মতামত কমিশন গঠন কেন প্রয়োজন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন কেন প্রয়োজন

September 12, 2024,

. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ : ১৮ আগস্ট প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ ও সরকারের পর স্থানীয় সরকারেও আওয়ামী লীগ কর্তৃত্ব হারানোর পথে। এরপর কেটে গেছে প্রায় এক মাস। ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর পদ এবং দেশ ছাড়ার পরদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সংসদ ভেঙে দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। একতরফা নির্বাচনে দীর্ঘ সময় ধরে জেলা ও উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সব শীর্ষ পদই ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে। ৫ আগস্টের পর তাদের বেশিরভাগই পলাতক। এ অবস্থায় অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এসব পদ থেকে তাদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করার পদক্ষেপ নেয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউএনওকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এভাবে দ্রুত অপসারিত হয়েছেন সব মিলিয়ে শত শত আওয়ামীপন্থি মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান।

আমরা দেখছি, ইউএনও ও ডিসিদের স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কমিশনারকে। ইউএনওদের এমনিতেই অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ডিসি কিংবা ইউএনওদের পক্ষে এতগুলো ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ও পৌরসভা সামলানো কঠিন কাজ। এত বড় একটি কর্মযজ্ঞ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং বলা যেতে পারে, এভাবে স্থানীয় সরকার কাঠামো পুরোপুরি অবহেলিত হয়ে পড়ল। এভাবে জনগণ এসব কাঠামো থেকে কোনো সেবা পাবে না। স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিপূরক একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিই হতে পারেন। অন্তর্র্বতী সরকার যদি স্থানীয় সরকার কাঠামো সত্যিই শক্তিশালী করার সদিচ্ছা রাখে তাহলে এখন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করতে হবে যেমনটি আমরা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে দেখেছি।

স্থানীয় সরকার কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এ কমিশন গঠনের জন্য দুজন প্রতিনিধি নেওয়া যেতে পারে যারা সদস্য হিসেবে কাজ করবেন এবং একজন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। যে দুজন প্রতিনিধির কথা বলেছি তাদের একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান কিংবা পেশাদার ব্যক্তি হতে পারেন। লোকপ্রশাসন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, সমাজকল্যাণ, সমাজবিজ্ঞানÑএসব বিভাগের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদের থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আরেকজন সদস্য হবেন যার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং মাঠপর্যায়ের সবকিছু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন। আর কমিশনের চেয়ারম্যানকে অবশ্যই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ হতে হবে। এ বিশেষজ্ঞ আমরা কীভাবে নির্ধারণ করব? মনে রাখতে হবে, স্থানীয় সরকার স্বশাসিত নয়। এখনও এ স্তরের সরকার জাইকা, ইউএনডিপির মতো সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। ফলে এসব সংস্থায় যারা কাজ করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় এনে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এ স্তম্ভেই অতীতে অনেকবার বলেছি, স্থানীয় সরকার মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের বর্ধিতাংশ হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় সরকারকে এ শৃঙ্খল থেকে বের করে আনতে হবে। বরং স্থানীয় সরকারকে স্থানীয় শাসনের ক্ষমতা দিতে হবে। এ কমিশন মূলত তারই রূপরেখা প্রণয়ন করবে। পুরোনো কাঠামোর অসঙ্গতি দূর করে সংস্কারের দিকে নিয়ে যাবে।

স্বশাসিত স্থানীয় সরকার দীর্ঘদিনের দাবি। কারণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মানুষের আগ্রহ, অনুভূতি অনেক বেশি। স্থানীয় সরকারের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি মানুষই চায় তাদের দাবিদাওয়া স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি পূরণ করুক। কিন্তু যেহেতু স্থানীয় সরকার বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে তাই তাদের কার্যপরিধি বিস্তৃত হলেও ফলপ্রসূ কার্যক্রম নেওয়া সম্ভব না। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্ভবত স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব অনুধাবন করে একটি কমিশন গঠন করে। পরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ কমিশন তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। কেন ? প্রশাসনের আমলারা তৎকালীন সরকারকে কোনো পন্থায় বুঝিয়েছে, স্থানীয় স্বশাসন প্রতিষ্ঠা হলে কেন্দ্রীয় সরকার ও এমপিরা তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলবেন। তারা একটি বিষয় ভুলে গেলেন, আমরা স্থানীয় স্বশাসিত সরকারের কথা বলেছি। স্থানীয় পর্যায়ে নিজ চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্যই দায়িত্বপ্রাপ্ত এ সরকার। এ সরকার যেমন জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, তেমন সরকারের কাছেও তাদের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

