জাকাত : গরিব দুঃখীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার
অধ্যক্ষ এহসান বিন মুজাহির॥ জাকাত ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ। নামাজ, রোজার মতোই ফরজ। তবে ঢালাওভাবে সবার ওপর নয়। নিসাব পরিমাণ মালের মালিকের ওপরই শুধু জাকাত ফরজ। মনে রাখতে হবে, জাকাত কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন নয়; বরং গরিব দুঃখীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার এটি। শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মে যথাযথভাবে জাকাত আদায় করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর ফরজ দায়িত্ব।
আভিধানিক অর্থে জাকাতের অর্থ হলো, বৃদ্ধি করা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয় এবং মালের মধ্যে বরকত বৃদ্ধি পায়। শরয়ী পরিভাষায়, জীবনযাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন মিটানোর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর সঞ্চিত থাকলে, শরিয়তের নির্ধারিত সম্পদের একাংশ শরিয়ত নির্ধারিত খাতে কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়া মালিকানা হস্তান্তর করাকে জাকাত বলে।
ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব : ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন ও হাদিসে জাকাত প্রদানের জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং নামাজে অবনত হও তাদের সাথে যারা অবনত হয়’। (সূরা বাকারা: ৪৩)। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘তাদের ধনমালে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অধিকার। প্রার্থী ও বঞ্চিত মানুষের জন্য’। (সূরা মাআরিজ :২৪)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং রাসূল সা:-এর আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও’। (সূরা নূর : ৫৬)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো এরশাদ করেছেন, ‘আর যারা সোনা ও রুপা সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ প্রদান করুন। সে দিন ওই সব (সোনা-রুপা) দোজখের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তদ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশ এবং তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। এটা তোমরা নিজেদের জন্য যা সঞ্চয় করেছিলে তার প্রতিফল। সুতরাং যা তোমরা সঞ্চিত করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ করো’। (সূরা তওবাহ : ৩৪-৩৫)।
অনুরূপভাবে আল্লাহপাক আরো এরশাদ করেন, ‘তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নিয়ে এসেছে? তারা বলবে আমরা নামাজ পড়তাম না এবং অভাবগ্রস্তকে আহার্য (জাকাত) দিতাম না’। (সূরা মুদাসসির : ৪২-৪৪)।
শুধু কোরআন নয়, হাদিসেও জাকাত আদায়ে গুরুত্ব ও অনাদায়ে ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যেসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তা হতে তার হক (জাকাত) আদায় করে না, যখন কিয়ামতের দিন আসবে নিশ্চয়ই তার জন্য অনেকগুলো আগুনের পাত তৈরি করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। আর তা দ্বারা তার পাঁজরে, ললাটে এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই পৃথক করা হবে তখনই পুনরায় তা শুরু করা হবে। তার এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে সে দিন পর্যন্ত যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান। যতণ না বান্দাদের সবার বিচার ফয়সালা শেষ করা হবে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ পথ ধরবে, হয় বেহেশতের দিকে না হয় দোজখের দিকে’। (মুসলিম, হাদিস নং : ১৬৮১)।
জাকাতের ক্ষেত্র ও নিসাব : জাকাতের ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক। প্রায় সব ধরনের ধনসম্পদের ওপরই জাকাত ধার্য করা হয়েছে। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, কৃষিজ উৎপাদন, ব্যবসায়ের পণ্য, গৃহপালিত পশুসহ প্রায় সব কিছুই জাকাতের আওতায় আসে। জাকাতের হার শরিয়তের বিধান দ্বারা নির্দিষ্ট। একে মানুষের ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়নি। জাকাত ত্রে অনুযায়ী জাকাত প্রদানের পদ্ধতিও ভিন্ন। (জাকাত কোনো ক্ষেত্রে ২.৫ ভাগ। কোনো ক্ষেত্রে ৫ ভাগ, কোনো ক্ষেত্রে ১০ ভাগ)।
