চা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল বাজেট প্রত্যাশা পরিকল্পনা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

May 31, 2017,

মোঃ সিরাজুল ইসলাম॥ এবারের বাজেট হউক চা শিল্প বান্দব। সরকারের পলিসি সাপোর্ট,সাবসিডি প্রদান, সরকারী-বেসরকারী ও চা কোম্পানীর নিয়মাবলির রিফর্ম সহ চা বাগান, মালিক, চা কোম্পানী চা শ্রমিক চা বাগান কর্মচারী ও সরকার এর যৌথ উদ্যোগে ডিজিটাল যুগে লাগসই ও টেকসই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলে যা ঘটবে বলা যায়, ‘‘বাংলাদেশের চা বাগান নাচবে, মালিক বাঁচবে, শ্রমিক হাসবে, উন্নত ও গর্বিত হবে চা শিল্প’’। ‘‘চা’’ এর বোটানিকেল নাম ‘‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিস’’, চীন দেশে আবিস্কৃত। ১৮৫৪ সালে বৃটিশ ভারতে (বর্তমান সিলেট) প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মালনীছড়া চা বাগান। লিকার, ফ্লেভার স্ট্রেংথ ব্রিক্সনেছ ও ইনফিউশান এই পঞ্চামৃত থেকে প্রাপ্ত ক্যাফেইন হল চা পানএর মূল আধার। জীবনে চা, জীবনান্তে চা, জনমে চা, মরনে চা, আথিথেয়ত্তায় চা,বিবাহে চা, সভা-সমিতিতে চা, আনন্দে চা, বিরহে চা, বন্ধুত্তে চা, ভালবাসায় চা, যা পান করলে চনমনে হয় দেহ মন। রং চা/লিকার চা পান করলে শরীর মোটিয়ে যেতে দেয় না, হৃদপিন্ডকে সচল রাখে, রক্ত সঞ্চালনে সহায়ক, ক্যানসার রোগের প্রতিষেধক চা জীবনে রাখি বন্ধনের সর্বোৎকৃষ্ট উপাচার। আর চা যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক অর্থ আনয়নকারী ফসল তা তো দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসায় ও বানিজ্যে স্বীকৃত। এই চা তৈরীতে সরকার, ভূমি, চা বাগান মালিক, চা কোম্পানী, চা শ্রমিক, চা কর্মচারী, কোটি কোটি টাকা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, মিল-কারখানা, নাগরিক অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন বিষয়াদী যারা নিশ্চিত করেন তারা হচ্ছেন সরকার, বানিজ্য মন্ত্রনালয়সহ, বিভিন্ন সংস্থা, চা বাগান মালিক এবং চা কোম্পানী। উদ্দিপনা ও সহযোগীতায় বাংলাদেশ চা বোর্ড চা শ্রমিক ইউনিয়ন, ষ্টাফ এসোসিয়েশন, বিসিএস ও বিটিএ। বি.টি.আর.আই এবং পি.ডি.ইউ এতদসহ প্রাত:স্বরনীয় কারন তারা টি বোর্ড কর্তৃক গবেষনা ও মনিটরিং এ নিয়োজিত।
চা বাগান মালিক/চা কোম্পানী, যারা চা বাগান ক্রয় করেন, লীজ নেন, পরিচালনা করেন তারা সবাই ভি আই পি। সমাজে, উপজেলায়, জেলায়, বিভাগে, ব্যবসায়, রাজনীতিতে, সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদ ও বিভাগে, সংসদে দেশে এবং বিদেশে তারা সম্মানীয়। তারা নামী-দামী, দানবীর, কর্মবীর চাকুরী দাতা ও কমসংস্থান প্রতিষ্ঠাতা, অর্থবান, সম্পদশালী জ্ঞানী ও গুণীজন। চা শিল্প পরিচালনায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচে, সরকারী সহায়তা, সাবসিডি তারা পাইতেই পারেন। তাদের কল্যানে বর্তমানে বাংলাদেশে চা বাগান এর সংখ্যা ১৬৯ টি। এছাড়াও  উত্তর বঙ্গেঁ বেশ কটি ছোট-বড়, মাঝারী সাইজের নতুন চা বাগান সৃজিত হয়েছে।

