জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা ইসলাম ও মানবতার শত্রু
এহসান বিন মুজাহির॥ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস নিয়ে দেশ-বিশ্ব আতঙ্কিত। জঙ্গিরা কখন-কোথায় হামলা করে এনিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় জাতি। সম্প্রতি নতুন করে আইএসের উত্থান এবং বিভিন্ন দেশে তাদের সংঘাত ও জাল বিস্তার চলছে। দিনে দিনে দেশে দেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্ক বিস্তার ও হামলার পর হামলা জটিল ও বহুমুখী সংকটে পরিণত হয়েছে। একদিকে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে আইএসের মতো সন্ত্রাসবাদী গ্রূপগুলো ব্রিডিং জোন হিসেবে টার্গেট করছে, অন্যদিকে তারা তাদের বিরোধী শক্তিধর দেশগুলোকে টার্গেট করেও হামলা অব্যাহত রাখছে। তাই গোটা বিশ্বেই তাদের টার্গেটের জাল বিস্তার করেছে এই জঙ্গি সন্ত্রাসবাদ। যখন যেখানে সুযোগ পাবে সেখানেই হামলা করবে, বিশ্ববাসী কেউ কোথাও নিরাপদ নয়। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মাথাচড়া দিয়ে ওঠেছে। তারা একের পর এক ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ইস্যু জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস। দিবগত রাত ১ জুলাই শুত্রুবার রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা অতর্কিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা চালায়। হামলায় দুই পুলিশ সদস্যসহ দেশি-বিদেশি ২০ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি।
বৃহস্পতিবার ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গিরা হামলা চালায়। সন্ত্রাসী হামলায় দুই পুলিশ সদস্য সহ চারজন নিহত হয়েছে। ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রায় চারশ গজ পশ্চিমে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছে পুলিশের ওপর জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার ১৪ জুলাই ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় নিস শহরেজঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলায় ৮৪ জন নিহত হয়েছেন।
ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতকে কলঙ্কিত করতেই ইসলাম ধর্মের নামে তথাকথিত মুসলিম নামধারী জঙ্গিরা একের পর এক সন্ত্রাসী-জঙ্গি কর্মকা- অব্যাহত রেখে চলেছে। জঙ্গিদের আক্রমনে মরছে সাধারণ মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্পদ, ইসলাম। জঙ্গিরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভিন্ন ধরনের জঘন্য কর্মকান্ড সংগঠিত করে ইসলাম ও মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয় এবং দেশ-জাতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। তাদের এহেন কার্যক্রম ইসলাম কখনো অনুমোদন কর না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা ও মহান আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করা। ইসলামের সাথে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্বের এমনকি বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত ইসলামী সংগঠন, কোন মাদরাসা, প্রকৃত আলেম-ওলামা,পীর-মাশায়েখগণ কোন ধরনের জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত নেই। মাদরাসার আলেম-ওলামা এবং ইসলামী নেতৃবৃন্দসহ সচেতন ধর্মপ্রাণ প্রত্যেক মানুষই সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের ঘৃণা করে। জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসী তৎপরতা দিয়ে বাংলাদেশে বা বিশ্বে কখনো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ইসলাম তার অন্তর্নিহিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সম্প্রীতি, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বোমাবাজী, আত্মঘাতি হামলা, রক্তপাত, জঙ্গিবাদ কিংবা সন্ত্রাসের মাধ্যমে নয় ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। বাংলাদেশসহ বিশ্বে নতুন গজিয়ে ওঠা কিছু সংগঠন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিচ্ছে। তারা জিহাদের নামে ইসলামের নামে বিভিন্ন অরাজকতামূলক কর্মকান্ড সংগঠিত করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ হারাম। বোমাবাজি, মানুষ হত্যা, সন্ত্রাস, ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি ও আত্মঘাতী তৎপরতা ইত্যাদি ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যারা এগুলো করছে তারা বিভ্রান্ত, ইসলাম বিরোধীদের ক্রীড়নক। পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণেই এই নব্য সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের উত্থান। আই.এস নামধারী জঙ্গি সংগঠনটি সম্প্রতি বেশ কটি জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় বেশ আলোচনায় চলে এসেছে। বর্তমানে মুসলিম অমুসলিম প্রায় সকলে ইসলাম ধর্মের নামে যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করা হচ্ছে তাকে সন্ত্রাসবাদ না বলে জঙ্গিবাদ বলেই আখ্যায়িত করছে। জঙ্গি বা জঙ্গিবাদ নামে কোন খবর প্রকাশিত হলে ধরে নিচ্ছে এটা মুসলিমদের কা-। শুধু তাই নয়, ধরে নেয়া হয় যারা সুন্নতি লিবাস পরিধান করে, দাড়ি রাখে, টুপি পরে তারাই সাধারণত এই কাজের সাথে জড়িত। আসলে তারা প্রকৃত মুসলমান নয়। ধরছে মুসলমানদের বেশ।
