তেইশে মার্চ-একাত্তোর-পাক-প্রজাতন্ত্র দিবসে-আমাদের প্রতিরোধ দিবস ঃ ইতি কথাঃ স্মৃতি কথা

March 19, 2020,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ তেইশে মার্চ একাত্তোর পাকিস্তানের- প্রজাতন্ত্র দিবস- রিপাবলিক ডে-। একাত্তোরের তেইশে মার্চের প্রজাতন্ত্র দিবসই ছিল শেষ প্রজাতন্ত্র দিবস- কারন একদিন পরই পাকিস্তানের মৃত্যু ঘন্টা বেজে ওঠে। এক বছরের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাক হানাদার বাহিনীর মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্ব সমর্পনের পর অর্জিত হয় আমাদের চীর কাংখিত প্রিয়তম স্বাধীনতা। একাত্তোরের তেইশে মার্চকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিরোধ দিবস প্রটেষ্ট ডে হিসাবে ঘোষনা করেন।
প্রসঙ্গঁত উল্লেখ্য: বাঙ্গাঁলী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আপোষহীন নেতা আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনকে বাঙ্গাঁলির মুক্তি সনদ-ঐতিহাসিক ছয়দফা কমসূচীর রেফারেন্ডাম বলে ঘোষনা করেন। ষাটের দশকের শুরুতে পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আয়ূব খান তথাকথিত জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এবং শক্তিশালি কেন্দ্রের নামে উচ্চাভিলাসী সামরিক জান্টা এবং গন বিরোধ পাকিস্তানী আমলাতন্ত্রকে নিয়ে বাংলা ও বাঙ্গাঁলির স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন হীন কার্য্যক্রমে মেতে উঠে। এভড়ো, প্রডো, ডি.পি.আর, ইত্যাদি কালাকানুনের মাধ্যমে বাঙ্গাঁলি জাতিয়তাবাদী আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা করে। বাঙ্গাঁলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একচ্ছত্র নেতা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবকে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা সহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এমতাবস্থায় ঐ দশকে ঐ সময়ে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্টার লক্ষে ছাত্রলীগ নেতা-তাত্বিক সিরাজুল আলম খান গোপন সংগঠন -নিউক্লিয়াস- গঠন করেন। এই প্রক্রিয়ায় তাঁর সঙ্গেঁ সম্পৃক্ত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজি আরিফ আহমদ। বঙ্গঁবন্ধুর প্রাদেশিক স্বায়ত্ত ও শাসনের দাবী সম্বলিত ছয়দফা কর্মসূচীর প্রচারে দেশব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন নিউক্লিয়াসের জানবাজ নেতা কর্মিগন। তখন চীন ও রাশিয়া পন্থীগন বঙ্গঁবন্ধুকে মার্কিন সম্রাজ্যবাদী এজেন্ট আবিস্কার করতঃ বিরোধিতা করতে থাকেন। উনসত্তোরের ছাত্র-গনঅভ্যুত্থানে সামরীক স্বৈর শাসক আয়ুব শাহীর পতন হয়। বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব কারা মুক্তি লাভ করেন। পাক ফৌজি শাসক লেঃ জেঃ এ.এম.ইয়াহিয়া খান লিগেল ফ্রেইম ওয়ার্ক ওর্ডার-এল.এফ.অ. এর আওতায় দেশব্যাপী উভয় পরিষদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। আওয়ামীলীগের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস-ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। দেশব্যাপী উৎসবি আমেজের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করেন।
আমার মানব জীবনের আনন্দ ও গৌরব জনক অধ্যায় ছাত্র জীবনে, জাতীয় জীবনের সেই সব আন্দোলনে সংগ্রামে অংশ গ্রহন করেছিলাম। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন কর্ম্মি -সংঘঠক হিসাবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহন করি। সেই সময় শক্তিমান সংঘঠক-তাত্বিক সিরাজুল আলম খান এর দেশ প্রেম, সততা, কর্তব্যনিষ্টা ও নির্লোভ নির্মোহ জীবনাচরনে বিমোহিত-বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। এখনও আছি। অবশ্য এখন তিনি- এবং বহুদিন থেকেই কোন দলীয় রাজনীতিতে নেই-প্রশাসনিক সংস্কার মূলক চৌদ্দ দফা কম্মূসূচী, অধ্যাপনা ও অধ্যায়ন নিয়েই আছেন। তাঁর স্নেহভাজন কর্মি হিসাবে ষাটের দশকের শুরুতে প্রথমত: মৌলভীবাজার কলেজ এবং অতঃপর তৎকালীন মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। মৌলভীবাজার কলেজ থেকে গ্রেজুয়েশন ডিগ্রি অর্জনের পর পিতা মাতার নির্দেশে মাষ্টার্স অধ্যয়নের জন্য ঢাকা চলে যাই। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হই। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে যাবার, সান্নিধ্য পাবার, তাদের সঙ্গেঁ কাজ করার সুযোগ পাই।
সত্তোর সালের সাধারন নির্ব্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের নিরংকুশ বিজয় হলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টাল বাহানা শুরু করেন পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট লেঃ জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁন। আসে উত্তাল মার্চ মাস। পহেলা মার্চ, এক ঘোষনায় তিছরা মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করেন কায়েমী স্বার্থবাদীদের ক্রীড়নক ক্ষমতা লিপ্সু জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁন। গর্জে উঠে বাংলাদেশ-‘ইয়াহিয়ার ঘোষনা -মানি না মানব না, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। জিন্না মিয়ার পাকিস্তান আজিমপুরের গুরস্থান’ শ্লোগানে। খান সেনারা মিছিলের জবাব দেয় বুলেট দিয়ে। দুই, তিন মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইসতেহার পাঠ করেন। ডাকসুর, ভিপি, আশম আব্দুর রব কলাভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষন দেন, বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আন্দোলন-সংগ্রাম চুড়ান্ত আকার ধারন করতে থাকে। নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে আমরা অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় চলে আসি। এ সময় আমার অগ্রজ প্রতিম-ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সমাজ সেবা সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন মনির (পরে বৃটেনে বাংলাদেশের মান্যবর হাই কমিশনার)। আমাকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতেন। মনির ভাই নিজ উদ্যোগে আমাকে সেন্ট্রাল ল’- কলেজে ভর্ত্তি করিয়ে দেন। কারন তিনি জানতেন আমি সরকারি চাকরিতে যাব না, পেশা হিসাবে আইন সম্মান জনক ও স্বাধীন।
নিজ জন্ম ও প্রিয়ভূমি মৌলভীবাজার এসে ছাত্রলীগের নব গঠিত কমিটির সঙ্গেঁ অসহযোগ আন্দোলনের কাজ কর্ম করতে থাকি। তখন প্রত্যেক বৎসর ছাত্রলীগের নিয়মিত কাউন্সিল ও কমিটি গঠিত হত। আমার পরবর্ত্তী-স্থলবর্ত্তী কমিটির সভাপতি-সম্পাদক ছিলেন দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মুকিত। অকাল প্রয়াত নুরুল ইসলাম মুকিত মুক্তিযুদ্ধের সংঘঠক এবং একজন সৎ-আদর্শ রাজনীতিবিদ ছিলেন। জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মিছবাহুর রহমান এই পরিবারেরই সু-সন্তান। তেইশে মার্চ একাত্তোর-মৌলভীবাজার মহকুমা ব্যাপী ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জাতীয় কর্মসূচীর অংশ হিসাবে প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচী ঐতিহ্যবাহী চৌমুহনা চত্তরে ছাত্র গনজমায়েত এর আয়োজন করা হয়েছে। -“জয় বাংলা বীর বাঙ্গাঁলী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা-” গগন বিদারী শ্লোগানে চৌমুহনা চত্বর প্রকম্পিত-মুখরিত হয়ে উঠে। প্রসঙ্গঁত উল্লেখ্য আমি নিজেও খুবই উচ্চ কন্ঠে শ্লোগান দিতাম শ্লোগানের কারনে আমার নাক মুখ দিয়ে অনবরত রক্তপাত হতে থাকে। তখন এই ছোট মহকুমা শহরে আজ কালকের মত এত ডাক্তার, কবিরাজ ক্লিনিক, ফার্মেসী ছিল না। তৎকালীন সরকারি হাসপাতালের বড় ডাক্তার আব্দুল হেকিম বিনা ফিতে আমাকে আন্তরিক ভবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন প্রায় পঞ্চ্যাশ বৎসর পর আমি এখনও তাঁকে কৃতজ্ঞাতা ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করি।
তেইশে মার্চ একাত্তোরের পড়ন্ত বিকাল বেলা। মুহুর্মুহু গগন বিদারী জয়বাংলা শ্লোগানের মধ্য দিয়ে চৌমুহনা চত্বরে মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরীরর সভাপতিত্বে প্রাক্তন সভাপতি এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা মুজিবুর রহমান মুজিবের (এই নিবন্ধকার) প্রধান আতিথ্যে প্রতিবাদ সভার কাজ শুরু হয়। ছাত্র সভাটি বিশাল ছাত্র-যুব- জনজমায়েতে পরিনত হয়। টান টান উত্তেজনা ও শ্লোগানের মাধ্যমে সভার প্রধান অতিথি, সভার সভাপতি এবং সভার সঞ্চালক মহকুমা ছাত্রলীগের সম্পাদক নূরুল ইসলাম মুকিত সহযোগে চানতারা খচিত পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। পাকিস্তানী জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পুড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি উড়ান। এই পুড়ানো-উড়ানোর ছবি তুলেছিলেন চৌমুহনাস্থ মুক্তা ফটো ষ্টুডিও কর্তৃপক্ষ। পাক সেনা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই ছবি সংগ্রহ করতঃ শহর বাসিকে এই আকর্ষনীয় আলোক চিত্র দেখিয়ে ঝুলুম নির্যাতন করে জানতে চেয়েছে- “গুন্ডা মুজিব ক্যাহা হ্যায়”। বড় চুল-গুপের কারনে খান সেনাদের ধারনা ছিল আমি একজন গুন্ডা-পান্ডা-প্রকৃতির লোক। আমার শ্রদ্ধেও প্রফেসর বিমল কান্তি ঘোষ সুজন বাবু স্যারকে খান সেনারা আমার ছবি দেখিয়ে- বাতাও গুন্ডা ক্যাঁহা হ্যায়- বলে তাঁকে নিগৃহিত করেছে। এই দুঃসংবাদ তিনি স্বয়ং আমাকে জানিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ না হলে খানদের পাকিস্তান টিকে থাকলে ছবি ও পতাকা পুড়ানো সংক্রান্ত রাষ্ট্র বিরোধী অপরাধে আমার ফাসি হত।
তেইশে মার্চ একাত্তোর-আবেগ উত্তেজনা-মিটিং-মিছিলে সরগরম ছিল চৌমুহনা চত্বর। বক্তাগন স্বাধীন বাংলার পতাকার মান মর্য্যাদা সংরক্ষনের অঙ্গীঁকার ব্যক্ত করেন। লাল সবুজের পতাকায় সয়লাভ হয়ে যায় ছোট ছিমছাম মফস্বলের এই মহকুমা শহর। আমাদের জাতীয় জীবনেও একাত্তোরের তেইশে মার্চের গুরুত্ব অপরিসিম। সমগ্র বাংলাদেশে শুধুমাত্র সেনা নিবাস সমূহ ছাড়া কোথাও চান তাঁরা খচিত পাকিস্তানী পতাকার অস্তিত্ব ছিলনা। ঐদিন বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বাসা বাড়িতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রসঙ্গঁত উল্লেখ্যঃ চার খলিফা হিসাবে অভিহিত ও পরিচিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা চতুষ্টয় হলেন রব (আসম আব্দুর রব), সিরাজ (শাহজাহান সিরাজ), সিদ্দিকী (নূরে আলম সিদ্দিকী), মাখন (আব্দুল কুদ্দুছ মাখন-অকাল প্রয়াত)। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের এই চার বীরের সঙ্গেঁ আমার ব্যাক্তিগত জানা শুনা ও সু-সম্পর্ক ছিল। এদের মধ্যে ডাকসুর জিএস আব্দুল কুদ্দুছ মাখন দুরারোগ্য বাধিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে ইন্তকাল করেছেন। মহান মালিক তার বেহেশত নসীব করুন। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজ গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যা শায়ী। তাঁর আশু রোগ মুক্তি কামনা করি। নূরে আলম সিদ্দিকী এবং আশম রব একাত্তোরের চেতনা ও দেশপ্রেম নিয়ে এখনও বলছেন। লিখছেন। জাতিকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।
প্রায় অর্ধশত বৎসর পর তেইশে মার্চ একাত্তোরের উজ্জল স্মৃতি আমার স্মৃতিতে সমুজ্জল। আছে অন্তরে। অনুভবেও।
তেইশে মার্চ একাত্তোরের জাতীয় বীরদের প্রতি সালাম ও সশ্রব্ধ শ্রদ্ধঞ্জলি।
[ষাটের দশকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা। মুক্তি যোদ্ধা। সিনিওর এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com