Statistics on Bangladesh Tea Industry ২০১৫ এ প্রকাশিত রিপোর্টে
বাংলাদেশে মোট চা জনগোষ্টির সংখ্যা                                 : ৪,১৫,৬২২ জন          ২০১৪ সনে
বাংলাদেশে রেজিষ্টার্ড চা শ্রমিক সংখ্যা                                 : ১,০০,৮৪৩ জন                 ’’
বাংলাদেশে ষ্টাফ/কর্মচারীর সংখ্যা                                         : ২,৮৯১ জন                       ’’
বাংলাদেশে চা বাগান ম্যানেজার/সহকারী ম্যানেজার          : ৪৫৮  জন                          ’’
চা শ্রমিক/কর্মচারীদের বাসস্থান সংখ্যা                                  : ৬৮,৫৪৪ টি                      ’’
হ্যান্ড/সারফেস/ ডীপ টিউবওয়েল সংখ্যা                              : ১৪,২৩০ টি                        ’’
হাসপাতাল/ ডিসপেনসারি সংখ্যা                                           : ২১৪ টি                               ’’
ক্রেট হাউজ সংখ্যা                                                                   : ২৭৮ টি                              ’’
স্কুল                                                                                            : ১০৫৪ টি                            ’’
ছাত্র/ছাত্রী                                                                                : ৩৫,৫৬২ জন                   ’’
শিক্ষক                                                                                      : ৬৭৮ জন                           ’’
মোট লীজ প্রদত্ত ভূমির পরিমান                                             : ১,১৫,৭০৮ হেক্টর              ’’
প্রকৃত পক্ষে চা চাষে ব্যবহৃত হয়েছে                                     : ৫৯,৬০৯ হেক্টর                 ’’

বাদ বাকীতে ঘর-বাড়ী, সড়ক, নদী, নালা, পুকুর, স্কুল, মসজিদ, মন্দির-মান্ডপ খেলার মাঠ, বাসা-বাড়ী, বাংলো, ফ্যাক্টরী, গাছ ও বাশ বাড়ী, ছন খলা, ফুল-ফলের বাগান, গোচারন ভূমি, ধানক্ষেত, সবজি বাগান, কবরস্থান, শ্বশান ইত্যাদি ছাড়াও আরো যে পরিমান ভূমি চা চাষের উপযুক্ত তাতে নতুন চা বাগান স্থাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রতি ইঞ্চি ভূমি চা চাষে লাগাতে হবে। ২০১৬ সালে সর্বমোট চা উৎপাদিত হয়েছে ৮৫ মিলিয়ন কেজি। ২০১৭ সালে টার্গেট ধরা হয়েছে ১১০ মিলিয়ন কেজি। হোম কনজাম্পশন হবে প্রায় ৮০ মিলিয়ন কেজি। বিদেশে রপ্তানী হতে পারে প্রায় ৩০ মিলিয়ন কেজি।
