ডিজিটাল বাংলাদেশ ও শিশু কিশোরদের মোবাইল ফোন
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে বুঝায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান দারিদ্র বিমোচন সহ সরকারের সকল প্রতিশ্রুতি বাস্থবায়নে প্রযুক্তির প্রয়োগের একটি আধুনিক দর্শন। সর্বত্র জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সুশাসন নিশ্চিত করে সরকারী সেবা জনগনের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মানুষের জীবণমান উন্নয়ন ঘটানোই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ এর লক্ষ্য। প্রকৃত পক্ষে ক্ষুধা দারিদ্র , বৈষম্যহীন, দূনীতিমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক এক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করা আর এর চালিকা শক্তি হলো ডিজিটাল প্রযুক্তি। ডিজিটাল বাংলাদেশ শুনতে যেমন অনেক সহজ মনে হয় এর যথাযথ বাস্তবায়নটা ততই কঠিন। দেশের শিক্ষার্থীরা হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রপথিক। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ডিজিটাল বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া আবশ্যক।
শিশু কিশোরদের মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া শিখে নিজেদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এবং দেশের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুুত থাকতে বলেছেন প্রধান মন্ত্রি শেখ হাসিনা।
১৮ অক্টোবর ২০১৬ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনষ্টিটিশন মিলনায়তনে শেখ রাসেল এর ৫২তম জন্ম বার্ষিকৗ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্টানে প্রধান অতিথির বক্তবে তিনি এসব কথা বলেন। মাননীয় প্রধান মন্ত্রি আর ও বলেছেন ডিজাটাল বাংলাদশে বিনির্মাণে আমরা প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। একটা মানুষ ও এ দেশে ক্ষুধার্ত থাকবে না, গৃহহারা থাকবেনা, শিক্ষার জন্য সবাই স্কুলে যাবে। মানুষ এর মতো মানুষ হবে। তারা মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে। প্রধান মন্ত্রির এই বক্তব্য নি:সন্দেহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শিশু কিশোরদের মানুষের মতো মানুষ হতে হলে দেশ প্রেমিক যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে মানসম্মত উন্নত নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা, মেধার বিকাশের জন্য যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। দেশকে উন্নত দেশে রুপান্তর করার জন্য একটা জ্ঞান ভিত্তিক মানবিক সমাজ বিনির্মাণেও এই বক্তব্য নি:সন্দেহে অসাধারন। তবে এর জন্য সবাগ্রে প্রয়োজন মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষার ফল দেশের শিক্ষানুরাগী মানুষ ও সচেতন অভিভাবকদের উদ্ধেগ উৎকন্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। কয়েক বছর ধরে কলা ও বানিজ্য অনুষদের অধীনে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস করতে পারছেনা। এবার তা স্থান নিয়েছে ৫.৫২ শতাংশে। এই ফল কোন ভাবেই প্রমান বহন করেনা দেশে মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা গেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের উন্নয়ন প্রশংসনীয়। দেশের এই উন্নয়ন অগ্রগতিকে ধরে রেখে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে মান সম্পন্ন শিক্ষার বিকল্প নাই। কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশের বিপুল সংখ্যক শিশু কিশোর শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন ব্যবহার জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ ও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে কিনা তা ভেবে দেখে দরকার। বাংলাদেশের স্কুলগামী শিশু কিশোরদের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। কোচিং সেন্টার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই শিশু কিশোরদের হাতে দামি মোবাইল ফোন দেখা যায়। শিশু কিশোরদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ে কোনো বিধি নিষেধ কার্যকর নেই। কিছু কিছু অতি উৎসাহী অভিভাবকরা ও শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছেন। এতে করে যে সমস্ত সচেতন অভিভাবকরা তাদের শিশু সন্তানদের হাতে মোবাইল দিতে চাননা তারা ও পড়েছেন অত্যন্ত বেকায়দায়। আমার কিশোর ছেলেটিও তার সহপাঠি আশেপাশের অন্তত: পাঁচজনের নাম বলেছে যাদের মোবাইল ফোন আছে এ যুক্তিতে তাকেও একটি স্মার্টফোন দিতে হবে। আমি তাকে মোবাইল ফোন দেইনি। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় তার মনটা খারাপ। এই হলো আমাদের সমাজের বাস্তবতা। পৃথিবীর উন্নত দেশ সমূহে ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ রয়েছে। মোবাইল ব্যবহারের কারনে শিশু কিশোরদের লেখাপড়ার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। অনেকে রাত জেগে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় স্বাস্থ্য হানি হচ্ছে। এতে করে তারা ভালো কোনো কিছু চিন্তা করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে মোবাইল ব্যবহারের মাধ্যামে শিশু কিশোররা যে শুধু পরিবারের সদস্য ও বন্ধু বান্ধবের সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করছে তাই নয় একই সঙ্গে পর্ণো ছবির প্রতি ও তারা আসক্ত হয়ে পড়েছে। শিশু কিশোরদের জ্ঞান আহরন ও মেধা বিকাশের জন্য বিদ্যমান এই পরিবেশ অব্যাহত থাকলে একটা বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। শিশু কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন দেয়ার কারণে এক দিকে নৈতিক স্খলন হচ্ছে, অন্যদিকে ভয়ংকর বিবাদ ও ডেকে আনছে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোবাইল ফোনে ট্রেনের ছবিসহ সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে যা হৃদয় বিদারক। সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাপ্ত বয়স্কদের ও মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয় যা সত্যিই বেদনাদায়ক। সেলফির উন্মদনা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে । পৃথিবীর কোন দেশেই অবাধে শিশু কিশোরদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয়না। আমাদের দেশে শিশু কিশোরদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে কোন বিধি নিষেধ কার্যকর না থাকায় এই প্রবনতা দিন দিন বাড়ছে এতে করে মান সম্মত শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে। ভারতবর্ষে ও আইন রয়েছে ষোল বছরের নিচে শিশু কিশোররা ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবে না। অনেক সময় দেখা যায় হঠাৎ মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে কৌতুহলবশত অবুজ মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়ের কথা বার্তায় অপিরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে প্রেমের সম্পর্কে এবং পরবর্তীতে ফোনে কথা বলা ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যৌন হয়রানিরও শিকার হচ্ছে। কখনও কখনও প্রতারিত হয়ে এসব কিশোরিরা বেছে নিচ্ছে আতœহত্যার পথ। সম্প্রতি ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার্স স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী রিশা নির্মম ভাবে খুন হয়। দর্জির দোকানের কর্মচারী ওবায়দুল জামা বানানোর ডেলিভারি স্লিপ থেকে রিশার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে প্রেম নিবেদন করে। সেই প্রেম প্রত্যাখান করায় শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল তাকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি রির্পোট থেকে জানা যায় মাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাথমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা শ্রেণী কক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে যা রাজধানীর কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড.এ এস এম আমান উল্লাহ বলেছেন দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে শিশু কিশোররা। তিনি এ ব্যাপারে অভিভাবকদেরই বেশী দায়ী করেছেন। মোবাইল যোগাযোগের অন্যতম সহজ মাধ্যম। যোগাযোগের ক্ষেত্রে মোবাইল বাংলাদেশে একটি বিপ্লব এনেছে। সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের কাছে এখন মোবাইল ফোন। রিক্সাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা গৃহকর্মী সহ সকলের কাছেই মোবাইল ফোন। ছাত্র- ছাত্রী সহ অনেক বেকার যুবক যুবতীর কাছেও একাধিক দামি মোবাইল ফোন দেখা যায়। বাংলাদেশে কত ভাগ মানুষ বিনা প্রয়োজনে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে তার একটা গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ খাদ্য উৎপাদনে দারিদ্র বিমোচনে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। দক্ষিন কোরীয় বংশদ্ভুত মার্কিন নাগরিক বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেছেন ১৯৫৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময় শর্ত পূরণের মতো সক্ষমতা দক্ষিণ কোরিয়ার ছিলনা। কিনÍু দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তি খাতের বিকাশ দক্ষিণ কোরিয়া আজকের এ পর্যায়ে এসেছে।