চা শ্রমিকের সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও জবাবদিহিতা
ফিলিপ গাইন॥ ২১ মে, ২০২১। আন্তর্জাতিক চা দিবস। মূলত চা উৎপাদনকারী দেশসমূহ এ দিবসটি পালন করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা দিবসটি পালনে মূখ্য ভূমিকায় থাকে। দিবসটি ঘিরে চায়ের টেকসই উৎপাদন ও সেবন নিয়ে যেমন প্রচার-প্রচারণা হয়, তেমনি ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করতে চা-এর ভূমিকার উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার ১৫৮ টি চা বাগানে (পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও-এর ৮টি বাগান বাদে) যে ১৩৮,৩৬৭ জন শ্রমিক কাজ করেন তারা কেমন আছেন? আন্তর্জাতিক চা দিবসে এমন প্রশ্ন আসা স¦াভাবিক। কারণ এসব শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রায় পাঁচ লাখের মতো মানুষ যে সীমাহীন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে ডুবে আছে তার আলামত সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের চা বাগানে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাদের অধিকাংশ অবাঙালি ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ১৮৩৯ সালে ভারতের আসামে যখন বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় তখন ভারতেরই বিভিন্ন জায়গা যেমন, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও নিম্নবর্ণের হিন্দু ও আদিবাসীদেরকে নিয়ে আসা হয় চা বাগানে কাজ করার জন্য। ‘কুলি-ধরা’ হিসাবে পরিচিত আড়কাঠি, মাইস্ত্রী ও সরদার এদেরকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে চা বাগানে নিয়ে আসে। একই সময় তামিলভাষী মানুষদেরকে ‘কাঙ্গানি’ বলে পরিচিত এজন্টরা শ্রীলংকাতে নিয়ে যায়। শ্রীলংকার শ্রমিকদের সাথে তৎকালীন আসাম এবং এখনকার বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের বড় পার্থক্য হলো শ্রীলংকার চা শ্রমিকরা সবাই তামিল। কিন্তু বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের জাতি পরিচয় খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। সোসাইটি ফর এনভায়নমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট সেড) ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৫৬টি চা বাগানে গবেষণা চালিয়ে ৮০-র মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পেয়েছে। এদের মধ্য থেকে ২৩টি সরকারের ২০১৯ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংশোধিত তালিকায় ¯া’ন পেয়েছে (২০১৯-এর আগে সরকারি তালিকায় চা বাগান থেকে ছিল নয়টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী)। এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষাও প্রচলিত আছে অন্তত ১২টি। এসব ভাষা (যার অধিকাংশই পরিপূর্ণ ভাষার মর্যাদা হারিয়েছে) ও নানা সংস্কৃতির চা শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন আটকে গেছেন চা বাগানে। তারা বাংলাদেশের নাগরিক এবং দেশের যেকোনো স্থানে বাস করার অধিকার তাদেরও রয়েছে। কিন্তু, যে অবস্থার মধ্যে তারা আটকে গেছেন, তাতে চা-বাগানেই বংশপরম্পরায় তাদের জীবন পাড় করতে হচ্ছে। সেখানে তাদের নেই নিজস্ব কোনো জমি, ভিটে বা বাড়ি। প্রান্তে বেঁচে থাকা এসব মানুষ বাগান মালিক ও রাষ্ট্রের উপর নিভর্শীল হয়ে পাঁচ প্রজন্ম ধরে চা বাগানেই আটকে আছেন। এদের মুক্তির উপায় কী? এ প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। তবে