চোখের সামনেই হত্যা করতে দেখেন পরিবারের সবাইকে : স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বাড়িতে ফিরতে পারেননি আজমেরুর দিলীপ দাশ
বিকুল চক্রবর্তী॥ মৌলভীবাজারের ভোজবল আজমেরু গ্রামের দিলীপ দাশ। যিনি চোখের সামনে হত্যা করতে দেখেন তার বাবা, মা, ভাই ও দিদিমাকে। আর হত্যাকারীদের ভয়ে তিঁনি সেই যে বাড়ি ছেড়েছিলেন স্বাধীনতার ৫২ বছরেও নিজের ভিটায় ফিরতে পারেননি। থাকেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের পূর্ব জামসী গ্রামে বোনের বাড়িতে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে দিলীপ দাশের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি ও তার বোন জামাই সুকেন্দ্র দাশ ১৯৭১ সালে তাদের পরিবারের ত্যাগের সেই লোমহর্ষক কাহিনী তুলে ধরেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর এ প্রতিবেদকের কাছে।
মৌলভীবাজার ভোজবল আজিমেরুর গোপেশ দাশের বাড়ি দখলই ছিল রাজাকার মসলন মিয়ার মুল উদ্দেশ্য তাই তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে প্রতিবেশি মসলন মিয়া রাজাকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে সে পাক সেনা নিয়ে হাজির হয় গোপেশ দাশের বাড়িতে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গ্রামে প্রবেশের খবরে গ্রামের মানুষ অনেকেই হাওরের দিকে পালিয়ে যান। গোপেশ দাশের পরিবার তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারেন নি। পাকিস্তানী জোয়ানরা বাড়িতে প্রবেশ করায় তখন আর তাদের পালিয়ে যাওয়ার আর পথ ছিল না। ছোট ছেলে দিলীপ দাশ ঘরের বাহিরে অনান্য শিশুদের সাথে খেলছে। বড় ছেলে বিরেন্দ্র দাশ, স্ত্রী- মানদা দাশ ও শাশুরী প্রেমদা দাশসহ তারা ঘরের ভিতরে লুকিয়ে পড়েন। রাজাকার মসলন মিয়া ও আতর মিয়া দুজনই ঘরে প্রবেশ করে তাদের তন্ন তন্ন করে খোঁজতে থাকে। অনেক পর হঠাৎ করে কারো দীর্ঘশ^াসের শব্দে তারা ধরা পড়ে যান। তাদের চারজনকে ধরে নিয়ে আসে উঠানের এক পাশে। ছোট ছেলেসহ আরো কয়েকটি শিশু এ সময় বাড়ির দিকে ছোটে আসতে চাইলে রাজাকাররা তাদের বাড়িতে উঠার আগেই ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাদের তাড়িয়ে দিলেও গোপেশ দাশের ছোট ছেলে দিলীপ দাশের চোখ তার বাড়ির দিকে। কিছুক্ষন পর তাঁর চোখের সামনে বাবা ও মাকে গুলি করতে দেখেন। এ সময় পুনরায় রাজাকাররা একটু দূরে অবস্থান করা দিলীপ দাশসহ আরো কয়েকজনকে আঙ্গুলের ইশারায় সরে যেতে বলে তখন গ্রামের ওই মানুষগুলোর সাথে তিনি গ্রামের পেছনে কাঞ্চার হাওরের দিকে পালাতে থাকেন। যেতে যেতে আরো দুটি গুলি শব্দ পান। যে দুই গুলিতে প্রাণ যায় তার বড় ভাই বিরেন্দ্র দাশ ও দিদিমা প্রেমদা দাশের। এর পর চোখে পড়ে তাঁর বাড়িতে আগুন জ¦লছে। পাক সেনারা চলে গেলে গ্রামের মানুষ যখন হাওর থেকে গ্রামের দিকে ফিরেন তখন তিনিও ফিরছিলেন। এ সময় তার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলায় এবং তাকে পেলেও মেরে ফেলতে পারে এই ভয়ে ওই গ্রামেরই প্রতিবেশী মেঘাই দাশের ছেলে গোপেশ দাশ তাকে নিয়ে যান তাদের বাড়িতে। মেঘাই দাশ সেদিন তাকে জানান, তার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলেছে। পরের দিন মেঘাই দাশের পরিবার চলে যায় আটঘরে। তাদের সাথে তিনিও চলে যান। দেশ স্বাধীনের পর আবার মেঘাই দাশের বাড়িতেই ফিরে আসেন।
এদিকে দেশ স্বাধীনের পর দিলীপ দাশের একমাত্র জীবিত স্বজন তার বড় বোন সুপ্রভা দাশের শ^শুর ঁসুরেন্দ্র দাশ ১৯৭২ সালে তার ছেলের শশুর বাড়ির খোঁজ নিতে আজিমেরু যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন তাঁর পুত্রবধুর বাবা, মা, ভাই ও দিদিমাকে মেরে ফেলেছে। আর ওই ভিটায় বসত গেরেছে অন্যমানুষ। এ সময় গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে ঘটনা জানতে গিয়ে মেঘাই দাশের বাড়িতে পান ছোট শিশু দিলীপ দাশকে। দিলীপ দাশকে নিয়ে তিনি চলে আসেন শ্রীমঙ্গলে নিজের বাড়িতে। এখানেই তিনি বড় হতে থাকেন।
দিলীপ দাশের বোন জামাই সুকেন্দ্র দাশ জানান, তাঁর শ^শুর বাড়ি দখলের উদ্দেশ্যে রাজাকাররা সবাইকে হত্যা করে। সে সময় তাদের হত্যা করে বাড়িতেই তাদের গোপরের গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়। তিনি বলেন, এদের ভয়ে ওই বাড়িতে তার শেলক দিলীপ দাশকে নিয়ে যাননি। নিজের বাড়ির এক পাশে তাদের কিছু জায়গা দিয়ে তাদের কাছেই রেখেদেন। এখানেই তাকে বিয়ে করান।
বর্তমানে দিলীপ দাশের এক ছেলে রাহুল দাশ ও তিন মেয়ে প্রিয়াংকা, তৃষা ও অপিকে নিয়ে দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে জীবন যাপন করছেন।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন কমান্ডার কুমুদ রঞ্জন দেব জানান, এই দেশের জন্য দিলীপ দেব এর পরিবারের বড় অবদান রয়েছে। বর্তমানে তারা নিজের বাড়িঘর ফেলে শ্রীমঙ্গল আশিদ্রোনে বসবাস করছেন। তাদের সাহায্য প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন