চা শ্রমিক হয়ে ৬ ভাই-বোনের শিক্ষাকে জয়, সন্তানরা সরকারি বিভিন্ন দফতরে কর্মরত
স্টাফ রিপোর্টার॥ শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানের একজন সাধারণ চা শ্রমিক ছিলেন শৈব্য বোনার্জী। চরম দরিদ্রতা ছিল যার নিত্য সঙ্গী। ডান পায়ে সমস্যা থাকায় স্বাভাবিক মানুষের মত তিনি চলতে পারতেন না। পরিবারের সদস্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি সেই পা দিয়ে কাপড় শেলাইয়ের বাড়তি আয়ে কোন রকম সংসার চালতো তার। পারিবারিক জীবনে দুই সংসার করেন তিনি। ফলে প্রথম সংসারে দুই পুত্র এবং দ্বিতীয় সংসারে তিন পুত্র সহ মোট পাঁচ পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী রুহিনী বোনার্জি বংশানুক্রমে একজন চা শ্রমিক। তবে শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। বাগানে শ্রমিকের কাজ করে ছেলে-মেয়েদের বাগানে না রেখে পাঠাতেন স্কুলে। স্বপ্ন দেখতেন সফল মা হবার। আর তাই তিনি করেছেন।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, তাদের সন্তানদের মধ্যে উজ্জ্বল বোনার্জী ও বিপ্লব বোনার্জী ১৯৯৪ সাল, তৃতীয় ছেলে সরল বোনার্জী ১৯৯৭ সালে চতুর্থ ছেলে শিমুল বোনার্জী ২০০১ সাল ও একমাত্র কন্যা সুপর্না বোনার্জী ২০০২ সালে এবং সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান শিপুল বোনার্জী পঞ্চম শ্রেণীতে রাজঘাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাবস্থায় সিন্দুরখান সরকারি প্রাথমিক থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পান এবং ২০০৬ সালে র্যানার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে মাধ্যমিক পাঠ শেষ করেন।
রুহিনীর ছেলে বিপ্লব পরবর্তীতে এইচএসসি ও ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ২০০১ সালের এসএসএসি পরীক্ষায় সিলেট শিক্ষাবোর্ড হতে মানবিক শাখায় জিপিএ ৪.০০ পাওয়া শিমুল বোনার্জী এখন মৌলভীবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির পদে কর্মরত রয়েছেন। তৎকালীন সেই ফলাফল ছিল সারা দেশের মধ্যে উল্যেখযোগ্য এবং বাংলাদেশের সমগ্র চা বাগানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ জিপিএ। পরে শিমুল ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করে সিলেট এমসি কলেজে ইংরেজিতে সাহিত্যে পড়াশোনা করেন।
একমাত্র মেয়ে সুপর্না বোনার্জীও এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করে সমাজবিজ্ঞানে বিএসএস (সম্মান) এমএসএস (সমাজবিজ্ঞান) সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি বিএড ডিগ্রি এবং সিলেট ‘ল’ কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। কনিষ্ঠ সন্তান শিপুল বোনার্জীও এমসি কলেজ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি (উদ্ভিদবিজ্ঞান) সম্পন্ন করেন।
রুহিনীর ছেলে উজ্জ্বল এখন ঢাকার একটি ইন্ডাসট্রিজ-এ চাকুরি করেন । বিপ্লব চা বাগানের একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তার স্ত্রী প্রতিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আরেক ছেলে সরল মায়ের চা বাগানের কাজ নিয়ে রেজিস্ট্রার শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ও তার স্ত্রী সংগীতা আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় জড়িত। শিমুল মৌলভীবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির ও তার একমাত্র মেয়ে সুপর্না ও আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত। কনিষ্ঠ পুত্র শিপুল বোনার্জী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দ্বায়িত্বরত আছেন।
মৌলভীবাজার জেলায় মোট ৯২টি চা বাগান রয়েছে। বাংলাদেশের চা শমিকদের হেডকোর্টার শ্রীমঙ্গলে। সারাদেশের শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া ও আন্দোলন পাঁকাপুক্ত করতে “বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ নামের সংগঠনের “লেবারহাউজ” প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৪ সালে। তবে শ্রমিকরা শিক্ষায় এগিয়ে আসায় প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের পাওনা মুজুরি থেকে। এই লেবার হাউজ কার্যালয়ে একসময় মাত্র কয়েক টাকা বেতনে কাজ করতেন রুহিনীর স্বামী শৈব্য বোনার্জী। এখন তার সন্তানেরা উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পয়সা কামাই করলেও তিনি দেখতে পারছেন না। চলে গেছেন পরপারে।
চা জনগোষ্ঠী এখনো সুবিধা বঞ্চিত অসহায় দরিদ্র। বর্তমান সময়ে এ গোষ্ঠির দারিদ্র্যতা কিছুটা কমে ও শিক্ষার হারও বেড়েছে। এই পরিবারের সকল সদস্য চা বাগানে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন । জুডিসিয়াল আদালতের নাজির শিমুল বোনার্জী বলেন, খুব কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন আমার মা। এটা চা জনগোষ্ঠির ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হিসেবে মনে করি। তিনি বলেন, এরকম মা যেন সবাই পায়। সুখে দুখে সন্তানদের আঘলে রাখা রুহিনী বোনার্জী এক আলাপচারিতায় বলেন, “অভাব-অনটনের মধ্য দিয়েও আমার সন্তানদের মানুষ করে এখন আমি খুব খুশি। আমি চাই আমার সন্তান সবসময় মানুষের উপকার করে যায়, কোন ক্ষতি যেন না করে । তবেই আমার স্বার্থকতা হবে”।
মন্তব্য করুন