দেশের একমাত্র ডুবন্ত বন হাকালুকি হাওর হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র
হোসাইন আহমদ॥ চির সবুজে সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ভেসে চলা কার্পাস তুলোর মতো মেঘ, ঝর্ণার পানিতে এলিয়ে দেয়া নাগরিক জঞ্জালে ক্লান্ত শরীর, বৃষ্টিস্নান চা বাগানে গজিয়ে ওঠা নতুন কুঁড়ি মৌলভীবাজার ছাড়া বিশ্বের আর কোথায়ও পাওয়া যাবে না প্রকৃতির এমন মোহনীয় অপরূপ দৃশ্য। প্রকৃতির এমন অতুলনীয় স্থান দক্ষিণ এশিয়ার এক বৃহত্তম হাওর, হাকালুকি হাওর। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় এর অবস্থান। ২০,৪০০ হেক্টর আয়তন, ২৩৬টি বিল নিয়ে এই হাকালুকি হাওর। বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বর্ষাকালে এই হাওরের দৃশ্য দেখা যায় ভিন্নরূপে। বিল ও নদীগুলো একীভূত হয়ে রূপ ধারণ করে সাগরের ন্যায় এক বিশাল জলাশয়ের। এ সময় হাওরের বিলের পার, ইজল/করচ গাছের বন ও কিনারায় বিদ্যমান জলাভূমি, গাছপালা পানির নিচে ডুবে গিয়ে সৃষ্টি করে ডুবন্ত বন এবং ব্যবহৃত হয় মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে। বর্ষাকালে হাওরপারে বসবাসরত মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় এক অন্য রকম উন্মাদনা।এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে একটি প্রবাদ আছে বেটা বলতে মাবুদ মুনসি বাকি সব পুয়া, হাওর বলতে হাকালুকি বাকি সব কুয়া”। আর সেই অপরূপ সুন্দের্য্যরে লিলাভুমি হাকালুকি হাওরকে দেখতে ১৩ অক্টোবর মৌলভীবাজার শহর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে জুড়ী কন্ঠিনালা নদীর ব্রীজে পৌছিলাম। সাথে ছিলেন মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম উমেদ আলীসহ ৬ জন সাংবাদিক ও ১জন সিনিয়র লেখক ও গবেষক ছাদেক আহমদ। পূর্ব থেকেই আমাদের নৌকা প্রস্তুত ছিল। প্রস্তুত ও প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে হাকালুকির উদ্দেশ্যে নৌকাতে উঠলাম। নৌকা ছেড়ে একটু আগাতেই দেখি নদীর দু-পাশে সারি সারি কাশফুল। কাশফুলের সেই বাগান দেখতেও অনেক ভালো লেগেছিল। সে সময় ছাদিক ভাইর কন্ঠে ভেজে উঠে ভাটিয়ালি গান। ১০ মিনিট যাওয়ার পর আমরা হাকালুকির অতল জলরাশির মধ্যে ডুকে পড়লাম। যে দিখে থাকাই শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছিল এটি আরেক মহাসাগর। মাঝে মধ্যে জেলেদের ২/৪টি ও অন্যান্য পর্যটকদের নৌকা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। পড়ন্ত বিকেল বেলা হাওরের এই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল বাস্তবে এটিই বিশ্বের সব চেয়ে সুন্দর জায়গা। এ সময় আকাশ ছিল মেঘাচন্ন। হাওরের মৃদ বাতাসে পানির কলাত কলাত শব্দ যে কারো ভালোলাগার মতো। হাওরে স্থাপন করা হয়েছে পরিবেশ টাওয়ার। এটাতে উঠে হাওরের দৃশ্য দেখতে আরো ভালো লাগে। বিকলে ৫টায় নৌকা ছেড়ে শহর থেকে নিয়ে আসা খাবার আহার করলাম। হাওরের সচ্ছ পানিতে হাত ধৌয়ে খাবার খাওয়ার মজাটাই আলাদা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের জলরাশির মাঝে সূর্য থেকে আসা কিরণ বেশ মনোমুগ্ধকর।
আর শীতকালে হাওরটি প্রকৃতির সম্পূর্ণ সুন্দর্য্য কেড়ে নিয়ে সাজে আরেক অপরূপ সাজে। এ সময় অতিথি পাখিরা সারি বেঁধে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসতে থাকে বিলগুলোতে। এইসব পরিযায়ী পাখিদের আগমনে হাওর যেন পরিণত হয় স্বর্গোদ্যানে। আর এ সময় অতিথি পাখিদের মতো মানুষের কলকাকলিও কোনো অংশে কম নয়। শীত মৌসুমে এশিয়ার উত্তরাংশের সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিদের প্রায় ২৫ প্রজাতির হাঁস এবং জলচর পাখি হাওর এলাকায় ভ্রমণে আসে। তাদের সাথে যোগ দেয় আমাদের দেশের প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখি। হাওরে পরিযায়ী হাঁসের মধ্যে রয়েছে রাজসরালী, গরাদমাথা রাজহাঁস, চখাচখী, ধলাবেলে হাঁস, গাডোয়াল, ইউরেসীয় সিথীহাঁস, টিকীহাঁস, পাতিহাঁস প্রভৃতি আরও অসংখ্য প্রজাতির হাঁস। দেশি প্রজাতির হাঁসের মধ্যে রয়েছে বেগুনি কালেম, পানমুরসী, পাতিকুট, ডাহুক, ইউরেসীয় মুরগী চ্যাগা, রাঙ্গাচ্যাগা, জলাপিপি, ময়ূরলেজা পিপি, পাতি জিরিয়া, হাট্টিটি, ভূবনচিল, শঙ্খচিল, কুড়াল ঈগল, বড়খোঁপা ডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি, খয়রা বক, সাদা বক প্রভৃতি অসংখ্য পাখি।এছাড়া হাওরের বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তার মধ্যে রয়েছে, আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরও নানা প্রজাতির। শীতকালে হাকালুকি হাওর ভ্রমণের সেরা সময়। কারণ এ সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিযায়ী পাখিদের পাশাপাশি মানুষেরও ঢল নামে। তাই নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসটাই হাওর ভ্রমণের সেরা সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। জলজ উদ্ভিদ আর মাছ প্রেমীদের জন্যও এ সময়টা সেরা। এ সময়ে এই হাওর থেকে প্রচুর মাছও ধরা হয়। তাই এ সময় এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে।
পর্যটকদের অভিমতঃ পরিকল্পিত ভাবে দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রে ন্যায় এশিয়ার বৃহত্তম এই হাওরটিকে যদি সাজানো যায় তাহলে প্রতিনিয়ত আগমন ঘটবে হাজারো পর্যটকের। এখন যে বা যারা আসছেন নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে আকর্ষণীয় এই স্থানটি দেখার জন্য রাজধানীসহ দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে আসছেন। তাদের দাবি যাতায়াত, খাবার ও রাত্রী যাপনের যথাযত ব্যবস্থা করা হলে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকদের আগম ঘটবে। সরকার এটার মাধ্যমে অনেক টাকার রাজস্ব আদায় করতে পারবে। হাকালুকি হাওর সম্পর্কিত কিছু তথ্য : হাকালুকি হাওর সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর। উল্লেখ্য হাওর শব্দটি সংস্কৃত শব্দওসাগরএর বিকৃত রূপ বলে ধারণা করা হয়। অর্থাৎ হাওরের উৎপত্তি হয়েছে এভাবে সাগর>সাওর>হাওর।
বর্ষা, শীত এমনকি সারা বছরই এই হাওর ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী। অন্যান্য দর্শনীয় জায়গাগুলোর সাথে প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন এশিয়া মহাদেশ তথা বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর জীববৈচিত্রসমৃদ্ধ হাকালুকি থেকে। পূর্বে পাথারিয়া ও মাধব পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড়পরিবেষ্টিত হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার বড়লেখা, জুড়ি, কুলাউড়া ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ এই পাঁচটি উপজেলা মিলে বিস্তৃত। ছোট-বড় ২৪০ টি বিল ও ছোট-বড় ১০ টি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওর বর্ষাকালে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়। এই হাওরে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকের বেশি এবং সঙ্কটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পাওয়া যায়। পাঁচটি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওরটি সিংহভাগ এলাকা মৌলভীবাজার জেলা ও কিছুটা সিলেট জেলায় অবস্থিত। ২৪০টি বিল নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওর।
নামকরণ হলো যেভাবে : হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত রয়েছে, অনেক বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজার সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় লুকি দেয় অর্থাৎ লুকিয়ে থাকে। কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি। এও বলা হয় যে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড এক ভূমিকম্পে আকা নামে এক নৃপতি ও তার রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। কালক্রমে তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নামকরণ হয় আকালুকি বা হাকালুকি। আরো শোনা যায়, একসময় বড়লেখা উপজেলার পশ্চিমাংশে হেংকেল নামক একটি উপজাতি বাস করতো। হেংকেলদের বসবাস এলাকার নাম ছিল হেংকেলুকি। পরবর্তীতে এই হেংকেলুকিই হাকালুকি নাম ধারণ করে। অন্য একটি জনশ্রুতি মতে, একসময় হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি বসবাসরত কুকি ও নাগা উপজাতি তাদের ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করে হাকালুকি যার অর্থ লুকানো সম্পদ।
কি ভাবে যাবেন : রাজধানী ঢাকার কমলাপুর ও ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন ৩টা ট্রেন ছাড়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে। ট্রেনের ভাড়া প্রকার ভেদে ১২০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আর সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা। ট্রেনে গেলে রাত সাড়ে ৯টার উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। এছাড়া বাসেও যাওয়া যাবে। বাসে যেতে চাইলে অনেক বাস আছে। এর মধ্যে শ্যামলী, রূপসী বাংলা, হানিফ, সোহাগ, এনা, ইউনিক, উল্লেখ যোগ্য। এছাড়াও আরো বিভিন্ন নামের একাধিক বাস রয়েছে, যেগুলো অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় যাত্রী সেবা করে থাকে। ভোর থেকে শুরু করে রাত ১টা পর্যন্ত এসব বাস পাবেন। বাসে যেতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। ননএসি ৩০০/৩৫০ টাকা। এসি ৯০০ টাকা পর্যন্ত। আপনি যদি কুলাউড়া নেমে যান তবে ভাল। কুলাউড়া থেকে অটোরিক্সায় সরাসরি ভুকশিমইল, ভাটেরা অথবা কন্ঠিনালা হয়ে হাওরে চলে যেতে পারেন। রাতে আসলে কুলাউড়ায় অনেক হোটেল আছে সে গুলোতে আপনি রাত্রিযাপন করে পরের দিন ভোরে সূর্যোদয়ের সময় গেলেও হাওরের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পারবেন।
মন্তব্য করুন