এই বিপুল পরিমান চা তৈরীতে যাদের ঘাম ও শ্রম নিবেদিত তারাই হল চা শ্রমিক তথা চা জনগোষ্টি। তাদের কথায় আসাযাক। ১৬৩ বছর পূর্বেই তাদেরকে ভারতের উড়ীষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, কর্নাটক, মাদ্রাজ, গুজরাট, আসাম, কুচবিহার, মনিপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বৃটিশ-ভারতের ইংরেজ সাহেবরা, হিন্দু জমিদার ও তাদের কর্মচারীরা বলে করে, ফুসলিয়ে এদেশের চা বাগানের জন্য শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে। তাদের বলা হত ‘‘চা বাগানে গাছ নড়ে তো টাকা পড়ে’’। বন বনাঞ্চলে, দিন দিনান্তে, তারা গায়ে গতরে খাটুনী খেটেছে। হাতুড়ি, শাবল, খুন্তে, কুড়াল আর দা কোদাল দিয়েই তারা পাহাড় কেটেছে। চা বাগান গড়েছে। রাস্তা-সড়ক, পুল-কালভার্ট, ঘর-বাড়ী বানিয়েছে। বাঘ-ভালুক, বন্য প্রাণী তাদেরে আক্রমন করলে, তীর-ধনুক আর হস্তে ধারনকৃত কাজের হাতিয়ার দিয়েই তারা আত্মরক্ষা করতো। কিন্তু মারাত্মক  ছিল পাহাড়ী মশা, কালাজ্বর, সাপ-বিচ্ছু আর ঘা/মাংশপচা রোগ। ফলে অকালে অপরিনীত বয়সে মারা যাওয়া, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর এদের জীবন ইতিহাস বদলেদিতে মুক্তিদাতা প্রেরনাদাতা, দেব দূত হিসাবে যিনি ১৯৫৭-৫৮ সালে চা বোর্ডের প্রথম বাঙ্গালী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, তিনি হলেন ৭১ এর স্বাধীন বাংলাদেশের দ্রষ্টা ও ¯্রষ্টা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার দয়া ও নির্দেশে চা জনগোষ্টি আজ বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক। এদের অনেকই আজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস অফিসার, বিচারক, চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ জানা অজানা অনেক কিছুই হয়েছেন এবং আরো হবেন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এবং আওয়ামীলীগ এর প্রতি যাদের আজন্ম লালিত বিশ্বাস। নৌকা তাদের ধ্যান ও জ্ঞান। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশনেতৃ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাদের মাথার মুকুট হৃদয়ের ধন, মানিক-রতন, যারা আওয়ামীলীগ এর কথিত ভোট ব্যাংক তাদের জীবন-মরন, চাল-চলন, বর্ধিত বেতন-ভাতা, আয়-রোজগার, থাকা-খাওয়া, স্থায়ী বাস্তুভিটা, বসত বাড়ী, বাচামরা,শীত-গ্রীষ্ম, বর্ষায় জীবন ধারনের সহায়তা, লেখা-পড়া, শিক্ষা, চাকুরী, কর্মসংস্থান বর্তমান গদীনশীন আওয়ামীলীগ সরকারের দায়ীত্বেইতো বেশী বর্তায়। তাই সংগত কারনেই বলা যায়, এখনি সময়, চা শ্রমিকের দিন বদলাবার। এবারের বাজেট হোক চা শ্রমিকের দিন বদলের হাতিয়ার।

চা শ্রমিকের হাহাকার, হতাশা, বদলের জন্য বেশী কিছুর যে প্রয়োজন আসলে তা কিছু নয়। সামগ্রীকভাবে বলা যায়, যেগুলো প্রাথমিক, জরুরীভাবে প্রাসঙ্গিক:- বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-১৩ পুরাপুরি বাস্তবায়ন। দেশের আর্থসামাজিক বাজার ও দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চা শ্রমিকের জন্য নূন্যতম মজুরী/বেতন/ভাতা নির্ধারন। মাতৃত্ব কল্যান বেতন/ভাতা নিশ্চিত করন। শ্রমিকের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থায়ী বাসস্থান, অন্ন বস্ত্রসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরন। ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য শিক্ষা সামগ্রী, স্কুল ড্রেস, দুপুরে টিফিন বক্সসহ গরম খাদ্য সরবরাহ করন। ঔষধ, হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, মিডওয়াইফ, ড্রেসার, ধাই এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাগ্রহন। বিশেষ প্রয়োজনে উপজেলা-জেলা হাসপাতাল থেকে অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, গনকে ফ্রি ঔষধ সহ সরকারী খরচে ও ত্বত্তাবধানে সরকার কর্তৃক চা বাগানে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে প্রেরন করা জরুরী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। হাসপাতালে রোগীদের জন্য ডিম, দুধ, কলা, রুটি, চিড়া, মুড়ি, ভাত, মাছ ও মাংশ সরবরাহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ক্রেচ হাউজ প্রতিটি সেকশনে অথবা নিকটবর্তী দুরত্বে স্থাপন করতে হবে। এবং শিশুদের জন্য ডিম, দুধ, কলা, চিড়া, মুড়ি, গুড় সহ শিশুদের দেখভালের জন্য এটেনডেন্ট নিশ্চিত করা বিশেষ জরুরী। এসকল উপদান সংগ্রহের জন্য প্রতিটি হাসপাতালের জিম্মা ও দায়ীত্বে দুধের জন্য গাভী পালন, হাস-মুরগী পালনসহ পুকুরে মাছ চাষ, বাগানে সবজি চাষ করা যেতে পারে। সকল শ্রমিকের স্বাস্থ্য বছরে ১/২ বার মেডিকেল চেক আপ করানো দরকার। অল্প বয়সে বিবাহ এবং বহু বিবাহ বন্ধ করতে হবে। জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতিতে সঠিক পথ নিরুপন করতে হবে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় আনতেই হবে। মদ্য পান নিবারন করাতেই হবে। পরিবর্তে দুধ, রং চা, অথবা লিকার চা পানে উদ্বোদ্ধ করাতে হবে। সঞ্চয়ী হতে ট্রেনিং দিতে হবে এবং ঘরে ঘরে মাটির ব্যাংক সরবরাহ সহ সঞ্চয়ী হবার ও ব্যাংকে টাকা জমা রাখার বিধান শিখানো দরকার। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণনিয়ে গরীব শ্রমিকগন আরো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এনজিও ঋণে শ্রমিকদের নিরুৎসাহিত করা জরুরী। উল্লেখ্য যে উপরোক্ত এবং পরবর্তী পর্যায়ে উল্লেখিত চাহিদা গুলো শুধু মাত্র চা বাগান মালিক ও কোম্পানীর উপর চাপীয়ে দিলে কোন দিনই পূরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না। এসকল বিষয়ে সরকারী পলিসি সাপোর্ট ও উপযুক্ত সাবসিডি প্রদান খুব জরুরী। এবারের বাজেটে এসব বিষয়ে বরাদ্ধ থাকবে বলে অনেকেই আশা করছে।

