ছাব্বিশে মার্চ-মহান স্বাধীনতা দিবসঃ আমার দেখা একাত্তোর ঃ স্মৃতিকথা ঃ ইতিকথা

March 23, 2017,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ উনিশশ একাত্তোর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলা ও বাঙ্গালির জাতীয় জীবনের হাজার বছরের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায়। একাত্তোর সালে মার্চ থেকে ডিসেম্বর নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী সসস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে জাতি অর্জন করেন চীর কাংখিত-প্রিয়তম স্বাধীনতা। ছাব্বিশমার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ছাব্বিশে মার্চের মহান স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতি প্রসঙ্গে আলোচনা একান্তই প্রাসঙ্গিক, কারন একাত্তোরের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা স্বাধীনতা বিরোধীদের ভাষায় কোন-গন্ডগোলের বছর-নয়, বরং বলা চলে একটি ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে ফল ও ফসল, ছাব্বিশে মার্চের মহান স্বাধীনতা দিবস।
সাতচল্লিশে বৃটিশ বিদায়, ভারত বিভক্তি এবং পাকিস্তানী স্বাধীনতার শুরু থেকেই পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ট জনগোষ্টী বাঙ্গালিরা শোষন ও বঞ্চনার সম্মুখীন হন। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল প্রাষাদ ষড়যন্ত্রী সামরীক জান্টাও আমলাতন্ত্র নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানে গনতান্ত্রীক সরকার ও সুশাসন চালু না করে গনবিরোধী বিশেষতঃ বাংলা ও বাঙ্গালি বিরেধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল কথিত কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় এসে সগর্বে ঘোষনা করেন-উর্দূ এবং একমাত্র উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। সেই থেকে শুরু। সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী শুরু হয় প্রতিবাদ, ছাত্রগণ বিক্ষোভ। এই ধারাবাহিকতায় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিমলীগের ভরাডুবি এবং হক-ভাষানী-সোহরাওয়ার্দীর (শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এবং গনতন্ত্রের মানষ পুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের-ঐতিহাসিক বিজয়, ৯২-ক-ধারা জারী করে কেন্দ্র কর্তৃক প্রাদেশিক সরকার বাতিল, ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক বাঙ্গালির মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষনা, উনসত্তোর সালে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের এগারো দফার ছাত্র গনআন্দোলন গন অভ্যোত্থানে রূপ নিলে বাংলা ও বাঙ্গালিদের কাছে নতি স্বীকার করে সাধারন নির্বাচন দিতে বাধ্য হন পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খাঁন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ও বাঙ্গালির ধারাবাহিক আন্দোলনে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের একক নেতা হিসাবে অ্যবির্ভূত হন। তার বলিষ্ট ও গতিশীল নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার তুঙ্গে উঠে। বঙ্গবন্ধু সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচন কে ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচীর রেফারেন্ডাম হিসাবে ঘোষনা দেন; কারন মস্কোপন্থী কতেক অপরিনামদর্শী ও কল্পনা বিলাসী ভ্রষ্ট বাম ছয়দফা কর্মসীচীতে সিআইএ এর গন্ধখুজে পেতেন বঙ্গবন্ধুকে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের এজেন্ট বলতে ও দ্বিধাবোধ করেন নি। এসব শূন্য মার্গে বিচরনকারি ভ্রষ্ট বামদের স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি, অনেকেই ভুলবুঝে বুলিপাল্টিয়ে আওয়ামী নৌকার সওয়ারী হয়ে সাংসদ, মন্ত্রী, দলীয় দায় দায়িত্ব পেয়েছেন, যদিও এদের অনেকেই এখনও আওয়ামী আঙ্গিনায় ন্যাপ এর অমুক-তমুক বলে অভিহিত হন।
একাত্তোর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্স ফাইন্যালের ছাত্র ছিলাম। ষাটের দশকের শুরুতে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতায় উদ্ভোদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও তাত্বিক সিরাজুল আলম খানের প্রেরনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কর্মি হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেই। বক্তৃতা, সাংগঠনিক দক্ষতা সাংবাদিকতা এবং শিল্প ও সাংস্কৃতিক সংগঠক এর কারনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সুদৃষ্টি লাভ করি। তাদের সংস্পর্শে যাই। ¯েœহ মমতা পাই। তখন কেডার-গড ফাদার প্রথা চালু ছিল না। নেতারা কর্ম্মিগণকে মিত্রবৎ-ভ্রাতৃবৎ ¯েœহ মমতা করতেন। চার-পাচ দশক পর এখনও অনেকের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান-ক্ষেত্র বিশেষে রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও। ১৯৬২ সালে রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তক সিরাজুল আলম খান স্বাধীনবাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষে গোপন সংগঠন-নিউক্লিয়াস-গঠন করেন। এই প্রক্রিয়ায় তার সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজি আরিফ আহমদ জড়িত ছিলেন। মফস্বল পর্য্যায়েও নিউক্লিয়াসের সাংগঠনিক কার্য্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দেওয়ান নূরুল হোসেন চঞ্চল এবং আখতার আহমদ নিউক্লিয়াসের গোপন কার্য্যক্রমে জড়িত ছিলেন। আমাদের প্রজন্ম তাদের গুনগ্রাহী ও অনুরাগী হিসাবে-নিউক্লিয়াসী-প্রক্রিয়ায় জড়িত হই। শ্লোগান-তুলি-“সব কথার শেষ কথা বাংলার স্বাধীনতা, তোমার আমারঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা”-ইত্যাদি। ছাত্রলীগ সংঘঠক হিসাবে ঐ দশকে আমি প্রথম মৌলভীবাজার কলেজ শাখা অতঃপর তৎকালীন মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হই। ৬৮ সালে বিএ পাশ করে পিতা মাতার কথানুসারে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ঢাকা গমন করতঃ ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ প্রিলিমিনারিতে ভর্তি হই, প্রথমে তৎকালীন ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) অতঃপর হাজি মোহাম্মদ মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র হই। ফলতঃ কেন্দ্রীয় নেতাদের সহচার্য্যে যাবার সুযোগ পাই। তখন আন্দোলন সংগ্রামের কারনে আমাকে ঢাকা-মৌলভীবাজার আসা যাওয়া করতে হত।
সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ উভয় পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু দেশে বিদেশে পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা এবং ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আখ্যায়িত হন। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতালিপ্সু সামরীক জান্টা এবং পাঞ্চাবি আমলাতন্ত্র ক্ষমতা হস্তান্তরে টাল বাহানা শুরু করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের নাম করে পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আলোচনার নাম করে সময় কর্তন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য সমাবেশ করতে থাকেন। বাংলা ও বাঙ্গালির আন্দোলনকে স্তব্দ করার জন্য সামরীক শক্তি প্রয়োগ করতে থাকেন।
খান সেনাদের গনহত্যা এবং ঝুলুম নির্য্যাতনের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর আহবানে শুরু হয় অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন। আসে ঐতিহাসিক মার্চ মাস। উত্তাল রূপধারন করে সমগ্র বাংলাদেশ। দোসরা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বট তলায় লাল সবুজের স্বাধীন বালার পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আসম আব্দুর রব। তেসরা মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সেক্রেটারি শাহজাহান সিরাজ। সাতই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষন দান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।-“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”-বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাও বাঙ্গালির মুক্তি আন্দোলনও স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রসঙ্গে একটি পরিচ্ছন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। নেতাদের নির্দেশে আমি ঢাকা থেকে নিজ এলাকায় চলে আসি।
তেইশে মার্চ একাত্তোরে পারিকস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে-স্বাধীন বাংলাছাত্র সংগ্রাম পরিষদ “প্রটেষ্ট ডে”-প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষনা করতঃ দেশব্যাপী কর্মসূচী ঘোষনা করেন। ঐ দিন বিকাল তিনটায় চৌমুহনা চত্বরে মহকুমা ছাত্রলীগের আহবানে প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচী আহবান করা হলে চৌমুহনা চত্বরে এক বিশাল ছাত্রগণ জমায়েত অনুষ্টিত হয়। মহকুমা ছাত্রলীগের নব নির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নূরুল ইসলাম মুকিতের পরিচালায় অনুষ্টিত সেই সভায় আমাকে সদ্য প্রাক্তন সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে প্রধান অতিথি নির্বাচিত করা হয়। তখন আমি কড়া শ্লোগান এবং উত্তপ্ত বক্তৃতা দিতাম। উনসত্তোরের ছাত্র আন্দোলনে এক সন্ধায় উত্তেজনা মূলক স্বাধীনতাপন্থী বক্তৃতা দেওয়ার পর সারা রাত আমার নাক মুখ দিয়ে অবিরাম রক্তপাত হলে আমি দূর্বল হয়ে শয্যাশায়ী হই। তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ আব্দুল হাকিম বিনা ফি-তে আমার চিকিৎসাকরে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেন। ডাঃ হাকিম স্বাধীন বাংলা পন্থী ছিলেন। অনেকটাই সুস্থ হয়ে আমি সভা সমাবেশে সক্রিয় হই। সেই সভায় ও আমি বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে জনগনকে আবেগ আপ্লুত করি এবং সেই সভার প্রধান অতিথি হিসাবে মূহুর্মূহু জয় বাংলা শ্লোগানের মাধ্যমে আমি পাকিস্তানের চানতারা খচিত জাতীয় পতাকা এবং পাকিস্তানীজাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পুড়িয়ে পূর্ব বাংলার মানচিত্র খচিত লাল সবুজের বাংলাদেশের পতাকা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি উত্তোলন করি। চৌমুহনাস্থ হাজি ইনাম কমপ্লেক্স এর দোতলায় সমশের নগর রোড নিবাসি মঞ্জু চৌধুরীর মালিকানাধীন মুক্তা ষ্টুডিও থেকেএই উড়ানো-পুড়ানোর ছবি উঠানো হয়। ভবনের মালিক হাজি ইনাম উল্লাহ্্ ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা ছালারে জিলা। ইউ পি চেয়ারম্যান ও এম পি এ। ষ্টুডিও মালিক কর্তৃপক্ষ ছিলেন পাকিস্তানী সমর্থক। ছাব্বিশে মার্চর পূর্বেই মুক্তা ষ্টুডিও ডিবি পুলিশের মাধ্যমে এই আলোক চিত্র সমূহ হানাদার পাক বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। খান সেনারা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাগে এই ছবি নিয়ে ঘোষলজ নিবাসি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু প্রফেসর বিমল কান্তি ঘোষ সুজন বাবুকে-গুন্ডা মুজিব ক্যাহা হ্যায় বাতাও-বলে অপমানিত ও নির্য্যাতন করেছে। স্বাধীনতার পর সুজন বাবু স্যার আমাদেরকে অনেক দিন এসব কথাও কাহিনী বলেছেন। তখন আমার দীর্ঘদেহী প্রায় ছ’ফুটি ফিগারে বিশাল চুল গুপ থাকায় প্রথম দর্শনে আমাকে গুন্ডা-পান্ডাই লাগত।
তেইশে মার্চ একাত্তোরে সমগ্র বাংলায়-কেন্টনমেন্ট-ছাড়া কোথাও পাকিস্তানী পতাকা উড়েনি-উঠেছে-উড়েছে লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার পতাকা। পরদিন চব্বিশে মার্চ কমলগঞ্জ থানা থেকে আমাদের কাছে সংবাদ এলো সেখানে পাকিস্তান পন্থীগণ প্রতিরোধ দিবস পালন করতে দেয়নি, স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়েনি। শুনেই আমি রাগান্বিত-উত্তেজিত হয়ে পচিশ তারিখ সমাবেশের কর্ম্মসূচী দিলাম। কেন্দ্রে আসম রব ছিলেন জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান এলাকায় আমি স্থানীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করতাম। পচিশেমার্চ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দুইনেতা খাটুয়ার মহলের আব্দুল মালিক এবং স্বাধীনতা উত্তর কালের একাধিক মেয়াদের সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মছব্বির এবং বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্ম্মিসহ সদলবলে কমলগঞ্জ যাই, রিজেষ্টারি মাঠে বিশাল জনসভায় ভাষন দেই, স্বাধীন বাংলার পতাকাউড়াই। সভা-মিছিল শেষে মহা আনন্দে সদলবলে নিজ শহরে ফিরে আসি। নিত্য নৈমিত্তিক ভাবে চৌমুহনাচত্বরে- -স্বাধীন কর স্বাধীনকর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর-শ্লোগানে এলাকা সরগরম করি। মিটিং মিছিল আনন্দ উল্লাস শেষে ঐ দিন রাত্রে আমি আমার মুসলিম কোয়ার্টারস্থ পৈত্রিক বাসগৃহে না গিয়ে রাত্রে আরেক দফা আলোচনার জন্য আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছাত্রলীগনেতা আজিজুল হক ইকবালের বাসগৃহহক ভিলায় চলে আসি এবং এখানেই রাত্রি যাপন করি।
পচিশে মার্চ একাত্তোর কাল রাত্রিতে মানবসভ্যতার সাম্প্রতিক ইতিহাসে জঘন্যতম কাজটি শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী। অপারেশন সার্চ লাইট-নামে সারা বাংলায় শুরু হয় গনহত্যা অগ্নি সংযোগ, ধর্ষন-লুন্টনের মত মানবতাবিরোধী কাজ। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালে একচৌকশ মেজর স্বদেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতায় উদ্ভোদ্ধ হয়ে ঘোষনা করেন-“আই মেজর জিয়া অনবিহাফ অফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডু-হেয়ার বাই ডিক্লিয়ার দি ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ”-। মেজর জিয়ার এই দূঃসাহসী ও ঐতিহাসিক ঘোষনা মহান মুক্তিযুদ্ধে একটি দিক নির্দেশনা দেয়। মেজর জিয়া-মেজর শফিউল্লা এবং মেজর খালেদ মোশাররফ এর নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে গঠিত হয় জেড ফোর্স, এস ফোর্স এবং কে ফোর্স। অতঃপর ১৭ইং এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে প্রবাসি সরকার গঠিত হয়। কর্নেলএম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করে সমগ্র বাংলাদেশকে এগারটি সেন্টারে বিভক্ত করে এগারোজন সেক্টার কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। সমগ্র বৃহত্তর সিলেট অঞ্জল চার ও পাঁচ নম্বর সেক্টারের অধীন ছিল। সেক্টার দ্বয়ের কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মেজর সি আর দত্ত (পরে মেজর জেনালে রি) এবং মেজর মীর শওকত আলী (পরে লেঃ জেনারেল। মন্ত্রী)। প্রথাগত যুদ্ধের পাশাপশি শত্রুর মনোবল ভাঙ্গা যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন এবং শত্রু কবলিত এলাকার অর্থনীতি বিপর্য্যস্থ করার জন্য -হিটএন্ডরান-গেরিলাপদ্ধতিতে আক্রমন করার জন্য গঠণ করা হয় বিএলএফ এর সামরীক শাখা মুজিব বাহিনী। সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। মুজিব বাহিনীর চার আঞ্চলিক অধিনায়ক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ এবং আব্দুর রাজ্জাক। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক অধিনায়ক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। (স্বাধীনতা উত্তর কালে আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। -বাংলার বানীর-সম্পাদক। পনেরোই আগষ্ট সেনা অভ্যোত্থানে সন্ত্রীক নির্মমভাবে নিহত।) প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম ভাগে বাংলা বাহিনী এগিয়ে থাকলেও হানাদার বাহিনীর বিমান হামলা মুক্তি বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। সিলেট অঞ্চলে শেরপুর সেক্টরে পাক হানাদার বাহিনী স্থলপথে পিছু হটে সিলেট বিমান বন্দরে গিয়ে জামায়েত হয়। শেরপুর সেক্টারে খান সেনারা ব্যাপক বোমা বর্শন করে এলাকাটি জ্বালিয়ে দেয়-এখনও সেই চিহ্ন বিদ্যমান।
আমি ও আমরা পিছু হটে নমৌজার মুক্তাঞ্জল অতঃপর কৈলাশহর চলেযাই। প্রথমতঃ কেলাশহর ন মৌজা ক্যেম্পে পলিটিক্যাল মোবালইজার এর দায়িত্ব পাই। অতঃপর বৃহত্তর সিলেটের রাজনৈতিক বিশেষ ব্যাচ এর অধিনায়ক হিসাবে লোহার বন্দে সামরীক প্রশিক্ষন গ্রহন করতঃ চার নম্বর সেক্টারে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করি।
নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে অবশেষে আসে চুড়ান্ত বিজয়। স্বাধীনতা-আমার স্বাধীনতা।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। সতেরো সালে মাহান মুক্তিযুদ্ধের ছয়চল্লিশ বৎসর শেষে এখনও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। গনতন্ত্র, সুশাসন সামাজিক ন্যায় বিচার একটি জ্ঞান ভিত্তিক সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠন ছিল মহান স্বাধীনতার সংগ্রামের মূল চেতনা। যা এখনও অপূরনই রয়ে গেছে। ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে সকল শহীদানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি, বীর সহযোদ্ধাগণকে সংগ্রামী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
(লেখক: সেক্রেটারী, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিওর এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট)

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com