জালালাবাদ এসোসিয়েশন, ঢাকা ঃ রাজধানীতে বৃহত্তর সিলেট বাসির আপন ঠিকানাঃ বার্ষীক নির্বাচনী ভাবনাঃ কতেক বিনীত প্রস্তাবনা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব-সামাজিক জীব ও বটে। সংঘবদ্ধ-সামাজিক জীবনযাপন মানুষের সহজাত স্বাভাবিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট। ইংরেজিতে তাই যথার্থই মানুষকে বলা হয়েছে-সশিয়েল রে্যশনেল এ্যনিমেল-।
মানব সভ্যতার ইতিহাস ক্রমবিকাশ ও ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। বিকাশ-বিবর্তনের মাধ্যমে আদি গুহা মানব থেকে আধুনিক মানবজাতি ও মানব সভ্যতার উত্থান ও অবস্থান। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস স্বাক্ষী, অধিকাংশক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বয়সের চাইতে সামাজিক সংঘটন এর বয়স অধিক। উদাহরনত উল্লেখ করা যেতে পারে ইসলাম ধর্মের প্রচারক আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা মক্কায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের এমনকি নবুওতির পূর্বেই মক্কার অশান্ত সমাজ জীবনে -হিলফুল ফুজুল- নামক একটি সামাজিক সেবা সংগঠন গঠন করতঃ গোত্র বিভক্ত এ্যরাবিয়ান সমাজের সকল মহল কর্তৃক প্রশংসিত হন -আল আমিন- উপাধি প্রাপ্ত হন।
বৃটিশ ভারতের বীর জনতা স্বরাজ ও বৃটিশ বিতাড়নে কংগ্রেস, মুসলীম লীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি গঠনের পূর্বেই এ্যালো ও রিয়েন্টাল মোহামেডান সোসাইটি, অনুশীলনী সমিতি ইত্যাদি সামাজিক সংঘঠন গঠন করতঃ সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন। সর্ব ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের ফল ও ফসল সাত চল্লিশে বৃটিশ বিতাড়ন, ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তানী স্বাধীনতা।
বৃহত্তর সিলেট প্রাচীনকাল থেকেই একটি সুপ্রাচীন, সমৃদ্ধ ও সভ্য জনপদ। প্রাচীনকালে সমগ্র বৃহত্তর সিলেট ১. লাউড়, ২. গৌড়, ৩. জৈয়ন্তিয়া, ৪. তরফ ও ৫. ইটা এই পাঁচটি সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তন্মধ্যে গৌড় ছিল প্রাচীন ও প্রধান। গৌড় এর সর্বশেষ স্বাধীন সামন্ত শাসক ছিলেন রাজা গোবিন্দ। গৌড় এর শাসক হিসাবে তিনি ইতিহাসে গৌড়গোবিন্দ হিসাবে খ্যাত ও পরিচিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পীরানে পীর-ইয়েমেনী বীর হয়রত শাহ জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহির তিনশত ষাট আওলিয়ার আওলিয়া বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে রাজা গোবিন্দ অজানার উদ্দেশ্যে পলায়ন করলে বীর শাহজালাল গৌড় এ ইসলামের বিজয় নিশান উড়ান। কথা ছিল হযরত শাহ জালালের সঙ্গেঁ আনা মাটির সঙ্গেঁ যে মাটির মিল পাওয়া যাবে সেখানেই হুজরা স্থাপন করবেন পীর শাহজালাল। হযরত শাহ জালালের সঙ্গীঁ হযরত চাষনী পীর সঙ্গেঁ আনা মাটির সঙ্গেঁ গৌড় এর মাটির মিল পাওয়াতে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও অপার রহমতে এখানেই হুজরা স্থাপন করেন পীর শাহজালাল। গৌড় কালক্রমে ছিল-হট থেকে শ্রীহট্ট-হয়ে সিলহট-সিলেট- নামে অভিহিত-খ্যাত ও পরিচিত হয়। সুরমা পারের কবি দিলওয়ার তাই যথার্থ ভাবেই লিখেছিলেন- তুমি রহমতের নদীয়া-দোয়া করো, মোরে হযরত শাহজালাল আওলিয়া।- প্রাচীন শ্রীহট্ট এই পীরে কামেলের নামে -জালালাবাদ- নামেও খ্যাত। ঢাকায় বসবাসরত বৃহত্তর সিলেটবাসি তাদের প্রিয় ও বৃহত্তম সামাজিক সেবা সংগঠন এর নাম জালালাবাদ এসোসিয়েশন- দিয়ে এই পীরানে পীরেন প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ঐতিহ্য সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
পাকিস্তানী স্বাধীনতার উষালগ্ন আট চল্লিশ সালে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত বৃহত্তর সিলেটের সুুধী সমাজ মরহুম খান বাহাদুর মোহাম্মদ মাহমুদ, মরহুম আব্দুল মুকিত চৌধুরী এবং মরহুম আশরাফ উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জালালাবাদ এসোসিয়েশন গঠন করতঃ ৪৮ সালে কমিটির প্রথম সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহন করেছিলেন। ৪৯ সালে মরহুম আব্দুল মুকিত চৌধুরী আহ্বায়ক এবং ৫০ সালে মরহুম আশরাফ উদ্দীন মাহমুদ চৌধুরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কালক্রমে ৬১-৬২ সালে মরহুম গিয়াস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী এবং অতঃপর মরহুম এম.এ হক এর বলিষ্ট গতিশীল নেতৃত্বের হাত দিয়ে ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশন এখন দেশের একটি বহত্তম সামাজিক সেবা সংগঠন। সমিতির সদস্য এখন হাজার হাজার। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ২২, কাওরান বাজারে বহুতল বিশিষ্ট সামতির বহুতল ভবন। এসোসিয়েশন এর কার্যক্রম এখন ব্যাপক ও বিস্তৃত। রাজধানীতে বসবাসরত বৃহত্তর সিলেটের কৃতি সন্তানগনের বলিষ্ট ও গতিশীল নেতৃত্বে এসোসিয়েশন এখন প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত। ২০১৭ সালে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সমিতির অভিযাত্রা জীবন ঘনিষ্ট শ্লোগানে এসোসিয়েশন এর আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসব ছিল একাটি সময়োপযোগী ও ঐতিহাসিক আয়োজন। এসোসিয়েশন আন্তর্জাতিক এই উৎসবকে উদ্যোক্তাগন শুধু মাত্র রাজধানী ঢাকায় সিমাবদ্ধ না রেখে পাঁচ থেকে সাত মার্চ সিলেটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ষ্টেডিয়াম-লাক্কাতুরায় বিশাল আয়োজন করে সকল মহলের প্রশংসা ভাজন হয়ে ছিলেন। পাঁচ মার্চ রবিবার সকালে রাজধানী বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার থেকে এসোসিয়েশন সদলবলে সিলেট এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে চমক দেখিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসব সতেরো উপলক্ষে কর্তৃপক্ষ মানসম্মত-কাগজ, উচ্চমানের লেখা, আকর্ষনীয় আলোকচিত্র সমেত পৌনে চারশত পৃষ্টার একখানি চমৎকার স্মারক সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। এমন ব্যাতিক্রমি ও ঐতিহাসিক আয়োজনের জন্য এসোসিয়েশনের বিদায়ী সভাপতি সি.এম তোফায়েল সামি, সাধারন সম্পাদক সৈয়দ জগলুল পাশা এবং স্মারক প্রকাশনা সম্পাদক মোস্তফা সেলিম ধন্যবাদ পাবার হকদার। গুনী ব্যাক্তি ত্রয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ দিলাম।