এছাড়াও শ্রমিক কর্মচারীগনের জন্য বাসা-বাড়ী তৈরী করনে লাখ লাখ, কোটি টাকা বাগান কর্তৃপক্ষের খরচ হচ্ছে। বাৎসরিক মেরামত সহ স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশে বাসস্থান, রান্নাঘর, বাথরুম, সেনিটারী সরঞ্জাম ব্যবহারে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এরপরও শ্রমিকগন নাগরিক অধিকার জনিত দাবীতে স্থায়ী বাসস্থান এর মালিক হচ্ছে না। এরা প্রায়শই বলে থাকে ‘‘আমরা নিজ দেশে পরবাসী’’ এজন্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে।  যেমন :- সরকারী ভূমি যখন লীজ দেয়া হয় তখন অন্যান্য শর্তগুলোর মধ্যে লীজকৃত ভূমির (আইনসংগত) সামান্য অংশে স্থায়ী এবং অবসর প্রাপ্ত শ্রমিকগনের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট মাপ-জরিপে কিছু ভূমি ব্যবহরের শর্ত যোগ করা যায় কি না এবং ভূমিহীন বিবেচনায় তাদের জন্য সরকার কর্তৃক পাকা/আধাপাকা গৃহ নির্মানে বরাদ্ধ, ভর্তুকী, অনুদান, সূদ বিহীন ঋণ দেয়া যায় কি না এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। অথবা লীজ প্রদত্ত ভূমির আশে পাশে (যেহেতু চা শ্রমিকগন এদেশের নাগরিক) এদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমি প্রদানে সরকারী খরচে ‘‘দেশী-বিদেশী সাহায্যে’’ ল্যান্ড একুইজিশান পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে কিছু স্থায়ী আবাসন এর ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে ব্যাপারেও সরকারের সম্মানীত দ্বায়ীত্বরত মহৎজনদের পরামর্শ ক্রমে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এমনটাই মনে করা হয়/ চা সেকশনে ঝড়, বৃষ্টিতে সূপেয় পানির জন্য, বিদ্যুতের জন্য, চিত্ত বিনোদনের জন্য, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এর জন্য, নিরাপদ আশ্রয় যা যা করা দরকার বাগান কর্তৃপক্ষ তা বেশির ভাগই করে দিয়েছেন, করছেন এবং করবেন। এখানেও সত্যিকার অর্থে সরকারী সাবসিডি/সাহায্য/ অনুদান এর ব্যবস্থা না থাকলে পূরোপুরি বাস্তবায়ন স্বপ্নই থেকে যাবে। কারন এসকল বিষয়ে চা বাগান মালকিদের লাভ-ক্ষতির বিষয়াদি নিরীক্ষায় নিয়ে থাকেন। রেশনের চাল, গম সরকারী মূল্যে বি সি এর মাধ্যমে ক্রয় করা হয় এবং বিনা মূল্যে শ্রমিকদের মধ্যে বিতরনে চা কোম্পানীর লক্ষ-কোটি টাকা ভর্তুকী দিতে হয়। এখানেও সরকারী অনুদান বিশেষ দরকার। সরকার ও বাগান মালিকদের যৌথ উদ্যোগে ২ ঈদে এবং ২ পূজায় চা বাগানের স্থায়ী-অস্থায়ী নির্ভরশীল শ্রমিকদের উন্নত মানের খাদ্য। প্রতি ঈদুল ফিতরে এবং দুর্গাপূজায় সকাল পুরুষকে লুঙ্গি/ধুতি এবং সকল মহিলাদের শাড়ি এবং প্রতি শীত মৌসুমে সকল চা জনগোষ্ঠিকে শীত বস্ত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোটি কোটি টাকার মেশিনারীজ তেল গ্যাস জ¦ালানী ক্রয়ে সরকারী সহায়তা বিশেষ দাবী রাখে। শ্রমিকদের মজুরী/ বেতন/ ভাতা নির্ধারনে মালিক পক্ষের সংগঠন বি সি এস এবং  শ্রমিক পক্ষের সংগঠন চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর চার্টার অব ডিমান্ড দাখিল ও আলোচনার ভিত্তিতে ভুমিকা রাখে এবং চুক্তি স্বাক্ষর করে। শ্রমিকগন দৈনিক নগদ যা পায় (বর্তমান ৮৫/- টাকা) বিভিন্ন খাতে তাদের তরে ব্যয় হয় দৈনিক আরো প্রায় দ্বিগুন। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে ২ বছরের স্থলে ৩/৪ বছর চুক্তি ছাড়াই চলে এবং ৩/৪ বছর পরে চুক্তি হলে পূর্বের মিছিং হওয়া ১/২ বছরের জন্য বকেয়া নির্ধারিত হয়। ফলে প্রতিটি বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া লাখ লাখ টাকা একবারে অথবা দুই বারে পরিশোধ করতে গিয়ে চা মালিক/ চা কোম্পানী হোচট খায়। ভেঙ্গে পড়ে। ব্যবসায় ক্ষতি গ্রস্থ হয় এমনকি ছোট বড় অনেক চা বাগান বন্ধ হয়ে পড়ে। এ বিষয়েও সরকারী তদারকি, অনুদান, ভর্তুকী, সাবসিডি অতিব প্রয়োজন। অথচ সঠিক সময়ে চুক্তি স্বাক্ষর করলে সমস্যাগুলো হতনা।

সরকারী বেসরকারী সংগঠন, চা বাগান মালিক, চা কোম্পানী, চা শ্রমিক সবাই জানেন যে বাংলাদেশে চা বাগান ব্যবসায় খুব একটা লাভ জনক নয়। বিরাট ভূমি নিয়ে ব্যবসা, মাটি-মানুষ, প্রকৃতি, জলবায়ু, কোটি কোটি টাকা খরচসহ মেশিনপত্র, মিল-কারখানা, জ্বালানীতেল, গ্যাস, গাড়ী, সেচ যন্ত্র বাংলো, সার, ঔষধ, ইউডি সাইড, পেষ্টি সাইড ক্রয়, নার্সারী তৈরী, চা-চারা, ছায়া এবং চারা উৎপাদন ও ক্রয়, গাছ রোপন, পরিবেশ সংরক্ষন ইত্যাদি বিষয়ে টি এষ্টেটের মালিক হওয়া বিরাট রাজকীয় সম্মানের ব্যাপার বিধায় চা বাগান চালিয়ে বড় বড় কোম্পানীগুলো কোন রকম টিকে আছে। অনেক দেশীয় মালিক নিজস্ব সম্পত্তি বিক্রি করেও ব্যর্থ হয়েছেন। অনেক বাগান সিক হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক চা বাগান বিক্রি/ মালিকানা হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে। এমন সব চা বাগানের মালিক/ কোম্পানীর সাথে সরকারের দায়ীত্বশীল উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বারংবার সভা-সমিতিতে বসা এবং সমস্যা সমাধানে বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহন বাঞ্ছনীয়। সরকার সহ সকলের বুঝা দরকার যে চাএর চারা গাছ রুপন করে ৪টি বৎসর বিনা লাভে শুধু যতœ আর খরছ করে যেতে হয়। ৫ম বর্ষে  অংশ প্রোডাকশন হতে পারে।

চা বাগান আইন নিয়ম রীতি মেনে চলে এবং লীজ মানি/সরকারের ভূমি উন্নয়ন ট্যাক্স, ভ্যাট, প্রতিনিয়তই পরিশোধ করে থাকে। সংগত কারনেই বলা যায়, চা বাগান মালিক, কোম্পানী, ম্যানেজার, কর্মচারী ও শ্রমিকগন এর মধ্যে সৎ, নিবেদিত পরিশ্রমীদের বেছে-বেছে-বাছাই করে সরকারী উদ্যোগে পুরস্কার দেয়া হউক।

চা এর বাজার, মার্কেটিং আমদানী রফতানীর প্রায় কোন কিছু চা বাগান মালিকদের হাতে নেই চা তৈরী করে অকশনে বিক্রির জন্য চট্রগ্রামে যার যার নির্ধারিত ব্রোকারস ও ওয়্যার হাউজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্রেতারা বেশীর ভাগই দেশী, মাত্র কয়েকজন বিদেশী নির্ধারিত সেইল দিবসে উপস্থিত হয়ে টেস্টিং টেবিলে রক্ষিত শত শত গ্রেড এর চা চোখে দেখেন, চা এর কাপে ঢেলে গরম পানি দিয়ে মিনিট পাচেক ঢেকে রেখে তৎপর মান্দাতার আমলের নিয়মে মুখে চেখে, লিকার ফ্লেভার ষ্ট্রেংথ ব্রিস্কনেচ ও ইনফিউশান এর মান নির্ধারন করে চা ক্রয় এর দাম হাকান। অকশনে এই ভাবেই চা বিক্রি হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ত্রেতা নিজেদের চা নিজেরাই কিনে প্যাকেট করে বিক্রি করেন। তেল, গ্যাস, কয়লা, জ্বালানী, মেশিনারীজ প্রায় প্রতিটির মূল্যই দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু চায়ের দাম বাড়ছেতো নাই, বরং দিন দিন কমছে। ফলে কষ্ট অব প্রোডাকশন বৃদ্ধির কারনে চা বাগান মালিকগন বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বাগান সিক হচ্ছে। বাগান বিক্রির হার বাড়ছে। মালিকদের মধ্যে হতাশা সহ শ্রমিক দূর্ভোগ ও অসন্তোষ বাড়ছে। বাগান চালুর মূল যে চেতনা ‘‘শ্রমিক-মালিক সু সম্পর্ক’’ তা দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। উপরোক্ত অনির্ধারিত ভাবে বিদেশ থেকে নি¤œ মানের চা আমদানী চা শিল্পের অশনী সংকেত এসকল ব্যাপারে সরকারের আশু ব্যবস্থা দরকার। শ্রমিকদের কর্মঘন্টা দৈনিক ৮ ঘন্টা কিন্তু চা বাগানের রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তোফান, শিলাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, জোক, পোকা, সাপ ইত্যাদি মানবিক বিবেচনায় এবং প্রতিটি কাজের মান সম্মত নিরিখ স্বাব্যস্থ থাকায় ৬ ঘন্টা কাজ মান সম্মত ভাবে করলে বাগান কর্তৃপক্ষ সন্তোষ্ট হন। কিন্তু শুনা যায় ৬ ঘন্টার স্থলে কোন কোন ক্ষেত্রে ৩/৪ ঘন্টা সময় ও মান সম্মত কাজ হচ্ছে না। তবে মহিলা প্লাকার (কাচাপাতা চয়নে) নিশ্চয়ই এই অপবাদে পড়েন না। কারন তারাই চা বাগানের প্রোডাকটিভ লেবার। মহিলাগন পাতি তুলে আর গান গায়। বলে ‘‘বল বল রাম পাতি তোলা বড় সুখের কাম’’ সকল চা শ্রমিকই চা শিল্পের সম্পদ। এদেরকে রক্ষা করা সরকার/চা বাগান সকলের দায়ীত্ব।

সরকারীভাবে পাট, বস্ত্র, মৎস, প্রাণী খাদ্য ইত্যাদির জন্য মন্ত্রনালয় বর্তমান অথচ চা এর জন্য একক মন্ত্রনালয় নেই। বানিজ্য মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) এর দিক নির্দেশনায় এবং বি সি এস এর আনুকূল্যে চা শিল্প চলছে। ডিসেম্বর হতে মার্চ পর্যন্ত চা বাগানে চা উৎপন্ন হয় না। কারন ছাটাই এর পর চা গাছকে সময় দিতে হয়। এ সময়ে ফ্যাক্টরী বন্ধ থাকে  (বেশির ভাগ বাগানে) অথছ নির্দিষ্ট পরিমান বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল চা বাগান মালিকগন পরিশোধ করেই যাচ্ছেন এখানে সরকারী সাবসিডি ভর্তুকী প্রদান করা যেতে পারে।

১)  চা শিল্পের উন্নয়নে পূরাতন চা বাগানগুলো উপড়িয়ে নতুন সিস্টেমে চা বাগান সৃজনে সরকার, মালিকদের যৌথ উদ্যোগ একান্ত আবশ্যক। ভাল/উন্নত জাতের চা, বীজ ও ক্লোন আনুন।
২)  কোন চা বাগানে প্রধানত কোন কোন সমস্যা তা চা কোম্পানী, চা শ্রমিক ইউনিয়ন, ষ্টাফ ইউনিয়ন, সরকার মিলে মিশে তাৎক্ষনিক মিমাংসা করা দরকার।
৩)   প্রায় ৪৩ টি চা বাগান সিক। এদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সরকারী বরাদ্ধ ভর্তুকী/সহায়তা প্রদান করা দরকার এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দারী প্রয়োজন।
