জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ
এহসান বিন মুজাহির॥ জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ এবং গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও। নামাজ, রোজার মতো জাকাতও একটি ফরজ বিধান। জাকাত কোনো ঐচ্ছিক আমল বা ইবাদত নয়, এটা অবশ্য পালনীয়। তবে জাকাত আদায় সব মুসলমানের ওপর ফরজ নয়, যেমন হজ আদায় সবার জন্য ফরজ নয়। এক্ষেত্রে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা জরুরি। যখন কোনো ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় ঠিক তখন থেকে যখন গিয়ে এক বছর পূর্ণ হবে তখন জাকাত আদায় করা ফরজ। হজরত আবুবকর সিদ্দিকের (রা.) যুগে জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। সচ্ছল এবং সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও জাকাত কেউ না দিলে মারাত্মক গোনাহগার হবে। কিন্তু জাকাতের বিধান অস্বীকার করলে ঈমানহারা হয়ে যাবে। শরীয়ত নির্ধারতি নিয়মে যথাযথভাবে জাকাত আদায় করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর ফরজ দায়িত্ব। ইসলামের জাকাত বিধান ধনী গরীবের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা। জাকাত আদায়ে ধনী গরীবের মাঝে ভালোবাসা তৈরী হয়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সমাজ থেকে দারিদ্রতা দূর হয়।
আভিধানিক অর্থে জাকাতের অর্থ হল, বৃদ্ধি করা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। জাকাত প্রদানের মাধমে সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয় এবং মালের মধ্যে বরকত বৃদ্ধি পায়। শরয়ী পরিভাষায়, জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন মিটানোর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর কাল সঞ্চিত থাকলে, শরীয়তের নির্ধারিত সম্পদের একাংশ শরীয়ত নির্ধারিত খাতে কোন প্রকার বিনিময় ছাড়া মালিকানা হস্তান্তর করাকে জাকাত বলে। ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন ও হাদিসে জাকাত প্রদানের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে যারা অবনত হয়’। (সূরা বাকারা : ৪৩)। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘তাদের ধন-মালে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অধিকার প্রার্থী ও বঞ্চিত মানুষের জন্য’। (সূরা মাআরিজ :২৪)। আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং রাসুলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও’। (সূরা নূর : ৫৬)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো এরশাদ করেছেন, ‘আর যারা সোনা ও রুপা সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ প্রদান করুন। সেদিন ঐসব (সোনা-রুপা) দোযখের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তদ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশ এবং তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। এটা তোমরা নিজেদের জন্য যা সঞ্চয় করেছিলে তার প্রতিফল। সুতরাং যা তোমরা সঞ্চিত করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর’। (সূরা তাওবাহ : ৩৪-৩৫)। অনুরুপভাবে আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেন, ‘তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নিয়ে এসেছে? তারা বলবে আমরা নামায পড়তাম না এবং অভাবগ্রস্থকে আহার্য (যাকাত) দিতাম ন’। (সূরা মুদাসসির : ৪২-৪৪)। কুরআন কারীমের সূরায়ে বাকারার ২৭৬ নাম্বার আয়াতে এরশাদ হয়েছে -আল্লাহতায়ালা সদুকে নির্মূল করে দেন আর জাকাত-সদকাকে বাড়িয়ে দেন। জাকাত দানের মাধ্যমে জাকাতদাতার সম্পদ ও আত্মা পবিত্র হয়। পবিত্র কোরআনের সূরা তাওবার ১০৩ নাম্বার আয়াতে এরশাদ হয়েছে-‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দোয়া করবেন’। যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ। যারা স্বীয় ধন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, এরপর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না, তাদেরই জন্যে তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদেও কোনো আশঙ্কা নেই, তারা চিন্তিতও হবে না (সুরা বাকারা :২৬১-২৬২)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লা (সা.) বলেছেন, ‘যেসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তা হতে তার হক (জাকাত) আদায় করে না, যখন কিয়ামতের দিন আসবে নিশ্চয়ই তার জন্য অনেকগুলো আগুনের পাত তৈরী করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। আর তা দ্বারা তার পাঁজরে, ললাটে এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই পৃথক করা হবে তখনই পুনরায় তা শুরু করা হবে। তার এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে সেদিন পর্যন্ত যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। যতক্ষণ না বান্দাদের সকলের বিচার ফয়সালা শেষ করা হবে এবং প্রত্যেক নিজ নিজ পথ ধরবে, হয় বেহেশতের দিকে না হয় দোজখের দিকে’। (মুসলিম, হাদিস নং-১৬৮১)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) হযরত মুআজ (রা.) কে গর্ভনর হিসেবে ইয়েমেনে প্রেরণ করলেন। এ সময় রাসুল (সা.) তাকে বললেন, তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। প্রথমত তুমি তাদেরকে এ কথার সাক্ষ্য দিতে আহব্বান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ তথা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। অত:পর তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তায়ালা দিবারাতে তাদের উপর পাঁচওয়াক্ত নামায ফরজ করে দিয়েছেন। তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর যাকাত প্রদান করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে বন্টন করা হবে’। (মুসলিম :১৬৮০)। ইসলামী শরীয়তে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ এক বছর কারো নিকট আবর্তিত হলে শতকরা ২.৫০% সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরআনে বর্ণিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই জাকাত বলা হয়।
জাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত: জাকাতফরজ হওয়ার জন্য শর্ত হলো ছয়টি। ১. মুসলমান হওয়া। ২. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন হওয়া। ৩. ঋণমুক্ত হওয়া। ৪. নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমপরিমাণ) সম্পদের মালিক হওয়া। ৫. নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। ৬. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
জাকাতের ক্ষেত্র ও নিসাব: জাকাতের ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক। প্রায় সকল প্রকার ধন সম্পদের ওপরই জাকাত ধার্য করা হয়েছে। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, কৃষিজ উৎপাদন, ব্যবসায়ের পণ্য, গৃহপালিত পশুসহ প্রায় সব কিছুই জাকাতের আওতায় আসে। জাকাতের হার শরীয়তের বিধান দ্বারা নির্দিষ্ট। একে মানুষের ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়নি। জাকাতক্ষেত্র অনুযায়ী জাকাত প্রদানের পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন (জাকাত কোন ক্ষেত্রে ২.৫ ভাগ। কোনো ক্ষেত্রে ৫ ভাগ, কোন ক্ষেত্রে ১০ ভাগ)। ফকীহগণের সর্বসম্মতিক্রমে স্বর্ণে জাকাতের নিসাব ২০ মিসকাল বা সাড়ে সাত ভরি, তথা ৮৭.৪৫ গ্রাম। এর কম হলে যাকাত দিতে হবে না। কারো নিকট ২০ মিসকাল পরিমাণ স্বর্ণ যদি একবছর অতিক্রম করে তবে তাতে অর্ধ মিসকাল স্বর্ণ জাকাত ওয়াজিব হবে। (নূরুল আনওয়ার, শরহে বিকায়া)। ৫২ তোলা রুপা অথবা ৭.৫০ তোলা সোনা অথবা সমপরিমাণ অর্থ। শর্ত হলো নেসাব পরিমাণ সম্পদ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। উপরিউক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ যার আছে তার ওপর জাকাত ফরজ। তবে গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে জাকাত আদায়পদ্ধতি ভিন্ন। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী ছাড়াও মহিলাদের অলঙ্কারের জাকাত আদায় করা ওয়াজিব। নাবালেগের সম্পদের জাকাত অভিভাবক আদায় করবেন। ব্যবসায়িক পণ্যে জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে দোকান বা গুদামে মজুতকৃত সব পণ্যের মূল্যমান হিসাব করে জাকাত আদায় করতে হবে। শিল্প-কারখানায় প্রস্তুতকৃত পণ্যসামগ্রীর ওপরও জাকাত আদায় ওয়াজিব। অবশ্য কারখানার ভূমি, বিল্ডিং, মেশিনারি, গাড়ি ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। আনুমানিক থোক বরাদ্দের মতো আন্দাজে একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দান করলে জাকাত আদায় হবে না। সম্পদেও হিসাব করে পরিমাণমতো জাকাত আদায় করতে হবে।
জাকাতের হকদার: কাছের আত্মীয়স্বজন যারা আর্থিকভাবে দুর্বল, তারা জাকাতের বেশি হকদার। যারা জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত কুরআনের আলোকে তারা হচ্ছে নিঃস্ব, অভাবী, জাকাত সংগ্রহে নিযুক্ত কর্মী, নও মুসলিম, ঋণী, মুক্তিপ্রত্যাশী দাস-দাসী, মুজাহিদ ও মুসাফির। আল্লাতায়ালা কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় জাকাতের হকদ্বার সর্ম্পকে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চই সদকাহ হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্থদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’। (সূরা তাওবা: ৬০)।
জাকাতের খাত: জাকাতের খাত আটটি: ১.ফকির। ২. মিসকিন। ৩. জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি। ৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব। ৫. দাসমুক্তি ৬. ফি সাবিলিল্লাহ। ৭. ঋণগ্রস্থ। ৮. মুসাফির। জাকাতের টাকা একজনকে অথবা খুচরা করে অনেকজনকে দেয়া যাবে। তবে ১০০ জনকে খুচরা টাকা, শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো করে ব্যবস্থা করে দিতে পারলে (যেমন একটি দুধের গাভী কিনে দিলেন, দোকান করে দিলেন, অন্য কোনো ব্যবসার পুঁজি করে দিলেন) তা দারিদ্য বিমোচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। পিতা-মাতা-দাদা-নানা-স্ত্রী-সন্তানদের জাকাত দেয়া যায় না। মসজিদ ও মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের জন্য জাকাত দেয়া যায় না। তবে গরিব মাদরাসার ছাত্রদের জাকাত দেয়া যাবে। জাকাত রমজান মাসেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুবিধামতো অর্থবছর নির্ধারণ করে নিয়ে প্রতি বছর সেই হিসাব মোতাবেক জাকাত আদায় করা যায়। তবে রমজানে দানের সওয়াব যেহেতু বেশি, তাই বেশির ভাগ মুসলমান রমজানে জাকাত আদায় করে থাকেন। জাকাত প্রদানের আগে প্রত্যেকের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেয়া জরুরি। নিয়ত শুদ্ধ না থাকলে জাকাত আদায় কবুল হবে না। মহান আল্লাহতাআলা আমাদেরকে জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে যথযথভাবে জাকাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল।
মন্তব্য করুন