ডা. মুন্নীর আর্তনাদ

May 30, 2020,

সায়েক আহমদ॥ ডা. রাবেয়া বেগম (গাইনোকলজিস্ট) এর ফেসবুক ওয়ালে একটি হৃদয়বিদারক আর্তনাদ দেখে মনটা উথালপাতাল হয়ে উঠল। ২৩ মে তার পিতা মৌলভীবাজার জেলার সাবেক সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্তন সহকারি পরিচালক ডা. এমএ মতিন কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৌলভীবাজার জেলার জনপ্রিয় পাতাকুড়ির দেশ পত্রিকায় ‘ডা. এমএ মতিন ঃ একজন দিলখোলা মানুষ’ শিরোনামে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে আমি লিখেছিলাম, ‘প্রধান শিক্ষক বশিরউদ্দিন আহমদ এবং ডা. এমএ মতিনের বাসাটি ছিল আমাদের বাসার উল্টোদিকে। আমার খালা মুহিব্বাতুল আম্বিয়ার সহপাঠি ছিলেন ডা. মতিন। তবে চাকুরীর সুবাদে মাঝে মাঝে শমশেরনগর আসতেন তিনি। তার বড়ছেলে শরীফ আহমদ এবং প্রধান শিক্ষক বশিরউদ্দিন আহমদ এর বড় ছেলে সরওয়ার জামান রানা ছিল আমার সহপাঠি। তার দ্বিতীয় ছেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সাঈফ আহমদ এবং একমাত্র মেয়ে রাবেয়া মুন্নীর সাথেও অন্তরঙ্গ সম্পর্কই ছিল। ডা. মতিনের সহধর্মিনীও অত্যন্ত স্নেহ করতেন।’
এবার আসি ডা. মতিনের সেই একমাত্র মেয়েটি রাবেয়া বেগম মুন্নী প্রসঙ্গে। মুন্নীর সাথে আমার দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে আর দেখা হয়নি। বর্তমানে সে সিলেট বিভাগের একজন অভিজ্ঞ গাইনোকলজিস্ট। গরীবের ডাক্তার হিসেবেও সিলেটে তার যথেষ্ট নামডাক আছে। ডা. মতিন তার এই একমাত্র মেয়েটিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাই তাকে নিজের মত করেই গড়ে তুলেছিলেন। মুন্নী এবং ডা. মতিনের ছোট ছেলে সাঈফ আহমদ সিলেটে থাকতেন। ডা. মতিন থাকতেন সস্ত্রীক মৌলভীবাজার শহরের ভাড়াটে বাসায়। তার সহধর্মিনীর মৃত্যুর পরও তিনি মৌলভীবাজার ছেড়ে যেতে চাননি। কিন্তু ২০১৭ সালে একটি দূর্ঘটনায় তার হাত ও পা ভেঙ্গে যাওয়ায় তাকে সিলেট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে সময় তিনি মেয়ের তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। করোনা মহামারীর এ ভয়ংকর দুর্দিনেও তিনি মেয়ের তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। আমরা এতটুকুই জানতাম ২৩ মে সকাল ৭টায় করোনা উপসর্গ নিয়ে তাকে সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর ঐদিনই রাত ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আসুন বাকীটুকু জানি গাইনোকলজিস্ট ডা. রাবেয়া বেগম মুন্নীর ফেসবুক ওয়াল থেকে। পাঠকরা যাতে সহজে অনুধাবন করতে পারেন সে জন্য ব্র্যাকেটের মধ্যে কিছু নোট দেয়া হল-
বুকফাটা আর্তনাদ নিয়ে ডা. মুন্নী লিখেছেন, ‘আমার কলিজার টুকরা (ডা. এমএ মতিন) সব জায়গায় মধ্য মনি হতে চাইত, প্রাধান্য চাইত, শিরোনাম হতে চাইত।
আব্বাগো, আল্লাহ রাহমানির রাহিম, বড়ই মেহেরবান। তোমাকে তিনিও বড় প্রাধান্য দিয়েছেন, পবিত্র রামাদানে, নাযাতের মহিমান্বিত বেজোড় রাতে। তোমায় তিনি মেহমান হিসেবে কবুল করে নিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ! দুনিয়ায়ও তুমি শিরোনাম হয়ে গেলে!
সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে তোমাকে নিয়ে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। কত কাকুতি-মিনতি করলাম, কিন্তু ওরা ভর্তি করলো না। রেফার করে দিলো শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতালে।’
এতটুকু পড়েই বুঝলাম দেশের স্বাস্থ্যবিভাগ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সাথে সাথেই ভেঙ্গে পড়েছে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থা। একজন সাবেক সিভিল সার্জন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন প্রাক্তন সহকারি পরিচালক ছিলেন ডা. এমএ মতিন। তার মেয়েও সিলেটের একজন জনপ্রিয় গাইনোকলজিস্ট। তারপরও ডা. মতিনকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির কোন সুযোগ দেয়া হল না। পাঠিয়ে দেয়া হল শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতালে। ডা. মুন্নীও পাগলের মত নিজের পিতাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। তারপর তিনি লিখেছেন, ‘ইমার্জেন্সীতে দাঁড়িয়ে রইলাম আধা ঘণ্টা, তারপর ডাক্তার এলো, বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বলল, ‘এক নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যান।’ শুধু এটুকু বলার জন্য যে সময়টুকু তারা ব্যয় করল, সেই সময়ের মধ্যেই আরো নীল হলো আমার বাবা। আমি নিজেই আমার সাথে আনা এম্বুলেন্স এর কর্মীদের সাথে করে ট্রলি নিয়ে ছুটছি। কেউ বলে দেবার, দেখিয়ে দেবার নেই যে, এক নম্বর ওয়ার্ডটা কোন দিকে। উদভ্রান্তের মতো ছুটছে এক ডাক্তার বানানোর কারিগর তার ডাক্তার বাবাকে নিয়ে। যে বাবা আজীবন শুধু বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিয়ে গেলো হাজার হাজার মানুষের, যে বাবা আজীবন Heath Sector এর অনিয়ম দূর করতে লড়েছে, সরকারী কর্মকর্তার Responsibility পালন করতে আমাদেরকে ভুলে যেতো। না শুধু গরীবেরা নয়, সমাজের সব সুযোগ সন্ধানীরা জানতো ডাক্তার মতিন পয়সা নেবেন না।
trolley ঠেলছি, Oxygen Silynder Ambulance G fixed, নীল গাঢ় হচ্ছিল…। ওয়ার্ডে পৌঁছলাম। নোংরা বেডে আমার Perfectionist  বাবাকে নিজে টেনে হিঁচড়ে নামালাম। বলা হলো যান Oxygen Musk কিনে আনেন। ওদিকে আমার বাবার চেহারা ধীরে ধীরে আরো নীল হচ্ছে। নীল গাঢ়ো হচ্ছে। কতশত ডাক্তারকে ফোন দিলাম, কেউ ধরল না। তিন-চার ঘন্টা এভাবেই কাটলো। কোন ডাক্তার এলো না। শুধু Oxygen দিয়ে বসে রইলাম।
তারপর Director Brig. Gen. Dr. Yunus  সাহেবের কানে যখন ফোন গেলো তিনি খুব সহযোগিতা করলেন। রুগীকে দ্রুত ওঈট তে ভর্তি করাবার জন্য তার নিকট হতে জরুরী ঙৎফবৎ এল। সেই জরুরী Order আসার পরও আরো এক ঘন্টা চলে গেল। তারপর হঠাৎ এক ওয়ার্ড বয় উদয় হয়ে বলল, ‘রুগীকে ICU  তে নেবো, কিন্তু Trolley কে ঠেলবে?’ আমি কাতরকণ্ঠে বললাম, ‘আমি ঠেলব।’ আবার ছুটে চলছি।
বেলা দুটোয় ডাক্তার এলেন। আমাকে বললেন, ICU Bed Occupied,  তবে আমি চাইলে একটা Alternative ব্যবস্থা হবে, কিন্তু রুগীর যে Condition, তাতে কোন লাভ হবে না।’ আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কারণ লাভ না হবার জন্য যতটুকু Conditionতৈরি করা দরকার তা তো সবাই মিলে তৈরি করেই ফেলেছেন, Anoxic Organ Damage করার কাজ তো শেষ। আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, আমাকে এক শহীদ পিতার গর্বিত সস্তান বানানোর পথ সুগম করার সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য। অবশ্য এই ধন্যবাদটা শুধু Director Brig. Gen. Dr. Yunus সাহেবকে দিবো না। কারণ একমাত্র তিনিই আন্তরিকভাবে যতটুকু সাহায্য করার করেছেন।
বাবার সরকারি চাকরির কঠিনতর দায়িত্ব পালন, আপোষহীন নীতির জন্য বারবার অনাকাঙ্খিত বদলী, অল্প কয়েকটা টাকায় সংসার চালানো দেখে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ জয়েন করেছিলাম। বিশটি বছর দেশের মানুষের জন্য কাজ করে আজ জানলাম আমি এ দেশের এক অনাকাঙ্খিত সন্তান।
হে দেশ তোমার এই অনাকাঙ্খিত সন্তানের অসীম ঘৃণা গ্রহণ কর। আমার বাবার সকল বংশধর তোমাকে আজীবন ঘৃণা জানাবে।’
