“গণতন্ত্রঃ গণআকাংখাঃ জন প্রত্যাশাঃ যুগে যুগে-সেকাল থেকে একালঃ
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব। ইসলামী বিধান মোতাবেক আশরাফুল মকলুখাত-সনাতনী শাস্ত্রানুসারে নররূপী নারায়ন। মানুষের শিক্ষাও জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্য, মেধাও মনন মানুষকে শ্রেষ্টত্বের মর্য্যাদা দিয়েছে। মানবজাতিও মানব সভ্যতার ইতিহাস ক্রম বিকাশ ও ক্রম বিবর্তনের ইতিহাস। বিকাশ ও বিবর্তনের মাধ্যমে আদি গুহা মানব থেকে আধুনিক মানব জাতির বর্তমান অবস্থান। মানব সভ্যতার বিকাশের সেই আদি-অন্ধকার যুগ থেকে মানব জাতির চিন্তা চেতনার প্রতি মূল্যায়ন-জন আকাংখা-জনপ্রত্যাশার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তকগন। আদি কালের রাষ্ট্র হীন জনগোষ্টি গোত্রবদ্ধ সমাজ ও জীবন যাপন করতেন। রাষ্ট্র ও সরকার না থাকলেও সমাজ পরিচালনায় গোত্র পতিগণ গন আকাংখা ও জন প্রত্যাশার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। গণতান্ত্রীক চিন্তা চেতনার বহিঃ প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
প্রাক ইসলামিক আরবের সমাজ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন-সেকালকে ইতিহাসবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীগণ-আইয়্যামে জাহেলিয়াত, ডার্কএইজ, অন্ধকার যুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আরবের সেই অন্ধকার যুগে পাঁচশত সত্তোর খৃষ্টাব্দে বিখ্যাত কোরাইশ বংশে আব্দুল্লা-আমেনার কোল আলোকিত করে রহমতুল্লিল আল আমীন-সাঈয়েদুল মুরছালিন-রাসুলে খোদা-মহামানব-মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) এই মায়াময় মাটির পৃথিবীতে-তশরীফ-আনয়ন করেন। নবুয়তি প্রাপ্তির পূর্বেই তিনি জনমানুষকে নিয়ে মানব কল্যানে কাজ করেন-গঠন করেন সামাজিক সেবা সংগঠন “হিলফুল ফুজুল” মহামানব মোহাম্মদ মোস্তফা আল আমীন হিসাবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভ করেন। রাসুলে খোদা মক্কা বিজয় ও বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য গঠনের পর যে গনমুখী শাসন সু-শাসন চালু করেছিলেন তা পৃথিবীর রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজ্য শাসনের ইতিহাসে উজ্জল উদাহরন হয়ে এখনও সমুজ্জল। মহামানব মহানবী মোহম্মদ (সঃ) এর বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষন- মদিনা সনদ গনতন্ত্র সুশাসন-মানবাধিকার জন আকাংখা ও জনকল্যানের কথাই বলা হয়েছে। মহানবীর মহাপ্রয়ানের পর-খোলাফায়ে রাশেদীন এবং খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ এর সুশাসনামলে একনায়ক তন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র নয় জনগনতান্ত্রিক ধ্যান ধারনার প্রথাও পদ্ধতি অনুসরন করা হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীন এর আমলে নির্বাচিত সংসদ, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জন প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও গন আকাংখা চিন্তা চেতনার চর্চা হয়েছে। সেই সময় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খলিফা নির্বাচন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় একনায়ক তন্ত্রী ধ্যান ধারনা ও মনোভাব এর পরিবর্তে মজলিশ-ই-শুরা-র পরামর্শ নেয়া হত। সমাজের গন্যমান্য নাগরিকদের মধ্য থেকে সুরার-সদস্য নির্বাচিত হতেন। মজলিশ-ই-শুরা-কে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আধুনিক জমানার কেবিনেট মিনিষ্টার্স, বোর্ড এর এডভাইজার্স এর সঙ্গেঁ তুলনা করা যেতে পারে। যদিও ধর্মীয় দৃষ্টি কোন থেকে মজলিশই শুরার মর্য্যাদা মানসম্মান অনেক উর্ধ্বে। সুরার ক্ষমতা ও দায়িত্ব দৃষ্টে মনে হয় ইসলামের প্রাথমিক যুগেই ব্যক্তিতন্ত্রের চাইতে নিঃসন্দেহেই বলা চলে ইসলামী জীবন দর্শন সেকেলে ধ্যান ধারনা সম্বলিত