চা বাগানের সবুজের বুকে পাখির মঞ্জিল, অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগান লেক
এহসান বিন মুজাহির: চায়ের রাজধানী হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সবুজের সমারোহে ঘেরা রাজঘাট চা বাাগান লেকে এখন অতিথিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখর। শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফিনলে টি কোম্পানির চা-বাগানের রাজঘাট লেকের জলাধারের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযাযী পাখির ওড়াউড়ি,দিনভর জলকেলি,খুনসুটি সে সঙ্গে কিচির-মিচির শব্দ, কখনো ঝাঁক বেঁধে নান্দনিক কসরতে ডানা মেলে নীল আকাশে ওড়োউড়ি। যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লেকে ভিড় করছেন পাখিপ্রেমীরা।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অগণিত পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুগ্ধ ওই এলাকার বাসিন্দারা। স্থানীয়রা এ স্থানটিকে পাখির ‘মঞ্জিল’ বলে ডাকেন। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে চলা, খাবারের সন্ধানে লেকের এক পাশ থেকে আরেক পাশে অবাধ বিচরণ দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন পাখিপ্রেমীরা। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় উনিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাজঘাট লেক। চারপাশজুড়ে সবুজের সমারোহ আর উঁচু-নিচু টিলা থেকে লেকে পর্যন্ত নেমে এসেছে সবুজ সারি সারি চা বাগান। মাঝখানের সমতলে এই প্রাকৃতিক লেকের অবস্থান। রাজঘাট লেকে অতিথি পাখির আনাগোনা বেড়েছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। প্রতি বছর শীত মৌসুমে লেকটি যেন হয়ে যায় পাখির আবাসস্থল। এবারো এ লেকে বাসা বেঁধেছে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখিসহ হাজারো অতিথি পাখি। ফলে লেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাখিপ্রেমীদের আনাগোনা বাড়ছে। সরজমিন ঘুরে রাজঘাট ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, শীতকাল এলেই এই রাজঘাট লেকটি অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। চা বাগানের এ লেকটি অতিথি পাখির কারণে ইতোমধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। পাখির বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, উড়ে চলা, নীরবে বসে থাকা মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাই দূরদূরান্ত থেকে লোকজন একনজর পাখি দেখার জন্য এখানে আসেন। চলমান এ রাস্তার লোকজন গাড়ি থামিয়ে অথবা পায়ে চলার পথে এখানে একদ- দাঁড়াতে বাধ্য হন। প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় জমান এখানে। উপভোগ করেন মনোরম দৃশ্য। লেকর পাখির মেলা থাকে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। দল বেঁধে যখন পাখিগুলো আকাশে ওড়ে, তার সাথে যেন উড়ে চলে মনও। পুরো এলাকাটিই সরব করে রাখে এই পাখপাখালি। পাখিদের এই মিছিলে আছে পানকৌড়ি, লালচে বক, দেশীয় বক রাজ সরালি, কালো লেজ জৌরালিসহ নানা পরিযায়ী পাখিসহ নাম না জানা অগণিত অতিথি পাখি। সরেজমিন রবিবার ২৪ ডিসেম্বর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফিনলে চা কোম্পানির রাজঘাট চা বাগানের ৯, ১০ ও ১১ নং সেকশনের টিলায় চারদিকে সবুজ চায়ের বাগান। তিন টিলার মধ্যখানে প্রাকৃতিকভাবেই প্রায় ১০ একর আয়তনের একটি লেক। অবারিত সবুজের সমারোহে ঘেরা স্বচ্ছ জলের বুকে ঝাঁক বেঁধে ডানা মেলছে অতিথি পাখির দল। উড়ে চলা পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত চারপাশ।