তারা যে বঞ্চনা ও বৈষম্যের মধ্যে ডুবে আছে সেববের যাতে অবসান ঘটে সেদিকে চা বাগানের মালিক, রাষ্ট্র ও অন্য সংশ্লিষ্ট সবার আরো মনোযোগী হতে বাধা নেই। চা শ্রমিকরা যে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার তার বড় আলামত মেলে তাদের অত্যন্ত কম মজুরির থেকে। একজন চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১২০ টাকা (মালিক-শ্রমিকের সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী যা ২০১৯-২০২০ সালের জন্য কার্যকর)। দৈনিক নগদ মজুরির সঙ্গে একজন শ্রমিক আরও যা পান, তার মধ্যে অন্যতম সাত-আট কেজি চাল বা আটা (সাড়ে তিন কেজি নিজের জন্য এবং বাকীটুকু স¦ামী/¯ী¿ ও ১২ বছরের কম বয়সী সন্তানদের জন্য)। ভর্তুকি মূল্যে প্রতি কেজি চাল বা আটার জন্য তাকে ২ টাকা ব্যয় করতে হয়। স্থায়ী বা নিবন্ধিত শ্রমিক হলে প্রতি বছর ৪৭ দিনের মজুরির সমান উৎসব ভাতা পান যা দু’টি প্রধান উৎসবে দেয়া হয়। তার বসবাস লেবার লাইন বা শ্রমিক কলোনীতে এবং সেখানে তাকে ঘরভাড়া দিতে হয় না। এসবের পাশাপাশি তিনি আরও পান বিনা মূল্যে ন্যূনতম ¯া^¯্য’সেবা।
চা শ্রমিকের সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও জবাবদিহিতা – ফিলিপ গাইন ।
নগদ মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে একজন শ্রমিকের বর্তমান দৈনিক আয় সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বা মাসিক আয় ৬,০০০ টাকার বেশি নয় এমন হিসাব দেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের অনেকে। কিন্তু, বাগান মালিকপক্ষ চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ও শ্রমিককে দেওয়া সুবিধার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে। তাদের হিসাবে “একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি দাড়ায় ২৭০ টাকা,” বলেছেন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)-এর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তবে জানা গেছে ২০১৯ সালে চা শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডে একজন চা শ্রমিক দৈনিক সর্বসাকুল্যে কী পান তার একটি হিসাব দিয়েছে চা বাগান মালিকদের সংগঠন বিটিএ। এ হিসাব অনুসারে মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তারা পান ৩৭৮.৯১ টাকা এবং যারা কারখানায় কাজ করেন তারা পান ৩৪৬.৯১ টাকা। এ হিসাব সর্বশেষ ২০১৯-২০২০’র জন্য কার্যকর চুক্তি সই-এর আগে যখন নগদ মজুরি ছিল ১০২ টাকা। অর্থাৎ এর সাথে যোগ হবে আরো ১৮ টাকা। মালিকদের এ হিসাব শ্রমিকদের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের (বিসিএসইউ) সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী মালিকপক্ষের এ হিসাব মানতে রাজি নন। ‘একজন চা-শ্রমিক যা পায়, তা ন্যায্য মজুরির ধারেকাছেও না।’ যে বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট, তা হলো, মজুরি বৈষম্যসহ বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনার কারণে চা জনগোষ্ঠীর মানুষ অন্যান্য নাগরিকদের চেয়ে অনেক পেছনে পড়ে আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের ২০১৮ সালের এক জরিপের ফলাফল অনুসারে, চা-বাগানের ৭৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অথচ ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ শতাংশ। এমন অবস্থায় ধারণা করা হয় চা উৎপাদনকারী দেশসমূহে বাংলাদেশের চা-শ্রমিকরা সবচেয়ে কম মজুরি পান। তাদের গড় পারিবারিক আয় বাংলাদেশের জাতীয় বা গ্রামীণ দারিদ্র্যসীমা ও পারিবারিক আয়ের চেয়ে অনেক কম। আমাদের প্রতিবেশী দুই দেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে, একজন চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি যথাক্রমে পাঁচ ও দুই মার্কিন ডলারের বেশি। এর ওপর যোগ হয় আবাসন, শিশুযত্ন এবং বিনামূল্যে ¯া^¯্য’সেবা এবং অন্যান্য বাধ্যতামূলক ভাতা, যেমন, উপস্থিতি ভাতা ও বোনাস এবং ‘ওভার কিলো পেমেন্ট’ (দিনের কোটা পূরণের পরে কাঁচাপাতা তোলার জন্য প্রদত্ত মজুরি)। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার এক কেজি চা যখন ২.৯৯ ডলারে বিক্রি হয়, বিশ্ববাজারের তখন চায়ের দাম কেজি প্রতি ২.৫৯ ডলার এবং চট্টগ্রামে নিলামে তখন চায়ের দাম কেজি ২.৪১ ডলার। শ্রীলঙ্কার চা বিশ্ববাজারে সর্বাধিক দাম পাচ্ছে বটে, তারপরও বাংলাদেশের চায়ের গড় নিলাম মূল্য এতো কম নয় যে এখানকার চা শ্রমিকদের দৈনিক নগদ মজুরি এমন এতো কম হবে। শ্রীলঙ্কায় চা উৎপাদন ব্যয়ের ৬৩ শতাংশ খরচ হয় শ্রমিকের জন্য ও চার শতাংশ যায় কর্মচারী ও ব্যবস্থাপনার খরচ মেটাতে। বাংলাদেশে চা শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণের সময় দেখা উচিত চা-শ্রমিকের মজুরি উৎপাদন খরচের কতো শতাংশ। ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ একদিকে যেমন চা-শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক তেমনি এ আইনের অনেক ধারার লঙ্ঘন সুস্পষ্ট । শ্রম আইন কোনো প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র জাতীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন করার অধিকার দিয়েছে। সব চা বাগান মিলে একটি প্রতিষ্ঠানপুঞ্জ হিসেবে পরিগণিত। কাজেই চা শ্রমিকরা কেবল জাতীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন করতে পারেন এবং একটি ইউনিয়ন করার জন্য মোট শ্রমিকের অন্তত ২০ শতাংশকে সদস্য হতে হবে। মালিক ও সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়ন করার জটিলতা এমনই যে চা-শিল্পে দ্বিতীয় কোনো ইউনিয়ন করা আপতত একেবারেই অসম্ভব এবং এর কুফল সহজেই অনুমেয়। অন্যান্য শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ১০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি থাকলেও চা শ্রমিকরা এ ছুটি পান না। অন্যান্য শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা যেখানে ১৮ দিন কাজ করে এক দিনের অর্জিত ছুটি পান, সেখানে চা-শ্রমিকরা এক দিনের ছুটি পান ২২ দিন কাজ করে। শ্রম আইনে বলা আছে, “কোনো মালিক নিয়োগপত্র প্রদান না করিয়া কোনো শ্রমিককে নিয়োগ করিতে পারিবেন না এবং নিয়োজিত প্রত্যেক শ্রমিককে ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করিতে হইবে।” কিন্তু, চা বাগানের কোনো শ্রমিকই মালিক পক্ষের কাছ থেকে শ্রম আইন অনুসারে নিয়োগপত্র পাননা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা তপন দত্ত বলেন, “চা বাগানের মালিকরা প্রভিডেন্ট ফান্ডের কাগজপত্রকেই নিয়োগপত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।”
চা শ্রমিকের সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও জবাবদিহিতা – ফিলিপ গাইন ।
এমন বহু অভিযোগ রয়েছে যে, কোনো শ্রমিককে ¯া’য়ী করার আগে কয়েক বছর অস্থায়ী হিসেবে কাজ করানো হয়। অস্থায়ী হিসেবে কাজ করা শ্রমিকরা সাধারণত পুরো রেশন, চিকিৎসাসেবা ও মজুরিসহ ছুটি পান না। ২০০৬ সালের শ্রম আইন (অনুচ্ছেদ ২৩৪) অনুযায়ী, কোম্পানির মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের পাওয়ার কথা। মুনাফার এই অর্থ শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়ার কথা, যা তারা সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবেন। বর্তমান শ্রম আইন প্রণয়নের আগেও চা বাগানে এই বিধান ছিল। তবে, চা-শ্রমিকরা অতীতেও এই লভ্যাংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিলেন, এখনো আছেন। শ্রম আইন ও ২০১৫ সালের বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী, শ্রমিকদের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিতই থাকছেন। যেমন, কর্মস্থলে টয়লেট ও প্রক্ষালন সুবিধা। যেখানে চা শ্রমিকরা চা-পাতা তোলার কাজ করেন এবং যেখানে চা-পাতা তোলা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি নারী, সেখানে না আছে টয়লেট, না আছে প্রক্ষালন কক্ষ। তা ছাড়া, খাবার পানির সরবরাহও সবসময় পর্যাপ্ত থাকে না, এমন অভিযোগও আছে। যদি বাগান মালিকরা শ্রম বিধিমালা (অনুচ্ছেদ ৭৯) ঠিকঠাক অনুসরণ করেন, তাহলে বাগানের ৫০০ বা তার অধিক শ্রমিকদের জন্য একজন কল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা। যদি শ্রমিকের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি হয়, তাহলে প্রত্যেক দুই হাজার শ্রমিকের জন্য একজন অতিরিক্ত কল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা। এসব কল্যাণ কর্মকর্তা বাগানের মালিক ও শ্রমিক, উভয়ের কল্যাণে কাজ করবেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, ‘আমরা এখনো দেখিনি বা শুনিনি কোনো কল্যাণ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি প্রহসন।’ চা শ্রমিকদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো তারা কোনো গ্র্যাচুইটি পান না। একজন চা-শ্রমিক ৪০ বছর বা তারও বেশি সময় চা বাগানে কাজ করে গেলেন, অথচ কর্মজীবনের শেষে কোনো গ্র্যাচুইটি পেলেন না। তবে তারা কিছু পেনশন পান যা বর্তমানে সপ্তাহে ১৫০ টাকা (২০০৮ সালে ছিল ২০ টাকা)। সঙ্গত কারণে তারা এতে খুশি নন। তারা গ্রাচুইটি চান। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকদের সংগঠন, বাংলাদশ চা সংসদ (বিটিএ) ২০১৭ ও ২০১৮ সালের জন্য যে চুক্তি করেছিল তাতে গ্র্যাচুইটি দিতে বিটিএ সম্মত হয়েছিল। কিন্তু, অবসরে যাওয়া কোনো শ্রমিকই এখনও কোনা গ্র্যাচুইটি পাননি। আর ২০১৯-২০২০ সালের জন্য কার্যকর চুক্তিতে গ্র্যাচুইটির ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘গ্র্যাচুইটি: বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬/২০১৩ অনুসারে হইবে’। এমন কী ঘটল যে মালিকরা গ্র্যাচুইটির দেবার ব্যাপারে মত পাল্টালো। শ্রমিকদের ইউনিয়ন গ্র্যাচুইটির জন্য অনেক চেষ্টা করেও মালিকদের সরাসরি অঙ্গীকার আদায় করতে পারেনি। এর অর্থ হচ্ছে মালিকরা অতীতে যেমন গ্র্যাচুইটি দেননি তেমনি এখনো দিবেন না। ২০১৮ সালে শ্রম আইন ২০০৬-এ একটি ছোট্ট সংশোধনী হয়েছে এবং অভিযোগ আছে শক্তিশালী মালিকপক্ষ সেই সংশোধনী কাজে লাগিয়ে চা শ্রমিকদেরকে গ্র্যাচুইটি থেকে বঞ্চিত রাখতে চাইছে। উল্লেখ্য, চা বাগানেরই শ্রমিক-কর্মচারীদের একটা অংশ, বাংলদেশের টি স্টাফ এসোসিয়েশনের তিন হাজারের মতো সদস্য নিয়মিতভাবে গ্র্যাচুইটি পান। তার পেনশন পান না। “চা শ্রমিকদের ব্যাপারে নানা অন্যায় ও আইনী বৈষম্য হচ্ছে। আমরা এসবের অবসান চাই,” দাবি রামভজন কৈরীর। চা শ্রমিকের আবাসন, ¯া^¯্য’ ও শিক্ষা এ সবই যেন দূর্ভাগ্যের আয়না। তাদের বসবাসের ব্যব¯া’ করার দায়িত্ব বাগান-মালিকের। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫-এর পঞ্চম তফসিলে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। শুধু তাই নয় ঘর মেরামতের দায়িত্বও বাগান মালিকের। শ্রম বিধমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা [৭ (১) খ] অনুসারে প্রতিবছর লেবার লাইনে বসবাসকারী শতকরা অন্তত দশ ভাগ শ্রমিকের জন্য ‘মির্তিঙ্গা টাইপ’ (পাকা দেয়ালের) গৃহ নির্মাণ করতে হবে। গৃহের মেরামত, ব্যবহার ও দেখাশোনার জন্য মালিক-শ্রমিক উভয়ের দায়িত্ব শ্রম বিধিমালায় দেয়া আছে। চা শ্রমিকরা বাগান মালিকের দেয়া গৃহের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন। প্রথমত বাগান মালিকরা যদি প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে ঘর ‘মির্তিঙ্গা টাইপ’ করে দিতেন তবে চা বাগানের লেবার লাইন বা শ্রমিক কলোনীতে এখন আর কোনো কাঁচা ঘর থাকত না। বাংলাদেশ টি বোর্ডের ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে চা বাগানে পাকা ঘরের
চা শ্রমিকের সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও জবাবদিহিতা – ফিলিপ গাইন ।
(মির্তিঙ্গা টাইপ) সংখ্যা ১৮,৪৯০ আর কাঁচা ঘরের সংখ্যা ৫৭,০৫৯। এ অবস্থা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গৃহ নিয়ে আরো নানা উদ্বেগ আছে শ্রম আইন যেসবের মীমাংসা হওয়া দরকার। পাতাতোলা শ্রমিকদেরই করতে হয় চা শিল্পের সবচেয়ে কষ্টের কাজ। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের নিদারুণ কষ্টের মধ্যে গর্বের সময় পার করতে হয়। তাদের অধিকাংশ সন্তান প্রসবের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত ভারী ও কষ্টের কাজ করেন। ফলে অনেকের গর্ভপাত ঘটে এবং অনেকে মৃত সšাÍন জন্ম দেন। তাছাড়া অধিকাংশ নারী বাড়ীতেই মাটির উপর করা বিছানায় অপরিচছন্ন পরিবেশে সন্তান প্রসব করেন। ফলে মা ও শিশু উভয়ই ঝুঁকির মধ্যে থাকে। চা বাগানসমূহে বাগান ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হাসপাতাল ও ডিসপেনসারি আছে। কিন্তু এসব হাসপাতালে যে চিকিৎসা পাওয়া যায় তাতে শ্রমিকরা সন্তুষ্ট নন। ক্যান্সার ও যক্ষ্মাসহ বড় কোনো রোগে পড়লে বাগানের হাসপাতাল ও ডিসপেনসারিতে ভালো চিকিৎসা মেলে না। শ্রম আইন ও বিধিমালায় যেসব প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের পাবার কথা তার অনেক কিছুই তারা পান না। তবে চা বাগানের কাছাকাছি যেসব সরকারি ¯া^¯্য’ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে চা শ্রমিকদের যেতে বাধা নেই। তাদের কেউ কেউ সেখানে যাচ্ছেনও; সঙ্গত কারণেই তাদের সংখ্যা কম। চা শ্রমিকের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চা বাগান মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যে শিক্ষার ব্যাপারে সবসময় উদাসীন থেকেছে তার সপক্ষে জোড়ালো সব লক্ষণ আমরা দেখতে পাই। লক্ষ্যণীয়, চা বাগানসমূহে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুবই কম। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরীর মতে চা বাগানসমূহে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন ২৫০টির মতো; আছে ৪৫টি মতো। এর মধ্যে কেবল শ্রীমঙ্গল উপজেলাতেই আছে ৩৬টি। অর্থাৎ অন্যান্য উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একেবারে কম। চা শ্রমিকের দাবি সরকার চা বাগনসমূহে বাগান ব্যব¯া’পনায় পরিচালিত ও অন্যান্য সকল বেসরকারি বিদ্যালয় সরকারি করুক। চা বাগানের ছেলেমেয়েদের উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশেনা করার সুযোগও অনেক কম। চা শ্রমিকদের ঠিকানা বাগানের মধ্যে ¯া’পিত লেবার লাইন বা শ্রমিক কলোনী। চা বাগানসমূহে ক্ষেতল্যান্ড বা ধানী জমি আছে ২৮,২৭৫.