খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, একজন বিরল ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতিমান ব্যাংকার-শ্রদ্ধাঞ্জলী
ড. মোহাম্মদ আবু তাহের॥ যা কিছু মোর সঞ্চিত ধন/এতদিনের সব আয়োজন/চরম দিনে সাজিয়ে দেব উহারে/মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই পংত্তিমালা সত্যে পরিণত করে ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ ভোর সাড়ে পাঁচটায় পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করে প্রায় ৮০ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। দীর্ঘ প্রায় এক মাস তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশের এই বর্ষীয়ান ব্যাংকার ও অর্থনীতিবীদ মরণকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি, বর্ণাঢ্য জীবন সাজিয়ে তা মরণের হাতেই তুলে দিয়েছেন।
ব্যাংকার হিসেবে যেমন তিনি অসাধারণ কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন ঠিক তেমনি তিনি এক বিরল ব্যক্তিত্ব ও অনন্য প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন। দূর্ণীতির বিরুদ্ধে আজীবন যোদ্ধা খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের জন্ম ১৯৪১ সালের ৪ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতোকোত্তর এবং পরে আই বিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে হাবিব ব্যাংকে প্রবেশনারী অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। চার দশকের ব্যাংকিং পেশার উল্লেখযোগ্য সময় তিনি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থ্ধাসঢ়;পনা পরিচালক নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের কৃষকদের প্রকৃত অবস্থা দেখতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সরেজমিন মাঠ পরিদর্শন করার সংস্কৃতি চালু করে তিনি বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও পালন করেছেন। ব্যাংকিং ও অর্থনীতির বিশেষ অবদানের জন্য তিনি খান বাহাদুর আইসান উল্লাহ স্বর্ণপদক ও খান বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তাছাড়া ২০১১ সালে বাংলা একাডেমী ইব্রাহিম খালেদকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করেন। এছাড়া তিনি আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১০ সনে শেয়ার বাজার পতনের কারণে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দাকার ইব্রাহিম খালেদ। দেশের আর্থিক খাতের বিবেক বলে পরিচিত ছিলেন ইব্রাহিম খালেদ। তিনি একজন খ্যাতিমান কলামিষ্ট ও লেখক ছিলেন তার লেখা বই গুলো হলো ব্যাংকিং সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা / মুক্তি সংগ্রাম ও মহানায়ক/ জীবন যখন যেমন / ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে/ কিছু স্মৃতি কিছু কথা। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ অন্যায় অবিচারের সমালোচনা করতে গিয়ে কখনো দল ও ব্যক্তি বিবেচনা করতেন না, এজন্যই তিনি অনেক উচ্চতায় চলে গেছেন। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের বিকাশে তার অবদান অবি:স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নির্ভীক। আর্থিক খাতের অনিয়ম ও দূর্ণীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার, তার লেখনিতে সমাজের নানা অনিয়ম ও অসংগতি উঠে এসেছে। তিনি দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত কলাম লিখতেন। ইব্রাহিম খালেদ ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণরের দায়িত্ব পালন করেন। ডেপুটি গভর্ণর থাকাকালীন তিনি ইচ্ছাকৃত ঝণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাপের কাছে মাথানত না করার দৃষ্ঠান্ত রয়েছে তাঁর। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন ইব্রাহিম খালেদ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। এজন্যই শেয়ারবাজার কেলেংকারীর সঙ্গে জড়িতদের বোষানলে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি দূর্ণীতিবাজদের সাথে আপোষ করেননি। নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি তিনি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছিলেন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক অরাজকতা চলছে। অর্থ্যাৎ আইন অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। যাকে বলা যায় সুশাসনের অভাব। তিনি বলেছেন ব্যাংকিং কমিশন না করে ব্যাংকিং অপরাধ তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। তারা দেখবে কোন ব্যাংকে কিকি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং কারা করছে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল মেয়াদে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম সেরা ব্যাংক পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পূবালী ব্যাংক সম্পূর্ণ বাঙ্গালী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এদেশের প্রথম ব্যাংক। পূবালী ব্যাংক বাঙ্গালী ও বাংলার চেতনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি ব্যাংক। ইব্রাহিম খালেদ স্যার যখন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন এই ব্যাংকটি ছিল সমস্যাগ্রস্থ। তিনিই পূবালী ব্যাংককে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে এনেছেন। এ ব্যাংকটিকে লাভজনক ব্যাংকে পরিণত করেছেন। তার গতিশীল নেতৃত্বে ব্যাংকটির সাহসিকতা ও উদ্ভাবনী শক্তির পূণর্জাগরনের মধ্য দিয়ে দেশের সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে পূবালী ব্যাংক লিঃ। এখন পূবালী ব্যাংককে দেশের ১ নং ব্যাংকে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন পূবালী ব্যাংকের হাজার হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী, নির্বাহীবৃন্দ ও উচ্চতর ব্যাবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, সেই কৃতিত্ব খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের। পূবালী ব্যাংকের উন্নয়ন অগ্রগতির আর এক দিকপাল সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যুতে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “তিনি সব সময় ন্যায়নীতির মধ্যে থাকার চেষ্ঠা করেছেন। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির কিভাবে উন্নতি ঘটবে সে চিন্তাও করতেন। ব্যাংকখাত যে অর্থনীতির প্রাণশক্তি এটা তিনি ভালভাবেই অনুধাবন করতেন। সেভাবেই ব্যাংক নিয়ে পরিকল্পনা করতেন। উনি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন নি। এমনকি তার সঙ্গে থাকা কাউকে জেনে-বুঝে অন্যায় করতে দেননি। তার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছে ও জেনেছি। ওনার যে সততা ও প্রজ্ঞা ছিল তা পুরো আর্থিক খাতে তাকে স্মরণীয় করে রাখবে।” গুরুতর অসুস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি দেশ ও সমাজের কল্যাণে কথা বলেছেন, লিখেছেন, যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন, নানা ধরনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করেছেন, নৈতিক অবস্থান দৃঢ় রেখেছেন। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ অধ্যাপনা ও করেছেন। তিনি (বি আই বি এম) বাংলাদেশ হনষ্ঠিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজম্যান্টের অধ্যাপক ছিলেন। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৪৮ নং আয়াতে এরশাদ হচ্ছে- তোমরা কল্যাণমূলক কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অগ্রসর হও। ইব্রাহিম খালেদ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পেশার বাহিরে অনেক কল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার পরিচালক। তিনি ছিলেন শিশু ও তরুণদের আইডল। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে শিশু কিশোরদেও সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলার এক মহান দায়িত্ব পালন করেছেন ইব্রাহিম খালেদ। পৃথিবীতে নিষ্টুরতন ঘটনা মানুষের মৃত্যু। মানুষ একটি ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে নির্দিষ্ট সময়ে আবার চলে যায় চিরদিনের জন্য। এ পরিণতি থেকে রেহাই নেই কারোরই কীট পতঙ্গ থেকে মহামানব পর্যন্ত। মৃত্যু নিয়ে হুমায়ূন আহমদের অনেক আক্ষেপ ছিল, কষ্ঠ ছিল। তাঁর শেষ লেখাগুলোতে ছিল বেচে থাকার আকুতি। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন একটা কচ্ছপের জীবন সাড়ে তিনশত বছর, মানুষ কেন এত অল্প সময় বাঁচে।
কোনো কোনো মৃত্যু হাঁসের পালকের মতো তুচ্ছ, আর কোন কোন মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যু ও পাহাড়ের মতো ভারী দৃশ্যমাণ হয়েছে দেশের মানুষের কাছে। মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন অর্থবহ হয় তখনই যখন তার কর্মে সন্তষ্ঠ হয় স্বজন, দেশবাসী। ইব্রাহিম খালেদের কর্ম, চিন্তা চেতনা ও মূল্যবোধে সকলেই সন্তষ্ঠ। তার কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তার অসাধারণ গতিশীল নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, দূরদর্শীতা, জীবন পরিচালনার দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তা সকলের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে বলে মনে করি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আঃ হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী সহ অসংখ্য শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। দেশ ও বিদেশ থেকে অনেক মানুষ ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। আমেরিকা প্রবাসী সাবেক ব্যাংকার সাইফুর রহমান তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন “এই একজন মানুষ তাকে উপযুক্ত ক্ষমতা দিয়ে কাজে লাগালে ব্যাংকিংখাতের অনিয়ম ষোল আনা না হলে ও চৌদ্দআনা নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। তার অনেক গুনের মাঝে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগতো দ্রুত সিন্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা।
অনেকে জানেননা তার দিন শুরু হতো ফজরের নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে।” অভিবাদন ইব্রাহিম খালেদ স্যারকে, বয়সের আগে চলে গেলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ একথা হয়তো বলা যাবেনা। কিন্তু একটি মহীরুহ তার ছায়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে হারিয়ে গেলে যে শূণ্যতা বড় হয়ে দেখা দেয় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য সেই ছায়া দিয়ে যাওয়া এক মহীরুহ।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন আল্লাজী খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লিইয়াব লুয়াকুম আইয়্যুকুম আহছানু আমালা, অর্থাৎ তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন যেন তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ তার কর্ম দিয়েই তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন ইহা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁর সকল সৎকর্মকে কবুল কওে তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন এবং তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের ধৈর্য্য ধারণ করার তোফিক দান করেন আমি বিদগ্ধচিতে সেই দোয়া করছি।-লেখক-ব্যাংকার, গবেষক ও কলামিস্ট, মোবাইল নং ০১৭১১-১৩৭২৯৮।
মন্তব্য করুন