লেকে দেখা হয় বর্মাছাড়া চা বাগান এলাকার উজ্জ্বল পটনায়েক এর সাথে। তার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, রাজঘাট চা বাগান শীতকালে নীল আকাশে উড়ে বেড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। পরিযায়ী এসব পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখর পুরো এলাকা। এখানে পাখিদের আনন্দে মেতে উঠার সৌন্দর্য খুব কাছে থেকে দেখা যায়।
রাজঘাট চা বাগান এলাকার বাসিন্দা চা শ্রমিক গোপাল বুনার্জি (৫৫) বলেন ৩৫ বছর ধরে এই বাগানে বাস করছি। প্রায় এক যুগ থেকে দেখছি এই চা বাগানের লেকে হাজার হাজার পাখি আসে। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত এই লেকে পাখি ওড়াুড়ি করে। আর পাখি দেখতে প্রচুর মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন।
শীত ছাড়াও বছরের অন্য মৌসুমেও রাজঘাট লেকে পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে বলে জানালেন চা শ্রমিক মন্টু দেবনাথ। তিনি বলেন এ লেকে যখন শাপলা ফুল ফুটে খন আরও সৌন্দর্য বাড়ায়।
লেকে পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ ও নীল আকাশে ওড়াউড়ির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা পর্যটক ফাহমিদা রুমা বলেন, গত দুইদিন থেকে শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করছি। ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে এসেছি। চা বাগান, বাইক্কা বিল এবং রাজঘাট চা বাগান লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আজ এতো সুন্দর এ লেকে হাজারো অতিথি পাখি দেখে মুগ্ধ হলাম।
শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা আফজল হোসেন নাামের এক ভার্সিটির শিক্ষার্থী বলেন, চারদিকে সবুজ চা বাগান, উচুঁ নিচু টিলায় ঘেরার সমতলে স্বচ্ছ লেকের অসাধারণ সৌন্দর্যে মোহিত। রাজঘাট চা বাগানের এ পরিবেশ যেকোন প্রকৃতি প্রেমিকে মুগ্ধ করবেই। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রজাতির অগণাত পাখির ওড়াউড়ির দৃশ্য দেখে যারপরনাই ভাল্লাগছে। লেকে দেখা হয় সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইবাদ আকরামের সাথে। তিনি বলেন, পাখি দেখতে এই লেকে এসেছি। সবুজের বুকে পাখির বিচরণ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারপাশের চিত্র দেখে খুবই ভালো লাগলো। বারবার এখানে আসবো।
সিন্দুরখান ইউনিয়নের কুঞ্জবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ একরামুল কবীর জানান, শীত মৌসুম এলেই পাখিগুলো যে কোথা থেকে আসে তা জানি না। তবে প্রচুর পাখি আসে এই লেকে, যা পাখিপ্রেমীদের মুুগ্ধ করে।
আশিদ্রোন ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফিনলে টি কোম্পানির চা-বাগানের রাজঘাট লেকের জলাধারের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির ওড়াউড়ি। পুরো লেকেই যেনো বসেছে অতিথি পাখির মেলা। লেকের চারপাশজুড়ে রয়েছে টিলায় টিলায় সবুজ চায়ের বাগান। আর মধ্যখানের সমতলে এই লেক।
শ্রীমঙ্গল চৌমুহনা থেকে রাজঘাট বাগানের দূরত্ব প্রায় ১৯ কিলোমিটার। শ্রীমঙ্গল শহরের কালিঘাট রোড কিংবা সিন্দুরখান রোড ২টি রাস্তা হয়েই রাজঘাট লেকে যাওয়া যায়। মিশুক, টেম্পো বা জিপ করে গেলে মাত্র ৩০ মিনিট সময় লাগতে পারে।
পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে প্রতিবছর প্রচুর পাখি দেখা গেলেও এবার এর সংখ্যা কমেছে। বাইক্কা বিলের সেই পাখিগুলো নিরাপদ স্থান মনে করে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। রাজঘাট লেক এর অন্যতম। এখানে অনেক ধরনের পরিযায়ী পাখি রয়েছে। খুব কাছ থেকে এদের ছবি নেওয়া যায়। এখানে সারাদিনই পাখির কলকাকলিতে মুখর করে থাকে। রাজঘাট লেকে পরিযায়ী পাখিগুলো যেন নিরাপদে থাকতে পারে, সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানালেন রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিজয় ব্যানার্জি।
মন্তব্য করুন