বাংলাদেশের পক্ষে ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাতারে সামিল হওয়া সম্ভব বলে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের এই আশা জাগানিয়া অগ্রগতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে মানুষের অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচের বিষয়টিকে ও মাথায় রাখতে হবে। মানুষকে মিত্যব্যয়ী হতে হবে। মাত্রারিক্ত অপব্যয় থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে হবে। অপ্রয়োজনে এবং অসচেতন ভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার কারীর সংখ্যা মনে হয় বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশী। প্রাপ্ত বয়স্ক ও অনেক মানুষের মৃত্যুর উপলক্ষ হয়ে দাড়িয়েছে এই মোবাইল ফোন। সচেতনতার অভাবে রেললাইন পার হওয়ার সময় বা রেল লাইনে হাটার সময় কথা বলতে বলতে প্রায়ই মৃত্যুর ঘটনা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালের ১১ জুলাই মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে দ্রƒত গতিতে গাড়ি চালানোর কারনে চট্রগ্রামের মিরসসরাইর ট্রাজেডির কথা দেশবাসী ভুলেনি। চালকের অবহেলার কারনে ফুটবল খেলা শেষে বাড়ী ফেরার পথে কিশোর শিক্ষার্থীদের বহনকারী মিনি ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে ডোবায় পড়ে গেলে ৪৮ জন শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটে। যা ছিল হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক। ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল চালকের একটি মোবাইল সঙ্গে থাকা ও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। অস্বীকাররের কোন উপায় নেই তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তুু মোবাইল ফোনের অপব্যবহার রোধ করার প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্তা গ্রহন করা এখন সময়ের দাবী। বৃটেনে কোনো চালকের গাড়ী চালনো অবস্তায় কথা বলতে দেখিনি। সেখানকার গাড়ী চালকরা গাড়ী চালানো অবস্তায় মোবাইল ফোনে কথা বলার চিন্তা ও করতে পারে না। যুক্তরাজ্যের রাসÍায় চলার সময় দেখেছি একজন চালক ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে সাথে সাথেই পুলিশ ঐ দোষী চালকের কাছে এসে পড়েছে এবং জরিমানা ধরিয়ে দিচ্ছে।চালকের অবহেলার কারণে দূর্ঘটনায় কারো মৃত্যু হলে তাকে হত্যা হিসাবে গন্য করে কঠোর শাস্তির বিধান করা দরকার। গাড়ী চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক জরিমানার বিধান করে তা কঠোর ভাবে কার্যকর করা দরকার। মোবাইল ফোন, ফেইসবুক, ওয়াটস আপ, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো গ্রাম পর্যনÍ ছড়িয়ে পড়েছে। পর্ণোগ্রাফির অবাধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও জরুরী হয়ে পড়েছে। গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ ও সের্গেইব্রীন তাদের কোম্পানীর শ্লোগান ঠিক করেছেন ‘ডোন্ট বি ইভিল’ এ কথাটি তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের একটি দিক নির্দেশনা হিসেবে ধরা যেতে পারে। আসলে বিশ্বায়নের এ যুগে ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমকে কোনো অবস্থায় বাদ দেয়া সম্ভব নয়। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পড়াশুনার ও চর্চার ব্যবস্থা। এর ভালো দিকটি বুঝার বয়স শিক্ষার্থীদের হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটি চমৎকার সুযোগও তৈরী হয়েছে। পৃথিবীকে এগিয়ে নেবার ব্যাপারে তথ্য প্রযুক্তি যে ভাবে ভূমিকা রাখছে ঠিক তেমনি মানুষ অকল্যাণেও ব্যবহার করছে। খ্যাতিমান মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের ‘আল্লাহর ঘরের পবিত্রতা সুরক্ষা নিয়ে দুটি কথা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছেন হজব্রত পালন করতে এসেও মানুষ জাগতিক কিছুকে তো পরিত্যাগ করেইনি বরং পবিত্র কাবা শরীফে নিয়ে এসেছে জঞ্জাল। আজকের যুগে স্মার্ট ফোন সবার হাতে হাতে। তার সঙ্গে সেলফি স্টিক। পবিত্র বায়তুল্লাহ্ শরীফ তাওয়াফ করার সময়ও এই সেলফি স্টিক ধরে ভিডিও ফেইসবুক লাইভে অনেকেই ব্যস্ত। একই তৎপরতা মদীনাতেও দেখেছেন বলে তার প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়। মোবাইল প্রযুক্তি মানুষের ধ্যান ভাঙ্গানোর জন্য ভূমিকা রাখছে। গাড়ী ড্রাইভিং এর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই দূর্ঘটনা ঘটে এবং অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে রাজধানীতে ৭৭ শতাংশ কিশোর পর্ণো ভিডিওতে আসক্ত। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পর্ণোগ্রাফি আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ানক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় যারা পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত তাদের মস্তিস্কে মাদকাসক্তের মতোই নেশা কাজ করে। মাদকাসক্তদের যেমন স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে, তেমনি পর্ণো আসক্তরাও ধীরে ধীরে অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে এবং বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। তাই তরুণসমাজকে রক্ষায় ক্ষতিকর ওয়েবসাইট বন্ধের জন্য যুক্তরাজ্য সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