নয়, বরং বলা চলে ইসলামী ধ্যান ধারনা জীবন দর্শন একটি অত্যাধুনিক জনবান্ধব জীবন পদ্ধতি। মধ্য যুগে সেই সামন্ত তান্ত্রীক সমাজ ব্যবস্থায় ও রাজা বাদসা, শাহেন শাহ, সম্রাট গণ রাজ্য শাসনে আমীর, ওমরাহ, উজির, নাজির এর পরামর্শ নিতেন। তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে দিল্লীর শেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করে আফগান পাঠান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরি দিল্লীতে যে মুসলিম শাসনের শুভ সূচনা করেছিলেন দাসবংশ থেকে ১৫২৬ খৃষ্টাব্দ লোদী বংশ পর্য্যন্ত শাসকগণ সালতানাত অব দিল্লী নামে অভিহিত। দিল্লীর প্রথম মুসলিম শাসক মামলুকক্রীত দাস কুতুব উদ্দিন আইবেক থেকে লোদী বংশীয় শেষ শাসক ইব্রাহিম খাঁন লোদী পর্য্যন্ত রাজ্য পরিচালনায় ব্যক্তি তন্ত্রের চাইতে জনগণের মতামতকে মর্য্যাদা দিয়েছেন। দিল্লীর সুলতান গন রাজ্য শাসনে জনপ্রতিনিধিত্ব মূলক সংস্থা-চিহাল গনি-এর পরামর্শ নিতেন। ইতিহাসবিদদের মতে পরামর্শক সংস্থা চিহালগনী খুবই ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল। মহাবীর চেঙ্গীঁস তৈমুরের অধঃস্থন বংশধর মধ্য এশিয়ার ক্ষুদ্র রাজ্য ফারগানার অধিপতি জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কবিও হৃদয়বান ছিলেন। বাহুবলে শক্তি শালী ভারতের মুঘল শাসক গণও ব্যক্তি তন্ত্রের চাইতে জনমতের চিন্তা, চেতনা, ধ্যান, ধারনা ও জীবন দর্শনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। মুঘল আমলে ও উজির, নাজির, আমীর, ওমরাহ, পরামর্শক ছিলেন। বাহু বলে মহাশক্তিশালী নিরক্ষর মুঘল সম্রাট জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ আকবর এর-নবরত্ন সভা মুঘল ভারত নয় সমগ্র ভারত বর্ষের ইতিহাসে ঐতিহাসিক সংযোজন ও স্মরনীয় অধ্যায়।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও ক্রম বিবর্তনের ইতিহাসে আইনের অভ্যোদ্যয়-প্রচলন-আইনের শাসন ও একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। আধুনিক বিশ্বও বিশ্ব সমাজ একটি আইনগত মৌলিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। দেশীয় আইন ছাড়াও বিশ্ব সমাজের জন্য রয়েছে সম্মিলিত জাতি সংঘ-ইউ.এন.ও। জাতি সংঘের সদস্য ভূক্ত দেশ সমূহ জাতি সংঘের আইন কানুন মেনে চলতে হয়। রয়েছে আর্ন্তজাতিক আদালতও। জাতি সংঘ ছাড়াও রয়েছে সার্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-ই-ইউ- জাতীয় আঞ্চলিক সংস্থা সমূহ।
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সকল আইনের উৎস ও আঁধার। বাংলাদেশের সংবিধান পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্র সমূহের লিখিত সংবিধান সমূহের মধ্যে একটি উৎকৃষ্ট মানবিক দলিল। বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের কথা বলা আছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের চেয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার অধিকতর জবাবদিহিতা মূলক। সংসদ নেতা সংসদের কাছে, সাংসদগণ জনগনের কাছে দায়বদ্ধ। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ভারত, জাপান, বৃটেন, কানাডা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ডায়েট নামে পরিচিত জাপানের পার্লামেন্ট জাপানের প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্রের মাঝেও শক্তিশালী সংস্থা। ঠিক তেমনি বৃটেনের -হাউস অব কমন্স- ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্র ও রানীর শাসনের মাঝেও ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান। ঠিক তেমনি আমেরিকান সিনেটারগণ সম্মানিত ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি। উপমহাদেশের মধ্যে পাকিস্তান সাত চল্লিশি স্বাধীনতার পর থেকে ডেমক্রেসি সেখানে লুটক্রেসি হয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মুখ দেখেন নি পাকিস্তানী জনগন। উচ্ছাভিলাসী আমলাতন্ত্র ক্ষমতা লিপ্সু সামরীক জান্টা গনতন্ত্রকে পদলিত করে গনতন্ত্রের পরিবর্তে ডান্ডা তন্ত্র চালু করেছেন। পাকিস্তানে গনতন্ত্র এখনও দুর হ্যায় সুখকা গাঁও।