ফকিহগণের সর্বসম্মতিক্রমে স্বর্ণে জাকাতের নিসাব ২০ মিসকাল বা সাড়ে সাত ভরি, তথা ৮৭.৪৫ গ্রাম। এর কম হলে জাকাত দিতে হবে না। কারো কাছে ২০ মিসকাল পরিমাণ স্বর্ণ যদি এক বছর অতিক্রম করে তবে তাতে অর্ধ মিসকাল স্বর্ণ জাকাত ওয়াজিব হবে।
৫২ তোলা রুপা অথবা ৭.৫০ তোলা সোনা অথবা সমপরিমাণ অর্থ। শর্ত হলো নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া। উপরিউক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ যার আছে তার ওপর জাকাত ফরজ। তবে গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে জাকাত আদায় পদ্ধতি ভিন্ন।
জাকাতের হকদার : আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় জাকাতের হকদ্বার সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চই সদকাহ হচ্ছে, ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আজাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর প থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’। (সূরা তওবা : ৬০)।
জাকাতের খাত : জাকাতের খাত ৮টি : ১.ফকির; ২. মিসকিন; ৩. জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি; ৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব; ৫. দাসমুক্তি; ৬. ফি সাবিলিল্লাহ; ৭. ঋণগ্রস্ত; ৮. মুসাফির। উপরিউক্ত ৮টির মধ্যে সবচেয়ে প্রাপ্যের অগ্রাধিকার হচ্ছে, ফকির ও মিসকিন। অর্থাৎ সমাজের দরিদ্র শ্রেণি।
জাকাতের টাকা একজনকে অথবা খুচরা করে অনেকজনকে দেওয়া যাবে। তবে ১০০ জনকে খুচরা টাকা, শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো করে ব্যবস্থা করে দিতে পারলে (যেমন একটি দুধের গাভী কিনে দিলেন, দোকান করে দিলেন, অন্য কোনো ব্যবসার পুঁজি করে দিলেন) তা দারিদ্য বিমোচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে।
জাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্যবিমোচন। এমন প্রক্রিয়ায় জাকাত দেয়া সমীচীন নয় যাতে গরিব গরিবই থেকে যায় এবং প্রতি বছর সে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে। একজন জাকাতদাতা কোনো গরিব ব্যক্তিকে ১০ কেজি চাল বা একটি শাড়ি বা কিছু টাকা বা এই জাতীয় কিছু দিলো, সে কয়েকদিনে টাকা বা চাল শেষ করে দিলো, কাপড়টি সে পরিধান করে পুরনো করে দিলো। ফলে সে গরিবই থেকে গেল। জাকাতের অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান করা উচিত যাতে সে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসার পরিচালনা করতে পারে।
কারজাভী ইমাম বায়হাকী (রা.) ‘আদদালায়েল’ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, হজরত ওমর বিন আজিজ রা:-এর শাসনামলে জাকাত দেয়ার মতো লোক খোঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। জাকাত দেয়ার মতো লোকের অভাব ছিল না, বরং জাকাত নেয়ার মতো লোকের অভাব ছিল। কিন্তু আমাদের সমাজে জাকাত নেয়ার মতো লোকের অভাব নেই। কিন্তু অভাব জাকাত দেয়ার মতো লোকের।
দরিদ্রকে কি পরিমাণ জাকাত দিতে হবে এ সম্পর্কে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ‘উমার (রা:) বলেন- ‘যখন তোমরা দিবে তখন ধনী বানিয়ে দাও’। পিতা-মাতা-দাদা-নানা-স্ত্রী-সন্তানদের জাকাত দেওয়া যাবে না। মসজিদ ও মাদরাসা ভবন নির্মাণের জন্য জাকাত দেওয়া যাবে না। তবে মাদরাসার এতিম ও গরিব শিক্ষার্থীদের জাকাত দেওয়া যাবে।
জাকাত রমজান মাসেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুবিধামতো অর্থবছর নির্ধারণ করে নিয়ে প্রতি বছর সেই হিসাব মোতাবেক জাকাত আদায় করা যায়। তবে রমজানে দানের সওয়াব যেহেতু বেশি, তাই বেশির ভাগ মুসলমান রমজানে জাকাত আদায় করে থাকেন।
জাকাত প্রদানের আগে প্রত্যেকের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেওয়া জরুরি। নিয়ত শুদ্ধ না থাকলে জাকাত আদায় কবুল হবে না। মহান আল্লাহ তাআলা জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্টদের যথযথভাবে জাকাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক ঐক্য পরিষদ, শ্রীমঙ্গল
মন্তব্য করুন