জুড়ীতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজশে মসজিদ ও মন্দিরের বরাদ্দ হরিলুট
হারিস মোহাম্মদ॥ জুড়ীতে এতিমখানা, মসজিদ, মন্দির ও মাদ্রাসার বরাদ্দকৃত চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
গত আড়াই মাস আগে বরাদ্দকৃত দুই টন চালের পরিবর্তে অনেক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের ইচ্ছে মত নগদ টাকা দিলেও প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও জানেনই না তাদের নামে চাল বরাদ্দ হয়েছে।
আবার কাগজে কলমে প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাস্তবে বরাদ্দকৃত অনেক প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায় নি। অস্তিত্বহীন অনেক প্রতিষ্ঠানের নামে এইসব চাল আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠায় এ নিয়ে চলছে তোলপাড়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম ও সামাজিক কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে জুড়ী উপজেলায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে ১০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত জুন মাসে বরাদ্দকৃত চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
সরজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দপ্রাপ্তকৃত চাল বিতরণে অনিয়মের সঙ্গে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় চালের ডিলার ও বেশ কয়েকজন সরকার দলীয় নেতা জড়িত।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দুই টন চালের বিপরীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার থেকে শুরু করে দেওয়া হয়েছে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নগদ টাকা দেওয়ার কোন বিধান নেই।
কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে দুই টন চালের বাজারমূল্য ছিল ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
যে সব প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদেরকে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ফোন করে অনুদানের পাওয়ার বিষয়টি জানানো হয়।
পরে অফিসে গেলে তাদের স্বাক্ষর রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার থেকে শুরু করে দেওয়া হয়েছে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে চালের পরিবর্তে নগদ টাকা দেওয়ার কোন বিধান নেই।
সরকারি বিধান না থাকলেও উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার অফিস, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় চালের ডিলার ও বেশ কয়েকজন সরকার দলীয় নেতা মিলে এ বরাদ্দ লুটপাট করেছেন।
সরজমিনে গিয়ে তালিকায় নাম আছে কিন্তু টাকা পায়নি কন্টিনালা আতিকিয়া হাফিজি মাদ্রাসার সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মিয়া বলেন, তালিকায় আমাদের মাদ্রাসার নাম আছে কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদেরকে কেউ এই বরাদ্দর কথা বলেনি।
উত্তর বড়ডহর জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুস সালাম চৌধুরী ও সদস্য এমরান আলী লেবু বলেন, উপজেলা পিআই অফিস থেকে আমাদেরকে ২৫ হাজার টাকার একটি চেক দেওয়া হয়েছে। আমাদের নামে দুই মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ হয়েছে শুনেছি। কিন্তু আমরা কোন চাল পাই নি।
সরজমিনে এলবিনটিলা সার্বজনীন জগন্নাথ মন্দিরে গেলে এলাকাবাসীসহ পূজারীরা জানান, আমাদের মন্দিরে চালের কোন বরাদ্দ আসে নি। যারা আমাদের মন্দিরের নামে চাল বরাদ্দ এনে মেরে খেয়েছে তাদের বিচার চাই।
মোকামবাড়ী জামে মসজিদের ক্যাশিয়ার আব্দুল হান্নান বলেন, শুনেছি আমাদের মসজিদের নামে চাল বরাদ্দ হয়েছে কিন্তু এখনো কোনো বরাদ্দ পায়নি।
রানীমুড়া জামে মসজিদের সভাপতি মোঃ আবদু মিয়া বলেন, পরস্পর শুনেছি মসজিদের নামে দুই মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উপজেলা থেকে আমাদের কেউ জানায়নি এবং বরাদ্দও পাইনি।
উপজেলা চত্বর জামে মসজিদের সভাপতি ও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম তারা মিয়া বলেন, আমাদের মসজিদের নামে চালের বরাদ্দ বাবদ উপজেলা পিআইও অফিস থেকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
জাঙ্গালিয়া পাঞ্জেখানা মসজিদের সভাপতি মোহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বলেন, উপজেলা থেকে নগদ ৬০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। কিন্তু চাল বরাদ্দের কথা কেউ বলেনি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটি আমি যোগদানের আগের বরাদ্দ। তখন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ছিলেন মনসুর আলী। কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুই টন চালের পরিবর্তে অফিস থেকে নগদ ৬০ হাজার টাকা প্রদানের বিষয়ে তিনি বলেন এ বরাদ্দে চালের পরিবর্তে অফিস থেকে নগদ টাকা দেওয়ার সরকারি বিধান নেই।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাদু মিয়া বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের দেওয়া তালিকার আলোকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা থেকে যাচাইবাছাই করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এ বরাদ্দের চালের পরিবর্তে নগদ কোন টাকা প্রদান করার সরকারি কোন বিধান নেই। সরকারি নির্দেশনা হলো এক সঙ্গে চাল বিতরণ করা। কোন ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রঞ্জন চন্দ্র দে বলেন, অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের দেওয়া তথ্যের আলোকে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরকম তো হওয়ার কথা না। অনিয়ম হয়ে থাকলে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন