দানিয়াল মৃত্যুহীন
এ্যাডভোকেট কিশোরী পদ দেব শ্যামল॥ স. ব. ম. দানিয়াল। সৈয়দ বুলন্দ মুনির দানিয়াল। মৌলভীবাজার এর সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, শিক্ষা, স্কাউড অঙ্গনে অতি পরিচিত নাম দানিয়াল। প্রশাসন, অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ, খেলোয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক , সমাজকর্মী সকলের সাথে সৈয়দ দানিয়াল এর সম্পর্ক ছিল। প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয় কোন অনুষ্ঠান বা কর্মসূচী গ্রহণ করলেই দানিয়ালকে প্রয়োজন হয়েছে। সকলের গৃহীত কর্মসূচীর বাস্তবায়নে শিক্ষক দানিয়াল ছিলেন সত্যিকার ভরসার স্থল। দানিয়াল কোন অনুষ্ঠান আয়োজনে বা সহযোগিতায় খুব আন্তরিক ছিলেন।
সৈয়দ বুলন্দ মুনির দানিয়াল ছিলেন মৌলভীবাজার পৌরসভা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সুনামধন্য একজন শিক্ষক। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কও ছিল মধুর। তাহার কর্মস্থলেও তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়। ছাত্র জীবন হতেই খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, সাহিত্য বিষয়ক কার্যক্রমে, কাব, স্কাউট ইত্যাদি নানা বিষয়ে জড়িত ছিলেন তিনি।
দানিয়াল একজন দায়িত্বশীল ও সচেতন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। যে কাজটি করবেন সেই কাজের প্রতি ছিল তাহার পরিচ্ছন্ন মনোনিবেশ। তাহার ব্যবহার ছিল মার্জিত এবং সহনশীল। সহকর্মীর সাথে ছিল তাহার আকর্ষণীয় বোঝাপড়া। যে কারণে সমষ্টিগত কাজে তাহার সাফল্য ছিল শতভাগ। তিনি প্রতিটি কাজ খুব নিষ্ঠার সাথে করতেন। কার্য সম্পাদনে তাহার ছিল অত্যন্ত আন্তরিক অভিরুচি। দানিয়াল ছিলেন সকলের প্রিয়। কোন সংকীর্ণ গণ্ডিতে তিনি বসবাস করতেন না। কোন রাজনৈতিক পরিচয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করার বা প্রতিপত্তি অর্জন করার চেষ্টা করেন নাই। যে কারণে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয় এবং সর্বত্র সমাদৃত। নিজেকে নিজের সরল ও সার্বজনীন কর্মপরিসরে নিয়োজিত করার যে যোগ্যতা তা তিনি অর্জন করেছিলেন।
তিনি মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন । নাটক , সাহিত্য কর্ম ও স্কাউট মৌলভীবাজার সরকারী স্কুলেই হাতে খড়ি হয়। স্কুল জীবনে স্কাউট ছিল জীবন গঠনের একটি প্রকৃষ্ট প্ল্যাটফরম। নিময়ানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা, দক্ষতা, বাধ্যবাধকতা, সততা, পারস্পরিক ভালবাসা , সকলের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক রক্ষা ইত্যাদি শিক্ষার সূতিকাগার হচ্ছে স্কাউট। দানিয়াল এ সকল গুণাবলী অর্জন করেছিলেন। প্রতিটি কাজ খুব নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে করতেন। মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শত বর্ষ উদযাপনের সময় তাহার কর্মদক্ষতা সকলকে মুগ্ধ করেছে। স্কাউট এর বিভিন্ন কার্যক্রমে ও স্কাউট জাম্বুরী সংক্রান্ত সকল কার্যক্রমে দানিয়াল ছিলেন একজন বলিষ্ট কর্মকর্তা।
মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে বিভিন্ন স্কুল থেকে স্কাউট ও গার্লস গাইড নানা প্রদর্শনী করে থাকে। বিজয় দিবসের মাঠের অনুষ্ঠানে দানিয়াল একবার দেখালেন দুটি আবিস্কার (১) নৌকেল ও (২) হেলেম্পু। অর্থাৎ নৌকা ও সাইকেল দ্বারা নৌকেল তৈরী করা হয়। এই যানটি জলে ও স্থলে চালানো যাবে। আর হেলেম্পু আকাশে ও মাটিতে চালানো যাবে। হেলিকেপ্টার ও টেম্পু দ্বারা তৈরী এক ধরনের যান। দানিয়ালের মধ্যে ছিল উদ্ভাবনী ক্ষমতা। দানিয়াল ক্রীড়া অঙ্গনেও ছিলেন পরিচিত মুখ। তিনি রেফারী হিসাবেও কাজ করেছেন। তবে ফুটবল খেলার মাঠে খেলার ধারাবিবরণী বর্ণনায় দানিয়াল ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তাহার কথা বলার ষ্টাইল ও দক্ষতা সকলকে মুগ্ধ করতো।
