জয়িতা অন্বেষণ-২০২৪ বড়লেখায় ‘অদম্য নারী পুরস্কার’ প্রাপ্ত নারীদের বীরত্বগাথা

আব্দুর রব : শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী: জুবেদা বেগম ১৯৯৪ সালের ১৬ এপ্রিল মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ৭ (সাত) ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৪র্থ সন্তান। পারিবারিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। মোটামুটিভাবে সংসার চলে যাচ্ছিল। বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়ায় সংসারের অবস্থা করুন হয়ে পড়ে। কোন মতে সংসার চলে। এ অবস্থায় পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া জুবেদা বেগমের অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তারপরেও সকল বাঁধা পেরিয়ে তিনি ২০১১ সালে সফলতার সাথে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করে অনেক দূর এগিয়ে যাবেন, কিন্তু ২০১৮ সালের একটি দূর্ঘটনায় তার ডান হাত অকেজো হয়ে যায়। এর ফলে তিনি আর অনার্স কমপ্লিট করতে পারেন নাই। এরপর তার বিবাহ হয়ে যায় এবং তিনি ২ সন্তানের মা হন। স্বামীর সাথে বনিবনা হলো না। হাত অকেজো হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে স্বামী ২য় বিবাহ করলেন। তিনি স্বামীর বাড়ী হতে ২ সন্তানসহ বিতাড়িত হলেন। স্বামী তার এবং তার সন্তানদের খোঁজ খবর ও ভরণ পোষণ দেন না। এই পরিস্থিতিতে জুবেদা বেগম তার সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি একটি বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতার চাকরী নেন। শিক্ষকতা করে তিনি নিজের ও সন্তানদের যাবতীয় ভরণ পোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ডান হাতটি অকেজো থাকার পরেও তিনি দমে জাননি। দৃঢ় মনোবল অদম্য ইচ্ছা শক্তি তাকে জীবন যুদ্ধে জয়ী করেছে। জুবেদা বেগমের জীবন সংগ্রাম, তার পথ চলা, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে তার সাফল্য নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুকরনীয় এবং অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাই শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসাবে তিনি সমাজের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী: জীবন সংগ্রামে লড়াই করা এক নারী হলেন আমিনা বেগম ডলি। একজন সমাজ সেবক হিসাবে আমিনা বেগম ডলি এলাকার যে কোন সমস্যা সমাধানে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক বিরোধী আন্দোলন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয় গুলিতে তিনি সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। সমাজের পিছিয়ে পরা নারীদের জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। ৫ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বিভিন্ন বাধা প্রতিবন্ধকতা ও পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা এবং গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশে থেকেওে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। পারিবারিক সংকীর্ণতা ও আত্মীয়স্বজনের চাপে তাকে অল্প বয়সেই বিয়ে দেয়া হয়। বিবাহের পরও তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যান। তিনি তার স্বামীকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেণ এবং সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন। এভাবে তিনি ২০১২ সালে ফাজিল পরীক্ষায় পাশ করেন। তিনি ২০১৪ সালে মাস্টার্সে ভর্তি হন। ২০১৫ সালে তার ২য় কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। সাংসারিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারনে তিনি আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন নাই। এ সময়ে তিনি সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে এই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে টেইলারিং কাজ শুরু করেন। তিনি বড়লেখা বাজারে হাবিব মার্কেটে টেইলারিং ব্যবসা শুরু করেন। একই সাথে তিনি এলাকার অসহায় দুস্থ্য মেয়েদেরকে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এর ফলে এই মেয়েরা এক সময়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হয়ে উঠে। তিনি তার স্বামীর অনুপ্রেরণায় ২০২০-২০২১ সেশনে এল.