“গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও বৈসম্যহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের আজীবন লড়াকু সৈনিক, স্বাধীনতার সংগঠক বাবু শশাংক শেখর ঘোষঃ সম্মান ও স্মরণ”
মুজিবুর রহমান মুজিব:-‘গণতন্ত্রকে’ সংক্ষেপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে- ফরদি, বাইদি, অফদিপিপুল হিসাবে। গণতন্ত্র মানে শতফুল সহস্রফুল। মানুষের চিন্তা চেতনার, ধ্যান ধারনা, আশা-আকাংখার বহিঃ প্রকাশ-ই হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার, ন্যায্য অধিকার। গণতন্ত্র মানে গুন্ডা-হুন্ডা দিয়ে কেন্দ্র দখল করতঃ শুধুমাত্র সিল মারো ভাই সিল মারো মার্কা সিল মারা উৎসব নয়। গণতন্ত্র মানে একদিনের সিল মারা মহা উৎসবও নয়। ‘ডেমোক্রেসী ইজ নট ইলেক্টক্রেসী’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্বেয় অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একদিনের সিলমারা উৎসবকে ডেমোক্রেসী না বলে- ‘ইলেক্ট্রক্রেসী’ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ডান্ডাতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমরতন্ত্র, গণতান্ত্রীক স্বৈরতন্ত্রের চাইতে গণতন্ত্র সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য শাসন পদ্ধতি। ভারত, জাপান, বৃটেন, কানাডা, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু আছে। দুঃখও দূর্ভাগ্যজনক ভাবে বাংলাদেশে এখন পর্য্যন্ত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নি। পূর্ণ গণতন্ত্র পরিপূর্ণ রূপে চর্চাও চালু হয় নি। সংসদীয় গণতন্ত্রে পরমত সাহিষ্ণুতা, পরমত এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন সংসদীয় সংস্কৃতির রীতিনীতি ও অংশ। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বিকল্প সরকার প্রধান। কোন কারনে সংসদ নেতা সংসদে সংখ্যাগরিষ্টতা হারালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংসদে বিরোধী দলীয় নেতাকে সংখ্যা গরিষ্টতা প্রমাণ পূর্বক সরকার গঠনের আহ্বান করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে দূর্ভাগ্য জনক ভাবে সংসদে বিরোধী দল গৃহ পালিত বিরোধী দল হিসাবে কুখাতী অর্জন করে। সামরীক স্বৈর শাসক লে.জে.এইচ.এম.এর্শাদ অবঃ এর পতনের পর বিরোধীদলীয় নেতাকেও আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। বর্তমান সরকারে বিরোধী দলের একাধিক মন্ত্রী রয়েছেন। সংসদে বিরোধী দল জাপা প্রধান পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর বিশেষ দূত এর দায়িত্বে আছেন।
জেনারেল (অব:) এর্শাদ পতœী, জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান দশম জাতীয় সংসদে বর্ণিত বিরোধী দলীয় নেতা। দশম সংসদ প্রাণবন্ত ছিল না, পরিপূর্ণ অকার্য্যকর না হলেও নিস্প্রান ছিল।
বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম রওশন এর্শাদ সংসদ নেত্রী মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে সখেদে ক্ষোভ প্রকাশ ও আফসোস করতঃ বলে ছিলেন জানতে চেয়ে ছিলেন তিনি কি সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলীয় নেতা? বেগম রওশন এর্শাদ এর এই আফসোস আহাজারিও বিলাপে দেশ ব্যাপী হাস্যরশ ওপরিহাসের ঝড় উঠে। দেশের খ্যাতনামা কলামিষ্টগণ এই নিয়ে মূল্যবান কলাম লিখেন। মহান স্বাথীনতার সাত চল্লিশ বৎসর পরও দশম সংসদ পর্যন্ত দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পরিপূর্ণ রূপে চালু হয়নি, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নি। এটা নিতান্তই দূঃখও দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার।
অথছ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র ও আইনের শাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সুশাসন ও বৈষম্যহীন সুখী সমৃদ্ধ শালী গণতান্ত্রিক সমাজ। সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনকে আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফার রেফারেন্ডাম হিসাবে ঘোষনা করলে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করেন। তৎকালীন পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেঃ এ.এম.ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্থর না করে আলোচনার নামে টাল বাহানা করতঃ সময় কর্তন করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তাানে সৈন্য সমাবেশ করতঃ একাত্তরের পঁচিশে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট এর নামে বাংলাদেশে গণহত্যা লুন্ঠন, ধর্ষন শুরু করেন। বীর বাঙ্গালী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনেন। পাক সামরীক স্বৈর শাসক ও জান্টাদের বিরুদ্ধে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে উনসত্তর সালের ছাত্র গণ অভ্যাত্থান পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন বাংলাদেশের বীর বাঙ্গালী। ঐতিহ্যবাহী রাজনগর উপজেলাধীন বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক আপোষহীন নাম বাবু শশাংক শেখর ঘোষ। বানিজ্যায়ন দুবৃত্তায়ন নয় প্রাপ্তি যুগের কোন প্রত্যাশা নয় স্বদেশ প্রেমও স্বাদেশিকতায় উদ্ভোদ্ধ হয়ে দেশও জাতিকে সেবা-দেবার মানষে আজীবন অপোষহীন ভাবে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বর্তমান প্রজন্ম হয়ত শুধুমাত্র তার নাম শুনে থাকতে পারেন। হয়ত অনেক নবীন তাঁর নাম ও শুনেন নি। বৃহত্তর সিলেটের দক্ষিনাঞ্চলে সেকাল থেকে এ কাল পর্যন্ত শশাংক শেখর ঘোষের পূর্ব ও উত্তর সুরীদের মধ্যে পূণেন্দ্র কিশোর সেনগুপ্ত, সুহাসিনীদাস সৈয়দ আকমল হোসেন, নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী, লীলানাগ, নবাব আলী সফদর খান রাজা
সাহেব, তারা মিয়া, শ্রমিক নেতা মকিজ আলী, রাধিকা মোহন গোস্বামী, সূর্য্যমনি দেব, রাশেন্দ্র কুমার দত্ত, আবু কায়সার খান, সৈয়দ মতিউর রহমান প্রমুখ রাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূর্য্য সৈনিক গণ স্বস্ব সময়ে নির্লোভ নির্মোহে আন্দোলনে সংগ্রামে নিবেদিত থেকে স্বস্ব দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তারা ক্ষমতাসীন রাজনীতি ও আধুনিক উন্নয়ন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে তাদের নামে কোন নাম ফলক নেই। কবি যথার্থই বলেছেন শিল্পী যথার্যই গেয়েছেন “কাগজে নয়, পাথরে নয়, হৃদয়ে লিখ নাম, সে নাম থেকে যাবে”। বামপ্রগতি শীল রাজনীতিবিদ স্বাধীনতার সংগঠক বাবু শশাংক শেখর ঘোষ তার মেধাও মনন, প্রজ্ঞ্যাও পান্ডিত্য অতুলনীয় দেশ প্রেম মারফত জনগনের হৃদয়ে তার নাম লিখেছেন, যদিও তার নাামে কোন নামকলক নেই। ঐতিহ্যবাহী রাজনগর উপজেলাধীন মুন্সিবাজার এলাকাটি একটি রাজনৈতিক ইতিহাস ঐতিহ্য সচেতন এলাকা। মুন্সীবাজার এলাকার সচেতন নাগরিক সমাজ সম্প্রতি শশাংক শেখর ঘোষ এর