ডা. মুন্নীর শেষ লাইনটি পড়ে আমাদের মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ একজন ডা. মেয়ে তার ডা. পিতাকেই বাঁচাতে পারল না। যে সময়টুকু অবহেলাভরে কালক্ষেপন করে নষ্ট করা হয়েছিল, সে সময়টুকু কাজে লাগালে হয়ত ডা. মতিনের মত একজন উঁচু মাপের আদর্শবাদী ডাক্তারের এভাবে করুণ পরিণতি বেছে নিতে হতো না। হয়তো সবার সাথে এখনও দিলখোলা আড্ডা জমিয়ে তুলতেন। কাজেই সকল ভুলের মাশুলের জন্য আমরা সবাই প্রতিনিয়ত দেশকেই দোষারূপ করে থাকি। আসলে দেশের দোষটাই বা কী? সমাজের গুটিকয়েক ঘৃণিত মানুষের কারণেই প্রতিনিয়ত দেশ সামনে অগ্রসর হবার পরিবর্তে পিছনের দিকেই যাচ্ছে।
কৌশলগত পরিকল্পনার ভুলে হোক আর দায়িত্বরত ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই হোক, দেশ যে প্রতিদিন এবং প্রতিমুহূর্তে পিছিয়ে যাচ্ছে, সে খবর আমরা কেউ রাখছি না। বর্তমানে আমরা অর্থাৎ দেশের আপামর জনসাধারণও গণহারে দায়িত্বে অবহেলা করছি। শুধুমাত্র সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখার জন্য কভিড-১৯ আমাদের জন্য সাইলেন্ট কিলার হয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। একজন ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সংবাদকর্মী কিংবা সামাজিক কর্তব্যে পালনে নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিবর্গ, যাদেরকে প্রতিনিয়ত কভিড-১৯ রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে, তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করেই এ সব দায়িত্ব পালন করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছেন। তারা করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হতেই পারেন। এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সরকার তো দেশের বাকী জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ঘরে বসে থাকলেই আমরা করোনাকে প্রতিরোধ করতে পারি। কিন্তু আমরা কি সেটা মেনে চলছি। প্রতিনিয়ত আমরা নিয়ম ভেঙ্গে নিজ নিজ গৃহে করোনা ভাইরাসকে স্বাগত জানাচ্ছি।
বিগত দিনগুলোতে আমরা ফেসবুক হতে কিংবা অনলাইন পত্রিকা হতে জানতে পেরেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্ত, এই অযুহাতে কোথাও চিকিৎসা সেবা পাননি, কিংবা কভিড-১৯ রোগীকে অবরোধ করে রাখা হয়েছে, কিংবা বাসা থেকেই উচ্ছেদ করা হয়েছে এ ধরণের অসংখ্য সংবাদ। তারপরও তো আমাদের মধ্যে কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া, আমরা নিজেরাই টের পাই না।
হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে একজন ডাক্তার যখন তার ডাক্তার পিতাকে চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেন, তখন তিনি কীভাবে দেশসেবার মানসিকতা ধরে রাখতে পারেন? দেশ ও দশের স্বার্থে এসব ব্যাপারে সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে অনুভব করছি।
প্রতিটি মৃত্যুর জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই হবে। বিশেষ করে করোনা পজিটিভ রোগীর চিকিৎসা সেবায় যে সকল ডেডিকেটেড হাসপাতাল তালিকায় আছে, তাদের ক্ষেত্রে রোগীকে অফিস চলাকালীন সময়ে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দায়িত্বে অবহেলাকারীদেরকে জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়েছে বলেই পুরো স্বাস্থ্যবিভাগকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। সঠিক সময়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার মতো শক্তিশালী কণ্ঠস্বর এখনও গড়ে উঠেনি। এ কারণে ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড ঘটার পর দেখা যায়, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। দায়িত্বরত ডাক্তার নার্সরা আইসিইউতে চিকিৎসারত অসহায় রোগীদের ফেলে পালিয়ে যায়। আর সেইসব অসহায় রোগীদের করুণ মৃত্যু সারা বিশ্বে আমাদের চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে মাথা নিচু করতে বাধ্য করে।
ডা. মুন্নীর করুণ আর্তনাদ শুনে আমরা মর্মাহত। তাকে শান্তনা দেবার ভাষাটুকু আমাদের নেই। আমরা শুধু এটুকুই প্রত্যাশা করব, পরবর্তীতে আর যেন এমন মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আর যেন ডা. মুন্নীদের মত আর্তনাদ করার সুযোগ কেউ না পায়।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com