১৯৮৫ সালে যুব বর্ষ। ১৯৮৫ সালে সৃজনী মৌলভীবাজার সেপ্টেম্বর মাসে এক মাস ব্যাপী যুব বর্ষ উদযাপন করে। তখন আমি ছিলাম সৃজনীর চেয়ারম্যান। ১৯ শে সেপ্টেম্বর কাশীনাথ আলাউদ্দিন হাই স্কুল এণ্ড কলেজে মৌলভীবাজারের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন করি। এই সম্মেলনে কবি মহাদেব সাহা , কবি রফিক আজাদ ,কলকাতার লেখক মলয় চন্দন মুখার্জী সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সাহিত্য সম্মেলনে দানিয়াল একজন ভাল কর্মী হিসাবে আমাকে সাহায্য করেন। এ মাসেই সৃজনী কয়েকটি নাটক মঞ্চায়ন করে। দানিয়াল বলেন , তাহার লেখা একটি নাটক ‘‘ টমটম আলীর ক্যামেরা’’ মঞ্চস্থ করবেন। সুতরাং দানিয়ালের নাটকও যুব বর্ষে যুক্ত হয়। সৃজনীর উদ্যোগে মৌলভীবাজারে ১৯৮৪ ইংরেজীতে সর্ব প্রথম বৈশাখী মেলা করি। স্থান ছিল কাশীনাথ আলাউদ্দিন স্কুল এণ্ড কলেজ। তখন স্কুলের একজন প্রভাবশালী শিক্ষক ছিলেন ষাটের দশকের সেরা গল্পকার মরহুম আজিজুল হক ইকবাল। তিনি প্রধান শিক্ষক মরহুম আহমুদুর রহমানকে বলে স্কুলে মেলা করার অনুমতি করে দেন। পৌর সভার জনপ্রিয় চেযারম্যান সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী বৈশাখী মেলার আয়োজনে ব্যাপক সাহায্য করেন। এই মেলায় দানিয়াল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রকৃতপক্ষে দানিয়াল বলতেন, ‘দাদা , আপনি যা আয়োজন করবেন আমি অবশ্যই আপনার সাথে থাকব। আর আমার প্রতিটি অনুষ্ঠানে এবং নাটকে দানিয়ালকে কাছে পেয়েছি।
দানিয়াল কিন্তু সমাজ কর্মে বা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত কোন উৎসবে নিজে থেকেই যোগদান করতেন। কোথায় ভাল কাজ হচ্ছে সে বিষয়ে তাহার সর্বত্র যোগাযোগ থাকতো। সৃজনশীল কাজে দানিয়াল সব সময় নিজেকে বিলিয়ে দিতে ভালবাসতেন। দানিয়াল ছিলেন সদালাপী। সকলের সাথে ছিল তাহার প্রাণের সম্পর্ক। দানিয়ালকে কখনও খুব একটা রাগান্বিত দেখা যেতো না। তাহার ছিল প্রাণখোলা কথা বার্তা। তাহাকে সবাই চিনতো ও ভালবাসতো।
দানিয়াল একজন ভাল অনুষ্ঠান উপস্থাপক ছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষক দানিয়াল এর উপস্থাপনা ছিল খুবই প্রাণবন্ত। তাহার উপস্থাপনের ষ্টাইল ছিল আলাদা। সকলেই এরূপ উপস্থাপন প্রশংসা করতেন। আসলে তাহার সাথে জেলার সকলের ছিল মধুর সম্পর্ক। যে কারণে কোন অনুষ্ঠান উপস্থাপন করার সময় তাহার চারদিকে নজর থাকতো।
কে কোন দিকে আছে , কার নাম কখন নেয়া উচিত সে অনুযায়ী ঘোষণা করার যে কায়দা তা দানিয়াল ভাল ভাবে জানতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে খুব জুনিয়র ছেলেদেরও তিনি খুবই গুরুত্ব সহ মূল্যায়ন করতেন। তাহার কাছে সকলেই ছিল আপন।
দানিয়াল মৌলভীবাজার এর সংস্কৃতি, ক্রীড়া , স্কাউট এবং শিক্ষা অঙ্গনে নিজের যে অবস্থান তৈরী করেছেন তা চিরদিন জেলাবাসীর হৃদয়ে জাগ্রত থাকবে। দানিয়ালের কর্মই তাহাকে বাঁচিয়ে রাখবে। মানুষ তাহার মহৎ কর্মে চিরজীবি থাকে। দানিয়াল কর্ম করেছেন সকলের জন্য সুতরাং সকলের মাঝেই তাহার অবস্থান।
দানিয়াল অকালে চলে গিয়েছেন। এ পৃথিবীর আলোতে আর তাহাকে দেখা যাবে না। কিন্তু হৃদয়ের আয়নায় দানিয়াল চিরস্মণীয় হয়ে থাকবেন। সৎকর্ম যারা করেন তারা সব সময় মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন। দানিয়াল চলে গেলেন না ফেরার দেশে কিন্তু অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মানুষ তার কর্মে বেঁচে থাকে। দানিয়াল ছিলেন জনপ্রিয় ব্যক্তি। যিনি মানুষের প্রিয় তিনি মহান সৃষ্টিকর্তারও প্রিয়। দানিয়ালও তাহার কর্মে চিরকাল ঁেবচে থাকবেন। দানিয়ালরা মৃত্যুহীন। আমি এই মহান হৃদয়ের অধিকারী পৌরসভা আদর্শ স্কুলের একজন প্রাণবন্ত শিক্ষক সৈয়দ বুলন্দ মুনির দানিয়াল এর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। দানিয়াল সম্পদের গহিনে প্রবেশ করেননি, কিন্তু ভালবাসার সীমাহীন সমুদ্রে তিনি অবগাহন করেছেন। তিনি সকল মানুষের ভালবাসায় স্নাত হয়েছেন। আজো শিক্ষক দানিয়াল সাহেবের নামে অনেকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়।
মন্তব্য করুন