সাতাইশ অক্টোবর শনিবার সকালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে জালালাবাদ এসাসিয়েশন এর বার্ষীক নির্ব্বাচন দুই হাজার আঠারো দারুন জমে উঠেছে। দুই প্যেনেলে বিভক্ত প্রার্থীগন আনন্দ-উচ্ছাস-উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে শৈল্পিক ভাবেই চলছে প্রচারনা। প্রচারাভিযান ও বেশ জমে উঠেছে। ড.একে. এ. মুবিন সভাপতি এবং মোঃ আব্দুর রৌফ সম্পাদক এর নেতৃত্বে একটি প্যেনেল এবং সি.এম. কয়েস সামি সভাপতি এবং এডভোকেট জসিম উদ্দিন কে সম্পাদক দিয়ে পূর্ন প্যেনেল প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। ফিল্ম সেন্সর বোর্ড এর অবসর প্রাপ্ত সচিব এম.এ রউফ নির্বাচন কমিশনার এর গুরু দায়িত্ব পালন করছেন। এমন মর্য্যাদাপূর্ন প্রতিষ্টানের কর্মকর্তা কারা হবেন ভোট গননা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবেনা, কারন এখানে জনমত জরীফ এবং ফলাফল প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করারও অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বয়স মাত্র চারশত বৎসর। ১৬১০ সালে মুগল সুবাদার ইসলাম খান চিশতি নৌপথে ঢাকা এসে ঢাকাকে একটি গন্ডগ্রাম হিসাবে পান-প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। ঢাকার ইসলামপুর ইসলাম খান চিশতির স্মৃতি বহন করছে। কোলকাতার বয়স যেখানে মাত্র তিনশত বৎসর সেখানে সিলেটের বয়স সাতশত বৎসর। উপমহাদেশের মধ্যে সিলেটের সমসাময়ীক জনপদ হবিগঞ্জের তরফ। উপমহাদেশের মধ্যে সর্ব প্রাচীন জনপদ সিলেট। যুগে যুগে সিলেটের সাম্প্রদায়ীক সম্প্রিতি চমৎকার। সনাতন ধর্মাবল্বীদের কাছেও সিলেট পূন্যভূমি। বৈষ্ণব বাদের প্রচারক সনাতনী অবতার শ্রীচৈতন্য দেবের পিতৃভূমি সিলেটের ঢাকা দক্ষিন। মনুনদীকেও পূন্য সলীলা হিসাবে গন্য করা হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে পূন্যভূমি সিলেটের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান ইতিহাসের অংশ। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান সেনাপতি বঙ্গঁবীর মোঃ আতাউল গনী ওসমানী এবং উপপ্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল এম.এ রব বীর উত্তম বৃহত্তর সিলেটেরই সু-সন্তান।
সিলেট বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসনিক অবস্থানে থাকলেও পীরানে পীর ইয়েমেনী বীর হযরত শাহ জালালের মাজার শরীফ এবং ‘ছিলটী’ ঐতিহ্য বৃহত্তর সিলেটবাসিকে সৌহার্দ্য, সম্প্রিতি ও ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে।
এমন ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ এবং পীর শাহজালালের নামের স্মৃতি বিজড়িত সংস্থা -জালালাবাদ এসোসিয়েশন- এর কর্ম্মকর্তা নির্বাচিত হওয়া দায়িত্ব পালন সৌভাগ্যজনক-খুশনসীব এর ব্যাপার। এসোসিয়েশন এর নব নির্বাচিত কর্ম্মকর্তাগনকে আগাম অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
একটি জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই। এই প্রাচীন জনপদের পূর্ব ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আশা করা যায় এসোসিয়েশন শিক্ষা উন্নয়ন সম্প্রসারন, মেধার বিকাশে অধিকতর মেধাবৃত্তি চালু সহ শিক্ষা উন্নয়ন মূলক কার্য্যক্রম গ্রহন করবেন।
[সংস্থার আজীবন সদস্য। মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। সাংবাদিক। কলামিষ্ট]
মন্তব্য করুন