাকলেও আরবি লিপি কলা ও লিপি শিল্পের মত উন্নত শিল্প -শৈলিও শ^াস্বত সৌন্দর্য কোথাও দৃষ্ট হয় না। মানব সভ্যতার লিপি কলার ইতিহাসে ক্যালিওগ্রাফিতে ইসলামি লিপি শিল্পের অনুপম অবদান ঐতিহাসিক।
দূখঃ ও দূভাগ্যজনক ভাবে উল্লেখ করতে হয় বিরান্নব্বই ভাগ মুসলমানদের দেশে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী মোতাবেক রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হলেও ইসলামী এই ঐতিহ্যের চর্চা নেই। চালু নেই। প্রয়োজনীয় বই পুস্তক নেই। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকাধীন আর্ট কলেজে ইসলামি লিপিকলা ক্যেলিওগ্রাফির কি চর্চা হয় দেশবাসী জানেন না। ক্যোলিওগ্রাফি ইসলামি লিপিকলার চর্চা ও চালুর মাধ্যমে ভূত-প্রেতের ছবির পরিবর্তে আরবি হরফ দ্বারা ইসলামি লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা কি আমাদের অন্ধকার ভূবনকে আলোকিত করতে পারিনা ? ধর্ম মন্ত্রনালয়, ইসলামি ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এর আরবি বিভাগের কি কিছু করার নেই ?
[ষাটের দশকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র। সত্তোর দশকে কলেজ শিক্ষক। সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। কলামিষ্ট। সেক্রেটারি জেলা জামে মসজিদ।]
মন্তব্য করুন