শিশু কিশোররা যাতে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করতে পারে সেজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ করা দরকার, এ জন্য নি¤œলিখিত উদ্যোগ গ্রহন করা যেতে পারে :- (১) ১৮ বছরের কম বয়সী কোন শিশু দোকান থেকে সিম ক্রয় করলে দোকানীর বিরূদ্ধে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির বিধান রাখলে এবং এর প্রয়োগ দৃশ্যমান হলে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে। (২) সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী অভিভাবক ও শিক্ষদের সমন্বয়ে মাঝে মধ্যে সমাবেশ করা যেতে পারে। (৩) কে,জি স্কুল ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতে কোন শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার এর দফতর থেকে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করা যেতে পারে, ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। (৪) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিকে শিশু কিশোরদের মোবাইল ব্যবহার এর ব্যাপারে আন্তরিক ও উদ্যোগী ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। (৫) শিশু শিক্ষার্থীরা যাতে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে সেজন্য অভিভাবকদের কাছ থেকে অঙ্গিকারনামা নিয়ে সকল কে.জি ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বেশ কিছুদিন পূর্বে রাটগার্স ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায় বলেছিলেন আমাদের সৌভাগ্য দেশকে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে যে নেত্বত্ব গুনাগুন দরকার তা তোমাদের আছে । তোমাদের প্রত্যেকের পকেটে মোবাইল ফোন আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে তথ্য অনুসন্ধান কখনোই এতটা সহজ ছিল না অথচ দূভার্গ্যজনক ভাবে তথ্যের এই অবাধ উচ্চভান্ডারই যেন আমাদের সত্য থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কখনো কখনো তথ্য এতটা অবারিত বলেই আমরা অজ্ঞতাকে স্বাভাবিক ধরে নিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বারাক ওবামার এই বক্তব্য শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয় সকল মানুষের জন্যই একটা ম্যাসেজ তা হলো মোবাইল ফোন যেন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধক না হয়।
বিশ্ব এখন জ্ঞানে বিজ্ঞানে তথ্য প্রযুক্তিতে দ্রুত এগিয়ে চলছে। বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের সক্ষমতা প্রমান করতে হলে আমাদের তরূণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের শিশু কিশোররাই আগামী তরূন প্রজন্ম। তারাই দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির মূল কারিগর। দেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি ঈর্ষনীয়। এ অগ্রগতিতে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখছেন আমাদের ব্রিলিয়ান্ট আইটি জেনারেশন আমাদের তরূণ প্রজন্ম। দেশকে সমৃদ্ধ করতে তরুনদের বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্নই একটি জাতিকে এগিয়ে নেয়। দেশের তরূণ প্রজন্মই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মার্ণে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। বাংলাদেশের তরূন অনেক বেশী সৃজনশীল , তারা অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। উপমহাদেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ভারতের একাদশতম প্রয়াত রাষ্টপ্রতি অধ্যাপক ড. এ, পি, জে আবুল কালাম তার Goverance for the growth of india মানুষের সক্ষমতা প্রমাণে চারটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন :- (ক) কুড়ি বছরের মধো জীবণের লক্ষ্য স্থির করা ( খ) বিরীতহীন জ্ঞান আহরণ (গ) কঠোর পরিশ্রমে যে কোনো সমস্যাকে পরাস্ত করা (ঘ) প্রচন্ড আত্ববিশ্বাস থাকতে হবে যে, আমিই মহৎ কিছু করব।
এখন সময়ের দাবী হলো আমাদের শিশু কিশোররা এই মহা মুল্যবান উপদেশ গুলো পালন করবে। তারা পরীক্ষায় শুধু জি,পি,এ ৫ই পাবেনা তারা সফল ও সার্থক মানুষ হবে। তারা নানা ধরনের ভাল বই পড়বে তারা পৃথিবীর বড় বড় মানুষের জীবনী পড়বে, তারা খেলাধুলা করবে, সংস্কৃতির চর্চা করবে, বিতর্ক ও বক্তৃতার প্রতিযোগিতা করবে, সমাজ সেবা মূলক কাজ করবে, সব দিক থেকে চৌকস মানুষ হবে।
লেখক ব্যাংকার ও কলামিষ্ঠ এবং ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার জেলা কমিটি। Email : taherpbl@gamail.com
মন্তব্য করুন