০৫ একর। জঙ্গল কেটে যে সময় থেকে চা শ্রমিকরা চা বাগান তৈরি করেছেন, সে সময় থেকেই এই ধানী জমি বা ক্ষেতল্যান্ডও তৈরি করে তারা চাষাবাদ করছেন। কিন্তু তারা লেবার লাইনের জমি, ঘর এবং ধানী বা ফসলী জমি কেনো কিছুরই মালিক নন। এসব জমির মালিক সরকার। সরকার চাইলে চা বাগানের যেকোনো জমি যেকোনো সময় নিয়ে নিতে পারে। তবে চা শ্রমিকরা যে জমি চাষা করেন তা কেড়ে নিতে গেলে তারা তীব ্রপ্রতিবাদ করেন এবং রাষ্ট্র ও বাগান মালিককে বুঝিয়ে দেন যে এ জমি তারা তৈরি করেছেন যা দেড় শতাধিক বছর তাদের দখলে আছে। কাজেই এ জমির উপর যাদের অধিকার জন্মেছে। চাইলেই এ জমি কেড়ে নেয়া যাবে না। হবিগঞ্জ জেলার চাঁনপুর চা বাগানে এক জায়গায় ৫১১ একর ফসলী জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার অভিপ্রায়ে জমির দখল নিতে গেলে শ্রমিকদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সরকারি প্রশাসন থমকে যায়। ২০১৫ সালের ১৩ থেকে ১৯ ডিসেম্বর সাতদিনের নজীরবিহীন প্রতিবাদের পর থেকে এখনো তারা শক্ত অবস্থান নিয়ে আছেন। চা বাগানের কোনো ফসলী জমি যদি সরকার নিতে চায় তবে শ্রমিকদের যে অবজ্ঞা করা যাবে না, সেকথা তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন। চা শ্রমিকরা ১৫০ বছরের অধিককাল বা পাঁচ প্রজন্ম ধরে যে জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করছেন সে জমিতে মালিকানা সত্ত্ব কী তারা কোনোদিন পাবে না? এ প্রশ্ন চা বাগানের সর্বত্র শোনা যায়। ভূমির মালিকানা একটি গুরুতর বিষয়। এ নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও করণীয় কী? সবাই জানতে আগ্রহী। বাংলাদেশের চা শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন শুধু দরিদ্র এবং পশ্চাদপদই নয়। বিভিন্ন ভাষা, জাতিপরিচয়, ধর্ম, সংস্কৃতি ও একটি বিশেষ পেশা অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষ এরা। এরা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন ্নও পেছনে পড়ে আছেন। তাদের মুক্তির জন্য সমান সুযোগ-সুবিধাই যথেষ্ট নয়; দরকার আরো বেশি কিছু। কাজেই চা শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার করতে হলে প্রথমেই শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা তাকে যেসব অধিকার দেয় সেসব নিশ্চিত করতে হবে। এরপর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র তাদের জন্য যে বরাদ্দ রেখেছে তা আরো বাড়াতে হবে। ভূমির মালিকানা বঞ্চিত চা বাগানে ‘বাঁধা’ পড়া এসব মানুষের জন্য আরো অনেক কিছু করবার আছে তাদের নিয়োগদাতা।
চা শ্রমিকের সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও জবাবদিহিতা ফিলিপ গাইন।
রাষ্ট্র এবং সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ও বৈচিত্র্যময় জাতি-পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব তাদের সাথে পরামর্শ করে সেসব ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সামাজিক ন্যায় বিচার ও রাজনৈতিক সুরক্ষাই পেছনে পড়ে থাকা চা শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজনকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে।
মন্তব্য করুন