৪)   নতুন ভূমিতে আরো নতুন নতুন চা বাগান সৃজনে উৎসাহী ও আগ্রহী ধনাড্য মালিকদের স্বাগত জানিয়ে চা বাগান পরিচালনায় আনয়ন দরকার।
৫) শ্রমিক/কর্মচারীদের ন্যায্য দায়-দাবীগুলো সহজে এবং তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলা উচিৎ।
৬)  বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এবং বাংলাদেশ টি এষ্টেট ষ্টাফ এসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দ ও বি.সি.এস চা শ্রমিক/কর্মচারীদের জীবন-মান উন্নয়নে চা উৎপাদন বৃদ্ধিতে অসামান্য ভুমিকা রেখে যাচ্ছেন। মালিক-শ্রমিক-সরকার এর মধ্যে সেতু বন্ধনে তারা যাদুকরী ভুমিকা রাখছেন। এবারের বাজেটে তাদের ভুমিকা মূল্যায়ন হবে বলে অভিজ্ঞদের বিশ্বাস।
৭)   যে কোন মূল্যে আমাদের দেশে উন্নত-উৎকৃষ্ট গুন মান এর চা তৈরী করতেই হবে।
৮)  দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করতেই হবে। কারন বৈদেশিক অর্থ প্রয়োজন।
৯)   অভিজ্ঞ/ উন্নত রোল মডেল সৃষ্টিকারী চা বাগান মালিক/ম্যানেজার/ষ্টাফ/শ্রমিকদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে প্রতি বছর তাদেরে ‘‘অনারারী এম্বেসেডার’’ এর মূল্যায়ন করা হউক।
১০)  চা যে গুড, বেটার, বেষ্ট এই তিন ক্যাটাগরিতে ফেলে সরকারীভাবে নূন্যতম বিক্রয় মূল্য কেজি প্রতি ২৫০ টাকা, ২৭৫ টাকা ও ৩০০ টাকা নির্ধারিত হউক।
১১)  এবং চা বাগান মালিক/কোম্পানীকে সহজ শর্তে, বিনা সুদে হাইপো লোন এবং দীর্ঘ মেয়াদে ডেভেলপমেন্ট লোনসহ পলিসি সাপোর্ট বরাদ্ধ, অনুদান প্রদান ও মনিটরিং নিশ্চিত করা হউক।
১২)  শ্রমিকদেরকে বাগান মুখি করা সহ তারা বাগানের, বাগান তাদের বাগানের লাভ-ক্ষতিতে তাদের হিস্যা আছে- এই শিক্ষায় দীক্ষিত করে তুলতে হবে।
১৩)  যেসকল চা বাগানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত (যারা ঐ বাগানে কাজ করেন না) শুধু শ্রম জনগোষ্টি হিসাবে বসবাস করছেন, সেখান থেকে তাদেরে স্থায়ী কাজ ও বসবাসের জন্য অন্যান্য চা বাগানে (যেখানে শ্রমিক ঘাটতি/অভাব আছে) সমঝোতা এবং সুবিধার মাধ্যমে প্রেরণ/বন্টন করার জন্য সরকার/মালিক/শ্রমিক/চা শ্রমিক ইউনিয়নকে বিশেষ ভুমিকা পালন করা জরুরী বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
১৪)  চা শিল্পের উন্নয়নে এবারের বাজেট হউক অনুপ্রেরনা, পাঞ্জেরী ও আলোর দিশারী।
এবারের বাজেটের নাম চা শিল্প বান্দব বাজেট হবে বলে চা শিল্প আশাবাদী এবং চা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল বাজেট প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবার আশায় যায়গায় গর্বিত-উন্নত শিরে বলা হউক: এবারের বাজেটে ‘‘চা বাগান নাচবে। বাগান মালিক/কোম্পানী বাঁচবে, আর শ্রমিক/কর্মচারী হাসবে’’।

লেখক:মোঃ সিরাজুল ইসলাম. জেনারেল ম্যানেজার, হামিদিয়া চা বাগান, ৫০ বছরের অভিজ্ঞ প্লান্টার চা বিশেষজ্ঞ।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com