চলতি মৌসুমে চা উৎপাদনে রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে
প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ॥ বাংলাদেশ অন্যতম অর্থকরী ফসল চা চলতি মৌসুমে উৎপাদনে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে বসেছে । ২০১৫ সালে দেশে চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। ওই বছর দেশে ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে সেই রেকর্ড এবার ভাঙতে বসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আগের মতোই চা রপ্তানি সম্ভব। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বেড়েছিল আমদানি নির্ভরতা। অনুকূল আবহাওয়া ও নতুন কিছু উদ্যোগের ফলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে চা উৎপাদন।
শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের ৯২টি সহ বাংলাদেশের সবগুলো বাগান চা রপ্তানি করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, কুয়েত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চা রপ্তানি করে। দেশ প্রতি বছর অভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে ১.৩ মিলিয়ন পরিমাণ কেজি চা বিদেশে রপ্তানি করে। এক দশক আগে নানা জটিলতায় চায়ের উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। দেশীয় বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির কারনে ওই সময়ে রপ্তানির পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে বিদেশ থেকে চা আমদানি করতে হয়েছে। প্রতিকুল পরিবেশ, সমস্যা সত্ত্বেও কয়েক বছর ধরে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনেরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ রেকর্ড ১৬২ বছরের উৎপাদনকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
চা বোর্ডের শ্রীমঙ্গলস্থ প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট ইউনিট এর পরিচালক মঈন উদ্দীন বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। তবে আরও এক মাস সময় অতিবাহিত হলেও এর সম্পূর্ণ হিসাব পাওয়া যায়নি। চা বাগান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ন্যাশনাল টি কোম্পানী (এনটিসি), ডানকান ব্রাদার্স, ফিনলেসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন চা বাগানগুলোতেও এই সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়েছে। তাদের ধারণা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উৎপাদনের সাথে এক মাসে সবগুলো বাগানের উৎপাদন যুক্ত করলে বছরের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে। দেশের ১৬২ বছরের বাণিজ্যিক চা উৎপাদনের সব রেকর্ড ভেঙে এবার দেশে চায়ের উৎপাদন ৭০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন চা শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। মৌসুম শেষে তাই চা উৎপাদনে সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টির ধারণা ক্রমেই বাস্তব রূপ লাভ করছে। বছরের শেষ পর্যন্ত চা উৎপাদনের এ ধারা ঠিক থাকলে তা হবে ১৬২ বছরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড।
চা বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৫ সালে দেশে চা উৎপাদন হয় ৬ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার কেজি। কিন্তু ২০০৬ সালে উৎপাদন ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার কেজিতে নেমে আসে। পরবর্তী বছর থেকে উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। ২০০৭ সালে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার কেজি, ২০০৮ সালে ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার, ২০০৯ সালে ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার, ২০১০ সালে ৬ কোটি ৪ লাখ, ২০১২ সালে ৬ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৩ সালে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। তবে ২০১৪ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার কেজি হলেও ২০১৫ সালে তা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে দেশের বাগানগুলোয় ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়, যা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে। আর চা বাগান সংশ্লিষ্টদের মতে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ২০১৫ সালের উৎপাদনকেও হার মানাবে।
এদিকে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে চা রফতানি হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩ কোটি ৪০ লাখ কেজি। এর পর ধারাবাহিকভাবে কমেছে রফতানি। সর্বশেষ ২০১১ সালে রফতানি ২০ লাখ কেজির নিচে নেমে আসে। ২০১৪ সালে রফতানি হয় সর্বনিম্ন ১৩ লাখ কেজি।
দেশে ১৬৬টি মূল চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯০টি। এছাড়া হবিগঞ্জে ২৩, সিলেটে ২০, চট্টগ্রামে ২২, রাঙামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি করে ও পঞ্চগড়ে নয়টি চা বাগান রয়েছে। ছোট পরিসরের চা চাষসহ দেশে চা বাগানের মোট ভূমি ১ লাখ ১৬ হাজার ২১৯ হেক্টর। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ অর্থাত্ ৫৮ হাজার ৭১৮ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় রয়েছে। চা বাগানের নামে বন্দোবস্তকৃত ৩৯ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে রাবার, বাঁশ, ধান, কাঁঠাল, লেবুসহ বিবিধ ফলের চাষ, পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত বনায়ন রয়েছে।
ন্যাশনাল টি কোম্পানী (এনটিসি) এর ডিজিএম শাহজাহান বলেন, আবহাওয়ার অনুকুল পরিবেশের কারনেই এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হয়েছে। অন্যান্য বছরের সেপ্টেম্বরে সচরাচর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় রেডস্পাইডারসহ চা গাছে রোগ ব্যাধী সৃষ্টি হয়। কিন্তু এবছর সেপ্টেম্বরেও বৃষ্টিপাত হওয়ায় চা বাগানে রোগের তেমন আক্রমন দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হলেও ইতিমধ্যে অক্টোবর মাসও ছাড়িয়ে গেছে। আর ডিসেম্বর পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন হবে। তাতে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন