তাঁর আগমন ছিল বিশ্বাবসীর মুক্তির পয়গাম
সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব॥ প্রাক ইসলামি যুগের খ্রিস্টিয় ষষ্ট শতাব্দীর বিশ^ব্যবস্থা এক নীতিহীন ও ভ্রষ্ট স্বেচ্ছাচারী মতবাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ এই ধরনের স্থ’লচিন্তা মানুষকে উন্মাদ ও বিকারগ্রস্থ করে ফেলে। নগদ আনন্দ, নগদ প্রাপ্তি এই কামনা বাসনা জীবনকে চরম অধপতনের দিকে নিয়ে যায়। ক্ষমতায় যে প্রবল, জোর জবরদস্তিতে যে যতো পারদর্শি ভাগ ও ভোগে তার ততোটাই অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ অবস্থা শুধু আরবদের মধ্যেই নয় এ নমুনা গোটা পৃথিবীর। আর এর পেছনে ছিল একজন ত্রানকর্তা বা উদ্ধারকারীর অনুপস্থিতি। যিনি তাদের সামনে এক সাম্যের ভিত্তিতে বিশ^নীতি পেশ করবেন। মানবমুক্তির সনদ বাস্তবায়ন করবেন। মানুষের মনের বহু বছরের অজ্ঞতা ও পঙ্কিলতা ধোয়ে মুছে পরিস্কার করবেন। দিনে দিনে জাহেলিয়্যাতের ঘন তমি¯্রা বেড়েই চলছিল। কিন্তু রাত যতো আঁধার হয়, ভোর ততোই নিকটে আসে। নীতিহীনতার এই তিমির আঁধার দূর করতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয়তম বান্দা ও রাসূল, বিশ^মুক্তির দূত, নবীয়ে কাওনাইন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এমন সময়ে প্রেরণ করবেন এটাই ছিল তার কুদরতের নিদর্শন। এই আঁধার তাড়ানোর দায়িত্ব তাকেই তিনি দেন। পৃথিবীর এই অবস্থা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেনÑ
وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاء فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُم مِنْهَا ْ
অর্থ্যাৎÑ আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে এখন তোমরা তার অনুগ্রহে ভাই ভাই হয়েছো। তোমরা এক জ¦লন্ত অগ্নিকুন্ডের পাড়ে দাঁড়িয়েছিলে অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। (সূরা আলে ইমরান- ১০৩)
কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ীÑ প্রাক ইসলামি যুগের ভোগবাদী ব্যবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যখন একে অন্যকে শত্রু জ্ঞান করতো। মানুষ এক জ¦লন্ত অগ্নিকুন্ডের পাড়ে দাঁড়িয়েছিল। যখন-তখন সে এ আগুনের কুন্ডের মধ্যে পড়ে ছাই হয়ে যাবার অবস্থা। এই অবস্থা থেকে মানুষকে আল্লাহর রাসূলের মাধ্যমে ভাই ভাই করে দিয়েছেন। সম্প্রীতির বন্ধনে তাদেরকে একই প্লাটফর্মে এনে দিয়েছিলেন। পরস্পরের শত্রুতাকে ভালবাসায় উন্নীত করেছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম বা আগমন এ পৃথিবীতে আল্লাহর কুদরতের সবচেয়ে বড় নিদর্শন। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনে ইসলাম বা ইসলামি জীবন ব্যবস্থাই ছিল মানবমুক্তির পথ। আর দশটা ধর্মের মতো ইসলাম কতোগুলো আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়। এটি সমগ্র মানুষ জাতির মুক্তির পয়গাম। আর এই পয়গাম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর পেয়ারা হাবিবকে দিয়ে এ পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মের মাধ্যমে নতুন পৃথিবীর উদ্বোধন হয়েছিল। মানুষের যাবতীয় অন্ধবিশ^াস, ¯্রষ্টা সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা পরিস্কার করেছিলেন তিনি। মূলত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাত ধরেই পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, মানুষের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি মানুষকেই সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন। মানুষকে নিয়েই মানবের জয়গান গেয়েছেন।
মানুষ যখন নিজে ¯্রষ্টা বানিয়ে তার পায়ে মস্তক লুটিয়ে তার উপাসনা করে মানবীয় শ্রেষ্টত্বকে ছোট করেছিল তার ভিত্তিমূলে তিনি আঘাত করেছেন। বলেছেন মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। একমাত্র এক আল্লাহ ছাড়া কারো পায়ে মানুষ সেজদা দিতে পারে না। এই আসমান জমিন, চন্দ্র, সূর্য, গাছবৃক্ষ সব মানুষের জন্য। মানুষের পায়েই এসব মাথা লুটাবে। মানুষ এসবের পায়ে মাথা নোয়াতে পারে না। বরং পৃথিবীর সকল ভোগ্য সামগ্রী মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। এ মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নোয়াবার নয়। এ শিক্ষা দিতেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট মানবাতাবাদী হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এই ধুলির ধরায় আগমন করেন।
জাহেলী যুগে গোত্রীয় কৌলিন্য ও নিজেদের চন্দ্র ও সূর্য বংশীয় দাবি করে মানুষের উপর মানুষের আধিপত্যবাদী শ্রেষ্ঠত্বকে তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেনÑ একমাত্র খোদাভীতি ছাড়া কোন অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, একইভাবে কোন আরবের উপরও অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শে^তাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের উপর শে^তাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নাই। তিনি দাসদাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বলেছেনÑ তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তা পরতে দিবে। পবিত্র কুরআনে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে এভাবেÑ
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آَدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ الْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَاتَفْضِيلًا
অর্থ্যাৎ- নিশ্চয়ই আমি বনী আদমকে মর্যাদা দান করেছি; আমি তাদেরকে জলে স্থলে চলাচলের বাহন দান করেছি। তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈলÑ৭০)
হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ। এই রহমত শুধু মুসলমানদের জন্য নয়। সমগ্র আলমের মানব দানব ও বৃক্ষ তরুুলতা সকলের জন্যই রহমত ছিলেন। তার রহমতের পেয়ালা থেকে কেউ বঞ্চিত নয়। সে তাকে মানুক বা না মানুক। এই রহমতের বারিবর্ষণ এখনও পৃথিবীবাসীর উপর বর্ষিত হচ্ছে।
মিলাদুন্নবী (সা.) মানে নবীর জন্ম। আরবিতে মিলাদ মানে জন্ম। সমগ্র পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট মানুষ ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তার জন্মকে উপলক্ষ করে পৃথিবীর সকল উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। এই মহামানবের জন্মের সুসংবাদ ও আলোচনা পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থেই করা হয়েছে। তার জন্মের সময় অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। জন্মের পর খ্রিস্টান পাদ্রী ও ইহুদী ধর্মজাযকরা তাকে দেখে তাদের কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী মিলিয়ে নিয়েছেন। তাকে আখেরী বা শেষ নবী বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় জন্মের আগে যার আলোচনা ছিল জন্মের পরে তার জন্মালোচনা কিভাবে বিদয়াত হতে পারে? পবিত্র কুরআনে শুধু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আলোচনা নয় বরং অন্যান্য নবী রাসূলেরও আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনার মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্য শিক্ষা।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নসবনামা পৃথিবীর আদি মানব আদম (আ.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। তিনি পৃথিবীতে এতিম অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করেছেন। জন্মের ৬ বছরের মধ্যে মা হারা হয়েছেন। অন্যান্য মানুষের চাইতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম থেকে বড় হয়ে উঠা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এইসব আলোচনার বিষয়। পৃথিবীর মানুষের সামনে তার সমগ্র জীবন তোলে ধরার বিষয়।
যার জন্ম আছে তার জন্মদিনও আছে। একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্ম ও মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। এ হিসাবে একজন মানুষ তার জন্মদিন পালন করতে পারবে। শরীয়ত সম্মত পন্থায় একজন মুসলমান তার নিজের বা অন্যের জন্মদিন পালন করা দূষণীয় নয়। জন্মদিন পালনের কিছু লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকে আনন্দ বা খুশি প্রকাশ করা। জন্মদিন পালনকারী ব্যক্তির জীবনী আলোচনা করা। তার জীবনের শিক্ষাকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। খানাপিনার আয়োজন করা। এসব আমাদের সমাজে চলমান রীতি রেওয়াজ। সমাজ বাস্তবতার কারণে দ্বীন-ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন অনেক কিছুই আমাদের করতে হয়। রাসূলের জন্ম দিনকে উপলক্ষ করে এখন সারাবিশে^ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করা হচ্ছে। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে কর্মসূচির মধ্যে বড় একটি কর্মসূচি হচ্ছে আনন্দ শোভাযাত্রা বা বর্ণাঢ্য র্যালি। নগর বা শহরের রাজপথে এ দিনকে উপলক্ষ করে র্যালি বের হয়। র্যালির মাধ্যমে মুমিন মুসলমানরা আনন্দ প্রকাশ করেন। রাসূলের শানে কালজয়ী নাত, শের ও কবিতা পড়া হয়। ইয়া নবী সালামু আলাইকা, ইয়া রাসূল সালামু আলাইকা’ বলে রাসূলের প্রতি সালাতু সালাম পেশ করা হয়। এসবের কিছুই তো শরীয়তের বরখেলাপ নয়। বর্তমান সময়ে আলেম উলামাদের মধ্য থেকে কিছু আলেম উলামা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনকে বেদায়াত ও নাজায়েয বলে রায় দেন। এটা নিতান্তই পক্ষপাতমূলক রায় বা বক্তব্য।
বর্তমান সময়ে ইসলামকে কটাক্ষ্য ও হেয় করার প্রবনতা বাড়ছে। রাসূলের চরিত্র ও রিসালতকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা চলছে নিরন্তর। ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাণপ্রিয় নবীকে নিয়ে মনগড়া ও বিদ্বেষমূলক লেখালেখি করা হচ্ছে। এইসব প্রচারণার ফাঁদে মুসলিম তরুণ ও যুবকরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। রাসূলের প্রতি যে মুহাব্বাত ও ভালবাসা থাকার কথা এইসব প্রচারণা তাদের মনে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। এইসব অপপ্রচারণা ও দ্বন্দ্ব নিরসনে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন যেমন জরুরী তেমনি রাসূলের প্রতি প্রকাশ্যে মুহাব্বত প্রকাশের কর্মসূচিও অতীব জরুরী। মাহে রবিউল আউয়াল মাস এ রকম প্রকাশ্য কর্মসূচি গ্রহণের সময় মোক্ষম সুযোগ। রাসূলের জন্মের এ মাসে রাসূলের জন্ম থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত মহান জীবনের শিক্ষা বিশ^বাসীর সামনে তুলে ধরা উচিত। রাসূলের শান সম্পর্কে যতো জানা যাবে তার প্রতি ততো মুহাব্বাত বৃদ্ধি পাবে।
সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব : সহযোগী সম্পাদক, সাপ্তাহিক পূর্বদিক
মন্তব্য করুন