সম্মানও স্মরণে শশাংক শেখর ঘোষ স্মৃতি সংসদ গঠন করে মুন্সীয়ানারে পরিচয় দিয়েছেন। স্বর্গীয় শশাংক শেখর ঘোষ এর ছবি সম্বলিত একটি প্রচার পত্র আমার বাসায় প্রাপ্ত হই। প্রচার পত্রে দুটি মোবাইল নাম্বার থাকলেও স্মৃতি সংসদ কর্মকর্তা বা কোন উদ্যোক্তার নাম ছিল না। একজন অদেখা হয়ত অচেনা সূহৃদ মোবাইল মারফত এতদ্ সংক্রান্ত একটি রচনা চাইলেন। এই নিয়ে মত বিনিময় করি বিশিষ্ট আইন জীবি মানবধিকার সংঘটক চীর কিশোর-কিশোরী পদ দেব শ্যামল এর সঙ্গে। কিছু তথ্য অবহিত হই।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকও কলামিষ্ট হিসাবে আমি স্বর্গীয় শশাংক শেখর ঘোষ প্রসঙ্গে কথায় কথায় অবহিত হই স্বর্গীয় ঘোষের সুযোগ্য ভ্রাতস্পু বাম প্রগতিশীল গনতান্ত্রিক আন্দোলনের বলিষ্ট ব্যক্তিত্ব, গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট শান্তিপদ ঘোষ মতি বাবুর নিকট থেকে। সিনিয়র আইন জীবি ভ্রাতৃপ্রতীম শান্তিপদ ঘোষ তার পরিবার সদস্য হিসাবে ত্যাগী রাজনীতিবিদ শশাংক শেখর ঘোষকে কাছে থেকে দেখেছেন, শিখেছেন, অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ঐতিহ্যবাহী রাজনগর এলাকায় বাম প্রগতিশীল রাজনীতির আরো দুটি শ্র্রদ্বেয় নাম অগ্নিযুগের অগ্নি কন্যা লীলা নাগ এবং কমরেড তারা মিয়া। লীলানাগ বৃটিশ ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনে বলিষ্ট ভূমিকা রেখে ছিলেন। ঢাকাস্থ জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তারা মিয়া বৃহত্তর সিলেটের বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের উজ্জল ধ্রুব তারা ছিলেন। তার কন্যা, পুত্রগণ উচ্চ শিক্ষিত এবং কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত।
জ্ঞান তাপস ও পন্ডিত ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলতেন যে জাতি বীরের মর্যাদা দেয় না সে দেশে বীরের জন্ম হয় না। জ্ঞানী-গুনী জাতীয় বীরকে সম্মান দেয়া প্রকারান্তরে নিজেরাই সম্মানিত হওয়ার নামান্তর। ঐতিহ্যবাহী রাজনগর উপজেলাধীন মুন্সিবাজার এলাকার বর্তমান প্রজন্ম প্রয়াত রাজনীতিবিদ বাবু শশাংক শেখর ঘোষ এর সম্মান ও স্মরণে স্মৃতি সংসদ গঠন, স্বগীয় ঘোষ এর কর্ম ও জীবন দর্শন এবং এতদ্ সংক্রান্ত স্মারক সংকলন প্রকাশ এর উদ্যোগ নিঃসন্দেহেই প্রশংসীয়। উদ্যোক্তাগণকে স্বাগত শুভেচ্ছা ও সাধুবাদ জানাই।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বাবু শশাংক শেখর ঘোষ এর রাজনৈতিক মত পথ এর দল ও দর্শনের সমর্থক নই, কিন্তু আমি তাঁর দেশ প্রেমও ত্যাগ তিতিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি তাঁর মত পথ এর সমর্থক ছিলাম না, নই ও কিন্তু আমি তাঁর একজন অনুরাগি ও শুভাকাংখী। পর মত প্রসঙ্গেঁ বিশ্ব বিখ্যাত “দার্শনিক ভলতেয়ার যথার্থই বলেছিলেন আমি আপনার মতের সঙ্গেঁ এক মত না হতে পারি, কিন্তু আপনার মত প্রকাশের জন্য আমার জানটা দিতে পারি।”
দার্শনিক ভলতেয়ার পরমত প্রকাশে তাঁর জান দানের কথা ঘোষ না দিয়ে ছিলেন সেই কবে, এই অত্যাধুনিক জমানায় পরমত প্রকাশে আমরা আমাদের প্রাণ না দিতে পারি সমর্থন ও সম্মান দিতে পারি। স্বর্গীয় শশাংক শেখর ঘোষ এর উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তিও সদগাত কামনা করছি।
[ষাটের দশকের সাংবাদিক, কলামিষ্ট, মুক্তি যোদ্ধা এডভোকেট হাই কোর্ট জজ কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসকøাব]
মন্তব্য করুন