আধুনিক কালে গনতন্ত্র নিয়ে গবেষনা-পর্য্যালোচনা করছেন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তক, পন্ডিত ও গবেষক গন। গনতন্ত্রকে সংক্ষেপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ঋড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব বলে। জনগনের জন্যই জনগনের দ্বারা। গনতন্ত্র-একজন নাগরিক এর চিন্তা চেতনা, জীবনদর্শন, সদিচ্ছা ও ভাবনানুভূতির বহি: প্রকাশ। গনতন্ত্র মানে হোন্ডা-গুন্ডা-কেন্দ্র দখল কিংবা সীল মারো ভাই সিল মারো-জাতীয় নির্লজ্য মহোৎসব নয়। ডেমোক্রেসী ও ইলেক্ট্রক্রেসি এক জিনিষ নয়। গণতন্ত্রে, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল বিকল্প সরকার- ছায়া সরকার। কোন কারনে সংসদ নেতা সংসদে সংখ্যা গরিষ্টতা হারালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিরোধী দলের নেতাকে সংখ্যা গরিষ্টতা প্রদর্শন ও প্রমান পূর্বক সরকার গঠনের আহ্বান করতে পারেন। বর্তমানে আমাদের দেশে ভাগাভাগি ও বাটাবাটির সংসদে কথিত বিরোধী দল আছেন, বিরোধী দলের নেতাও আছেন, কিন্তু তা প্রকৃত পক্ষে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার মূল চেতনা ও সংস্কৃতির পরিপন্থি। গণতন্ত্রে পরমতের প্রতি সহিষ্ণতা প্রদর্শন প্রসঙ্গেঁ সর্বকালের সেরা দার্শনিক ভুল্টেয়ার এর ঐতিহাসিক উক্তি “আমি আপনার মতের সঙ্গেঁ একমত না হতে পারি, কিন্তু আপনার মত প্রকাশে আমার জানটা দিতে পারি” একান্ত প্রাসঙ্গিঁক। গণতান্ত্রীক সমাজ প্রতিষ্টায় পাকিস্তানী আমলে গণতন্ত্রের মানষপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাষানী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং বঙ্গঁ শার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, শেখ মুজিব বাঁঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আপোষহীন একচ্ছত্র নেতা হয়েছেন, বঙ্গঁবন্ধু হয়ে স্বাধীনতার মহান স্থপতি হয়েছেন, কিন্তু পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্টিত হয়নি।
উনিশশ সত্তোর সালে পাকি¯দানের প্রথম ও শেষ সাধারন নির্বাচনকে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব ছয় দফার রেফারেন্ডাম হিসাবে ঘোষনা দিলে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীগণ বিপুল ভোটে জয় লাভ নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করলেও জাতির নির্বাচিত নেতা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্থান্তর করেন নি পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খাঁন বরং পচিশে মার্চ বাংলা ও বাঙ্গাঁলির বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষনা করে হত্যা, ধর্ষন, লুন্টনে মেতে উঠেন। শুরু হয় বাংলা ও বাঙ্গাঁলির মুক্তির সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম।
গণতন্ত্র ও সুশাসন ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। দূঃখ ও দূর্ভাগ্য জনক ভাবে স্বাধীনতার অর্ধশত বৎসরের দ্বারপ্রান্তে এসেও শহীদানের স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হয়নি। গণতন্ত্র এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সুশাসন নিশ্চিত নয়। ঘুষ, দূর্নীতি, বানিজ্যায়ন, দূবৃত্তায়ন, ভ্রষ্টাচার ও কেসিনো কালচারের জোয়ারে জাতি লজ্জিত। বিব্রত। জন আকাংখা ও সকল শহীদানের স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নে প্রতিরোধের এখনই সময়।
[লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা। সাংবাদিক। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।]
মন্তব্য করুন