জাকাতের বিধিবিধান
এহসান বিন মুজাহির॥ ইসলামের যাকাত বিধান ধনী গরীবে মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা। যাকাত আদায়ে ধনী গরীবের মাঝে ভালবাসা তৈরী হয়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সমাজ থেকে দারিদ্রতা দূর হয়। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন, ‘যারা জাকাত দেয় না তারা হলো সেসব লোক, যারা আখিরাতের প্রতিও অবিশ্বাসী’ (সূরা হামীম আসসাজদা: ৭) সূরা বাকারার ১১০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন-‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দাও’। মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন-‘ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি। এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সা: আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, হজ সম্পন্ন করা এবং রমজানের রোজা রাখা’। ঈমান আনা ও নামাজ আদায়ের পর জাকাত প্রদান করা ঈমানের দাবি। ইসলামী শরীয়তে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ এক বছর কারো নিকট আবর্তিত হলে শতকরা ২.৫০% সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরআনে বর্ণিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই জাকাত বলা হয়। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত ছয়টি: ১. মুসলমান হওয়া। ২. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন হওয়া। ৩. ঋণমুক্ত হওয়া। ৪. নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমপরিমাণ) সম্পদের মালিক হওয়া। ৫. নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। ৬. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
জাকাতের ক্ষেত্র ও নিসাব: জাকাতের ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক। প্রায় সকল প্রকার ধন সম্পদের ওপরই জাকাত ধার্য করা হয়েছে। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, কৃষিজ উৎপাদন, ব্যবসায়ের পণ্য, গৃহপালিত পশুসহ প্রায় সব কিছুই জাকাতের আওতায় আসে। জাকাতের হার শরীয়তের বিধান দ্বারা নির্দিষ্ট। একে মানুষের ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়নি। জাকাতক্ষেত্র অনুযায়ী যাকাত প্রদানের পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন। (জাকাত কোন ক্ষেত্রে ২.৫ ভাগ। কোনো ক্ষেত্রে ৫ ভাগ, কোন ক্ষেত্রে ১০ ভাগ)। ফকীহগণের সর্বসম্মতিক্রমে স্বর্ণে জাকাতের নিসাব ২০ মিসকাল বা সাড়ে সাত ভরি, তথা ৮৭.৪৫ গ্রাম। এর কম হলে যাকাত দিতে হবে না। কারো নিকট ২০ মিসকাল পরিমাণ স্বর্ণ যদি একবছর অতিক্রম করে তবে তাতে অর্ধ মিসকাল স্বর্ণ জাকাত ওয়াজিব হবে। (নূরুল আনওয়ার, শরহে বিকায়া) ৫২ তোলা রুপা অথবা ৭.৫০ তোলা সোনা অথবা সমপরিমাণ অর্থ। শর্ত হলো নেসাব পরিমাণ সম্পদ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। উপরিউক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ যার আছে তার ওপর জাকাত ফরজ। তবে গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বারক্ষেত্রে জাকাত আদায়পদ্ধতি ভিন্ন। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী ছাড়াও মহিলাদের অলঙ্কারের জাকাত আদায় করা ওয়াজিব। নাবালেগের সম্পদের জাকাত অভিভাবক আদায় করবেন। ব্যবসায়িক পণ্যে জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে দোকান বা গুদামে মজুতকৃত সব পণ্যের মূল্যমান হিসাব করে জাকাত আদায় করতে হবে। শিল্প-কারখানায় প্রস্তুতকৃত পণ্যসামগ্রীর ওপরও জাকাত আদায় ওয়াজিব। অবশ্য কারখানার ভূমি, বিল্ডিং, মেশিনারি, গাড়ি ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। আনুমানিক থোক বরাদ্দের মতো আন্দাজে একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দান করলে জাকাত আদায় হবে না। সম্পদেও হিসাব করে পরিমাণমতো জাকাত আদায় করতে হবে।
জাকাতের হকদার: কাছের আত্মীয়স্বজন যারা আর্থিকভাবে দুর্বল, তারা জাকাতের বেশি হকদার। যারা জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত কুরআনের আলোকে তারা হচ্ছে নিঃস্ব, অভাবী, জাকাত সংগ্রহে নিযুক্ত কর্মী, নও মুসলিম, ঋণী, মুক্তিপ্রত্যাশী দাস-দাসী, মুজাহিদ ও মুসাফির। আল্লাতায়ালা কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় জাকাতের হকদ্বার সর্ম্পকে বলে দিয়েছেন।তিনি বলেন, ‘নিশ্চই সদকাহ হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্থদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’। (সূরা তাওবা: ৬০)
জাকাতের খাত: জাকাতের খাত আটটি: ১.ফকির। ২. মিসকিন। ৩. যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি ৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব। ৫.দাসমুক্তি ৬. ফি সাবিলিল্লাহ। ৭. ঋণগ্রস্থ। ৮. মুসাফির।
জাকাতের টাকা একজনকে অথবা খুচরা করে অনেকজনকে দেয়া যাবে। তবে ১০০ জনকে খুচরা টাকা, শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো করে ব্যবস্থা করে দিতে পারলে (যেমন একটি দুধের গাভী কিনে দিলেন, দোকান করে দিলেন, অন্য কোনো ব্যবসার পুঁজি করে দিলেন) তা দারিদ্য বিমোচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। পিতা-মাতা-দাদা-নানা-স্ত্রী-সন্তানদের জাকাত দেয়া যায় না। মসজিদ ও মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের জন্য জাকাত দেয়া যায় না। তবে গরিব মাদরাসার ছাত্রদের জাকাত দেয়া যাবে। জাকাত রমজান মাসেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুবিধামতো অর্থবছর নির্ধারণ করে নিয়ে প্রতি বছর সেই হিসাব মোতাবেক জাকাত আদায় করা যায়। তবে রমজানে দানের সওয়াব যেহেতু বেশি, তাই বেশির ভাগ মুসলমান রমজানে জাকাত আদায় করে থাকেন। জাকাত প্রদানের আগে প্রত্যেকের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেয়া জরুরি। নিয়ত শুদ্ধ না থাকলে জাকাত আদায় কবুল হবে না। মহান আল্লাহতাআলা আমাদেরকে জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে যথযথভাবে জাকাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: সাংবাদিক, আলেম, কলামিস্ট
মন্তব্য করুন