স্থানীয় স্বশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বরং সরকার জনগণের অনেক কাছে পৌঁছাতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে অঞ্চলভেদে কিছু বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আমরা সামাজিক কল্যাণ খাত বলে যে বরাদ্দ নির্ধারণ করে থাকি তা না করে স্থানীয় সরকারকে তা দিতে পারি। তাদের এ ক্ষেত্রে কিছু শর্তও বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। এসব শর্তের মধ্যে একটি হতে পারে নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে ও স্থানীয় এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে স্থানীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। স্থানীয় সরকারের আয়ের উৎসগুলোও তাদের নিজস্বভাবে করে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকবে। স্থানীয় সরকারের পরিষেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। যেসব স্থানীয় সেবা স্থানীয় সরকার দিতে পারে সেগুলোর দায়িত্ব তাদের ওপরই থাকা ভালো। এভাবে প্রশাসনিক কাজের বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব।

স্থানীয় সরকার জনগণের সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনব্যবস্থায়ও সংস্কার জরুরি। স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনব্যবস্থায় ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হয়ে আসেন নয়জন সদস্য। সমগ্র এলাকা থেকে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর এক ইউনিয়নে সব ওয়ার্ড থেকে একজন মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। এটি খারাপ নজির। নারীদের নির্বাচন করতে হয় প্রতি তিন ওয়ার্ড থেকে। পুরুষরা আলাদা নয় ওয়ার্ড থেকেই নির্বাচিত হন। নারী সদস্যরা আনুপাতিক হারে কম নির্বাচিত হন। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় নারীদের তাহলে এত সংগ্রামের মধ্যে রাখার দরকার কী? এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য প্রার্থিতা অবারিত করে দেওয়া হোক অথবা একটি ওয়ার্ডে নারী প্রার্থীদেরই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। প্রতি নির্বাচনে তা আগেই স্পষ্ট করে দেওয়া হবে। প্রতিবারই এক ওয়ার্ড নির্দিষ্ট থাকবে এমন নয়। নারীদের স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করার বিষয়টিতেও বাড়তি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি ভাবা দরকার বলে মনে করি।

ইউনিয়ন পরিষদকে স্বশাসিত করা জরুরি। তাদের অর্থ দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তাদের সরকার যে অর্থ বরাদ্দ দেবে তার পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে পরবর্তী বছর বরাদ্দ পাবে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মতো সুযোগ সরকারের হাতে থাকে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকারকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। সে আয়ের ভিত্তিতেও স্থানীয় সরকার কিছু কিছু জায়গায় কাজ করবে। ফলে স্থানীয় সরকারও এক ধরনের বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন হয়ে উঠবে। দেশে ৪ হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। অর্থাৎ তালিকা অনেক দীর্ঘ। এ দীর্ঘ প্রশাসনিক কাঠামো পরিচালনা করা জটিল। এ জটিল প্রক্রিয়াটি সফল করার জন্যই স্থানীয় স্বশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। স্বরাষ্ট্র, কর আদায় বা কিছু জরুরি বিষয় কেন্দ্রীয় প্রশাসনের হাতে থাকতেই পারে। কিন্তু জনগণের পরিষেবা থেকে শুরু করে স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত করে দিয়ে জবাবদিহির নিশ্চয়তা করতে হবে। যদি তা করা যায় তাহলে স্থানীয় সরকার নিজেদের মতো গড়ে উঠতে থাকবে। তারা এর প্রক্রিয়াও সুগম করার জন্য আগ্রহী হবে।

উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়ায়ও সংস্কার আনতে হবে। এখানে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যারা সদস্য হন তাদের সঙ্গে উন্নয়নমূলক সংস্থায় জড়িত সাবেক কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করা যেতে পারে। তারা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন। এ ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এ পরিষদে নারী ও পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদের কার্যকারিতাই নেই। ফলে স্থানীয় সরকারের কার্যকারিতা নেই এমন পদের বিলোপও অনেক জরুরি। স্থানীয় সরকারকে মসৃণভাবে পরিচালনার জন্য সংস্কারও করতে হবে। যদি সংস্কার না করা হয়, তাহলে এ ব্যবস্থারই বিলোপ করে দেওয়া উচিত। কারণ স্থানীয় সরকারের পেছনেও খরচ রয়েছে এবং এ ব্যবস্থা সরকারের বর্ধিত অংশ হিসেবে কাজ করলে রাষ্ট্রের বৃহত্তম কোনো স্বার্থই উদ্ধার হবে না। স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন সময়ের দাবি। স্থানীয়  সরকার হোক স্বশাসিত।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com