আই.এসসহ নামে-বনামে বেশ কটি সংগঠন নানা সন্ত্রাসী-জঙ্গি কর্মকা-ের মাধ্যমে পবিত্র ধর্ম ইসলাম, মুসলিম উম্মাহকে নানভাবে কলঙ্কিত ও দেশ-জাতির বিরাট ক্ষতিসাধরে হীন চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে। আইএসের নেতাকর্মীরা সত্যিকার ইসলামপন্থি, ইসলাম প্রচারক ও দ্বীনি আন্দোলনকারীদের বিতর্কিত করতে জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ ইসলামী দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নতির পথ রোধ করতে এবং এসব দেশে তাদের সামরিক আধিপত্য বিস্তাারের লক্ষ্যে একে কাজে লাগাচ্ছে। ইসলাম নামধারী জঙ্গি সংগঠনগুলো হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ও ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য আদর্শের উগ্র উন্মাদনায় মেতে ওঠে। পার্থিব-অপার্থিব কল্যাণের অলীক আশায় সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা তাদের হীন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য কিছু বিভ্রান্ত তরুণ মুসলমানকে এহেন কাজে ব্যবহার করছে। কিছু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মেধাবী উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেদের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে। অল্প সংখ্যক মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থী বুঝে হোক না বুঝে হোক তাদের সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। অথচ এসকল নামীদামী ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের অনুধাবন করা উচিত ছিলো যে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনো জঙ্গি, সন্ত্রাসী, বোমাবাজি, হত্যা, গুপ্তহত্যা, আত্মঘাতী হামলাসহ কোন ধরনের ফেতনা-বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা সমর্থন করে না। পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণে হোক কিংবা দুনিয়ার লোভ-লালসা, স্বার্থ হাসিল বা আন্য যে কোনো কারণে হোক যারাই এই পথে পা বাড়িয়েছে তারা জঘন্যতম অপরাধে জড়িত হয়ে দুনিয়ায় আরাজকতা সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিচ্ছে। যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
বিশ্বের সকল বরেণ্য আলেম-ওলামা, পীর-মাশাযেখ, ইসলামী চিন্তাবিদগণ এবং মূলধারার সকল ইসলামী সংগঠন ও সংস্থা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, এধরনের ব্যক্তিরা বিভ্রান্ত, বিপথগামী। এরা ইসলামের শত্রুদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। ইসলামের শত্রুরা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ওরা এদেরকে ইসলামের ভাব-মর্যাদা ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করছে। এসকল ব্যক্তি কোনভাবেই ইসলামের জন্য কল্যাণকর হতে পারেনা। তারা ইসলামকে বিশ্ববাসীর সামনে বিকৃত ও কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়। পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ, রক্তপাত, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, সৃষ্টিকরাই ওদের উদ্দেশ্য। অথচ দুনিয়ায় ফেতনা-ফাসাদ, রক্তপাত, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা, মানুষ হত্যা, যেকোনো ধর্ম, মতাদর্শ ও সভ্যতাবিরোধী। ফেতনা-ফাসাদ, অরাজকতা, ত্রাস সৃষ্টি করাকে ইসলাম ধর্মে পরিস্কার হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। মূলত কোনো ধর্ম, মতবাদ বা আদর্শ সহিংসতা বা সন্ত্রাস শিক্ষা দেয় না। গুলশান ও শোলাকিয়ায় ঘটে যাওয়া অতর্কিত সন্ত্রাসী-জঙ্গি হামলার ঘটনা দেশের সচেতন কোন নাগরিক সমর্থন করতে পারেনি। সরকার থেকে নিয়ে আলেম-ওলামা, ইসলামী দলসমুহ এবং সাধারন জনগণও এর প্রতিবাদ করেছে। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন সাইটে জোরালো প্রতিবাদ করতে দেখা যায় দেশের নাগরিকদের। জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদ ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করার আহবান জানিয়ে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন, রাজনীতিক সংগঠন, সাংবাদিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমুহের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি মানবন্ধন-প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর চোখে পড়েছে। ঢাকার গুলশান, কিশোরগন্জের শোলাকিয়াসহ ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাদরাসা হাটহাজারী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিচালক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর ও বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ মুফতি আহমদ শফি, বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মসজিদের ইমাম শায়খুল হাদিস আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদসহ দেশের বরেণ্য আলেম-ইসলামী চিন্তাবিদ এবং বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নিন্দা জ্ঞাপন ও প্রতিবাদ জানিয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের মোকাবিলার আহবান জানিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবাদ পাঠিয়েছেন। দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদসহ সরকার দলের এমপি-মন্ত্রী এবং বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দরা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলার আহ্বান করেছেন। কোনো ব্যক্তি, দল, বা দেশের পক্ষে একক চেষ্টায় এ সমস্যার সমাধান করা দুরূহ ব্যাপার। বাংলাদেশসহ সব দেশকে সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। যে কোনো মুল্যেই হোক ইসলাম বিদ্বেষীদেও প্রেতাত্মা সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের মোকাবিলা করতে হবে।
মন্তব্য করুন