এল.বি-তে ভর্তি হন এবং এখনো পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সংযুক্ত থেকে এলাকার জনগণের সকল ধরণের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন এবং নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ‘নারীর জয়ে সবার জয়’ ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তিনি ঝঃৎবহমঃযবহরহম চড়ষরঃরপধষ খধহফংপধঢ়ব, উবসড়পৎধপু ওহঃবৎহধঃরড়হধষ পক্ষ থেকে ঈবৎঃরভরপধঃব ড়ভ অপযরবাবসবহঃ অধিৎফ অর্জন করেন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি দুই সন্তানের জননী। সমাজসেবায় তার স্বামী তাকে সার্বিকভাবে সহায়তা করে থাকেন। স্বামীর উৎসাহ ও প্রেরণায় তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজ অব্যহত রেখেছেন। আর্থিক দুরাবস্থার কারণে যে সকল বাচ্চারা ঠিকমত লেখাপড়া করতে পারেনা তিনি তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করেন এবং শিক্ষা উপকরণ প্রদান করেন। তিনি বিশ্বাস করেন বড়লেখার পিছিয়েপড়া মেয়েরা এক সময় স্বাবলম্বী হবেন এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হবে।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করা নারী: কেউ যদি দূরদর্শী হয়, আকাঙ্খা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, সমাধান আছে- এমন ধারনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তাহলে সাফল্য আসবেই। এমনই একজন সাহসী নারীর প্রতীক সুমনা আক্তার সিমা। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সুমনা ছিলেন মা বাবার ৩য় সন্তান। দশম শ্রেনীতে পড়া চলাকালীন অবস্থায় ২০১৩ সালে ১৫ (পনের) বছর বয়সে উত্তর আদমপুর গ্রামের বেলাল আহমদের সাথে তার বিবাহ হয়। স্বামীর সংসারে শ্বশুর শ্বাশুরী ছিল না। ছিল এক বোন ও তার এক মেয়ে। বিবাহের প্রথম বছর সবকিছু ভালোভাবেই চলতেছিল। কিন্তু এক বছর পর যখন তার ১ম সন্তান একটি কন্যা সন্তান হয়, তখন তার স্বামী ও বোন মিলে তাকে নানা ধরনের আজে বাজে কথা বলে তিরস্কার করে। বলে পাপ করেছে বলেই তার কন্যা সন্তান হয়েছে। এভাবে তিনি স্বামীর বাড়ীতে নিগৃহীত হতে লাগলেন। স্বামীর অত্যাচার এক সময় মাত্রা ছাড়ায়। স্বামী তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা শুরু করে। তিনি শেষে বাধ্য হয়ে তার মেয়েকে সাথে নিয়ে স্বামীর সংসার ত্যাগ করে বাবার বাড়ী চলে যান। বাবার বাড়ীতে একটানা ২বছর থাকলেন। এসময়ে তিনি সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ গ্রহন করলেন। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার মুরুব্বী সকলে মিলে বিচার শালিশ করে সুমনা আক্তারকে তার স্বামীর সংসারে ফেরত পাঠালেন। স্বামীর সংসারে এসে আবার নির্যাতনের শিকার হলেন তিনি। স্বামীর বোন এবং ভাগনী তার সাথে খারাপ আচরণ করে। এ কথা স¦ামীকে বল্লে স্বামী তা কানে তুলে না। স্বামীও তাদের সাথে একত্রে নির্যাতন করে। এ সময় তার একটি পুত্র সন্তান হয়। স্বামীর নির্যাতন কিছুতেই বন্ধ হয় না। এ পর্যায়ে স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়। সুমনা আক্তার সিমা তার ২সন্তানকে সাথে নিয়ে আবার বাবার বাড়ী ফিরে যান। নির্যাতনের শিকার সুমনা আক্তার সিমা জীবন সংগ্রামে নেমে পড়লেন। তিনি একটি টেইলার্স এর দোকানে কাজ নিলেন, পাশাপাশি অন্য একটি কাজও শুরু করলেন। এভাবে ১বছর চলার পর তিনি নিজেই একটি টেইলার্সের দোকান চালু করলেন। তার দোকানে ৪টি মেয়ে ও ১টি ছেলে কাজ করে। এভাবে দীর্ঘ ৫বছর কেটে গেল। এই সময়ের মধ্যে তার স্বামী একবারের জন্যেও স্ত্রী সন্তানদের কোন খোঁজ খবর নেয় নাই। তিনি একাই সংগ্রাম করে তার সন্তানদের লালন পালন করছেন, পড়ালেখা করাচ্ছেন। জীবন সংগ্রামে জয়ী একজন নারী তিনি। জীবনের যত গ্লানি, কালিমা, নির্যাতনের বিভীষিকা সমস্ত কিছু মুছে ফেলে তিনি স্বমহিমায় সামনে এগিয়ে চলেছেন। কোনো বাঁধাই তাকে রুখতে পারবে না। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করে জীবন যুদ্ধে জয়ী সুমনা আক্তার সিমা।
মন্তব্য করুন