চলে গেলেন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ও লেখক দ্বিজেন শর্মা : বড়লেখায় শোকের ছায়া
আবদুর রব॥ দেশের খ্যাতিমান জীব বিজ্ঞানী, প্রকৃতিবিদ ও বিজ্ঞান লেখক দ্বিজেন শর্মা আর নেই। শুক্রবার ভোরে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভোগছিলেন। দ্বীজেন শর্মার স্ত্রী ড: দেবী শর্মা ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের দর্শনের সাবেক অধ্যাপিকা। একমাত্র ছেলে ডা. সৌমিত্র শর্মা রাশিয়ায় চিকিৎসা পেশায় ও একমাত্র মেয়ে শ্রেয়শ্রী শর্মা ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে চাকুরীরত।
সঞ্চিতা শর্মা জানান, ২৩ আগস্ট বিকেলে তিনি সামান্য শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। সন্ধায় বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে স্বাস্থ্যের অবনতি হলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তাকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। প্রথমে সিসিইউতে এবং পরে আইসিইউতে রেখে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন। শঞ্চিতা শর্মা বলেন, চাচার কথা তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান যেন বড়লেখায় কাঠালতলীর নিজ গ্রাম শিমুলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। বড়লেখায় তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বিজেন শর্মার মৃত্যুতে বড়লেখায় তার গ্রামের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জাতীয় সংসদের হুইপ শাহাব উদ্দিন এমপি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রখ্যাত নিঃস্বর্গবিদ, ২০১৫ সালে একুশে পদকসহ জাতীয়ভাবে বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কৃতি সন্তানকে হারিয়ে আমরা আজ শোকাহত। তিনি বাংলাদেশের এক অমূল্যসম্পদ। তিনি বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকলের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এছাড়াও শোক প্রকাশ করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরী, বড়লেখা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজ উদ্দিন, প্রেসক্লাব সভাপতি অসিত রঞ্জন দাস, সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোপাল দত্ত, সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও যুগান্তরের সাংবাদিক আব্দুর রব।
দ্বিজেন শর্মা ১৯২৯ সালের ২৯ মে সিলেট বিভাগের (তৎকালীন) বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ভিষক চন্দ্রকা শর্মা এবং মাতার নাম মগ্নময়ী দেবী। বাবা ভিষক বা গ্রাম্যভাষায় কবিরাজ ছিলেন। আর মা সমাজসেবী। শৈশবে পাথারিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক, আর সেখান থেকেই হয়তো গাছপালার প্রতি তার অসীম ভালোবাসা জন্মে। “কবিরাজ বাড়ি” বলে বাড়ির বাগানেই অজস্র গাছগাছালি ছিল, তাঁর মাঝে ছিল স্বর্ণচাঁপা, কনকচাঁপা, মধুমালতীসহ নানা রঙবেরঙের ফুল। সেসময়ই মনের অজান্তে দ্বিজেন শর্মাও প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন।
শৈশবেই গ্রামের পাঠশালায় তাঁর হাতেখড়ি। তিঁনি করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। যদিও মায়ের ইচ্ছে ছিল তিনি বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। কিন্তু প্রকৃতিপ্রেম তাঁকে উদ্ভিদবিদ হতে আকৃষ্ট করে। আর তাই কলকাতা সিটি কলেজে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (১৯৫৮) ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৮ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন দ্বিজেন শর্মা। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তারপর শিক্ষকতা শুরু করেন ঢাকাস্থ নটরডেম কলেজে। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েট প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে চলে যান মস্কো। তিনি চল্লিশটিরও বেশি বই অনুবাদ করেছেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে অনুবাদ বন্ধ করার নির্দেশ পাওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সব সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল। কিন্তু ১৭ বছরের প্রবাস জীবনকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি।
বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ সংযোগের কারণে দ্বিজেন শর্মার কিছুকাল আত্মগোপন, এমনকি কারাবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যাকে তিনি দুর্লভ সৌভাগ্য মনে করেন। ১৯৭০’র জলোচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সেবাকার্যে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। ১৯৬০ সালে বরিশালে দেবী চক্রবর্তীর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. দেবী শর্মা ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের দর্শনের সাবেক অধ্যাপিকা।
মন্তব্য করুন