দেশজুড়ে জুড়ীর কমলার সুনাম থাকলেও দিন দিন কমছে বাগান!
হারিস মোহাম্মদ॥ মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকার কমলার সুনাম দেশজুড়ে। এখানকার কমলা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, ভৈরব, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয় প্রতিদিন। রসালো ও মিষ্টি হওয়ায় অনেক পাইকারি ব্যাবসায়ী বিদেশেও রপ্তানি করে থাকেন এখানকার কমলা এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয় কমলা চাষীরা।
তবে দেশজুড়ে জুড়ীর কমলার সুনাম থাকলেও দিন দিন এ এলাকায় বিভিন্ন কারণে কমছে কমলার বাগান। চাষিরা বলছেন এখনি বাগান রক্ষায় সরকারি প্রদক্ষেপ না নিলে এক সময় হারিয়ে যাবে এসব কমলা বাগান। বাগান এলাকায় সাফারি পার্ক হবে তাই কমলা চাষের জমি হারানোর শঙ্কায় আছে কৃষকরা। বাগান এলাকায় সাফারি পার্ক হলে বাগান হারানোর সঙ্কায় অনেকে বাগানের পরিচর্যা না করায় ফলন কমে যাচ্ছে। এ বছরের আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও সময় মত বৃষ্টিপাত হওয়ায় গত বছরের তুলনায় ভালো ফলন হয়েছে এমনটা জানিয়েছেন কয়েকজন চাষি। তাদের দাবি সাফারি পার্ক হলেও যেন তাদের কমলা বাগান গুলোকে রক্ষা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের রূপাছড়া, লালছড়া, হায়াছড়া, শুকনাছড়া, কচুরগুল গ্রামে সবুজ কমলা চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এসব এলাকায় ছোট বড় ১০০ টির বেশি কমলা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে উৎপাদিত কমলা দেশের ভিটামিন সি এর ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে পোকামাকড়ের আক্রমণ, সময়মত বৃষ্টি সহ পানির অভাবে কমলার ফলন আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে।
জুড়ী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ৯৬.৫ হেক্টর জমিতে কমলা চাষ হয়েছে। এ উপজেলায় সাধারণত খাসি ও নাগপুরি জাতের কমলা চাষ হয়ে থাকলেও বর্তমানে কৃষি বিভাগের লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় কৃষককে প্রশিক্ষণ, সার ও চারা প্রদান এবং স্প্রে মেশিন প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন বাগান সৃজন করা হয়েছে। এখানে বারি-১, বারি-২ ও দার্জিলিং জাতের কমলার জাত গুলো এ প্রকল্পের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এছাড়া বারি-৩ জাতের কমলার মাতৃ চারা কয়েকজন কৃষকে দেওয়া হয়েছে।
কমলাচাষীরা জানান, যখন কমলা গাছে ফুল আসে তখন বৃষ্টি বা সেচের দরকার হয়। গতবার সময়মত বৃষ্টি না হওয়ায় ও সেচ দিতে না পারার কমলার ফলন ভালো হয়নি। বাগান গুলোতে যেকোন ভাবে সময়মত সেচের ব্যবস্থা করা গেলে ফলন ভালো হত। কমলা বাগানগুলোতে সেচের মাধ্যমে সরকারি ভাবে পানির সুব্যবস্থা করা গেলে উৎপাদন বাড়ানো যেত। কমলার ভালো ফলনে বর্তমানে একমাত্র বাঁধা সময়মত পানির অভাব। পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচতে কৃষি অফিসের সহায়তায় কীটনাশক ব্যবহার সহ বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষকেরা কমলা রোগমুক্ত রাখতে সচেষ্ট হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
আলাপকালে অনেক কমলা চাষি জানিয়েছেন, প্রতিবছর কমলা বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা লাভবান হলেও বিভিন্ন কারণে ফলন কম হওয়ায় দিন দিন তারা কমলা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। কমলাচাষিরা আরো জানান, আমাদের এলাকায় সাফারি পার্ক হবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। এখন যদি আমাদের শতাধিক বাগান এই সাফারি পার্কের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এখানে কমলা চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। যদি সরকার এটা বিবেচনা করে, তাহলে আমরা কমলাচাষিরা বাঁচব। তারা পরিকল্পনা করে কমলা বাগান গুলো রক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সরজমিনে বেশ কয়েকটি কমলা বাগান ঘুরে দেখা যায়, উচু টিলায় সারি সারি গাছে সবুজ আর সোনালি কমলা উঁকি দিচ্ছে। বাগানের আশেপাশে গেলেই কমলার সু-ঘ্রাণে মন ভরে যায়। কমলার মৌসুম হওয়ার কারণে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাগানে ব্যস্ত সময় পার করছেন কমলাচাষি ও শ্রমিকরা। বিক্রির জন্য বাগান থেকে পাকা কমলা সংগ্রহ করছেন চাষিরা। গাছ থেকে কমলা সংগ্রহ করার পর বাড়ির উঠোনে আকার অনুসারে বাছাই করছেন চাষিরা।
কমলা শ্রমিক দুদু মিয়া বলেন, ১৫/১৬ বছর যাবদ কমলা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। এ এলাকার কমলা বাগান গুলোকে সরকারি ভাবে আরো বেশি সহযোগিতা করা গেলে বাগান মালিকদের কমলা চাষে আগ্রহ বাড়বে।
কমলা চাষি ইব্রাহিম আলীর ছেলে জামাল আহমেদ জানান, আমাদের বাগানে ১’শ টি কমলা গাছ আছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও সময়মতো বৃষ্টিপাত হওয়ায় গতবারের তুলনায় এ বছর আমাদের বাগানে কমলার ভালো ফলন হয়েছে। সরকারি ভাবে সেচের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলে কমলার ফলন আরো ভালো হবে।
কমলাচাষী মোঃ জয়নাল মিয়া বলেন, বেশ কিছু কারণে আমার বাগানে কমলার ফলন একটু কম হয়েছে। তবে গতবারের তুলনায় এবার ফলন ভালো। তিনি আরো জানান, সাফারী পার্ক নির্মানের ঘোষণার ফলে কমলা চাষের জমি হারানোর আশঙ্কায় আছি।
কমলা চাষি মোরশেদ মিয়া জানান, গাছে যখন কমলার মুকুল আসে, ফুল দেয় তখন সেচের খুব প্রয়োজন হয়। ওই সময় আমরা সেচ দিতে পারি না, সে জন্য কমলার আকার ছোট হয় এবং ছোট কমলাগুলো ঝরে পড়ে। কমলার ভালো ফলনে সরকারিভাবে সেচের ব্যবস্থা করা হলে অনেক ভালো হতো।
স্থানীয় বাসিন্দা খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের এলাকায় ছোটবড় বেশ কিছু কমলা বাগান রয়েছে। এখানকার কমলার সুনাম রয়েছে দেশ বিদেশে। তবে গতকয়েক বছর ভালো ফলন হলেও দিন দিন বিভিন্ন কারণে কমলার ফলন কমছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সম্ভাবনাময় কমলা চাষ আরো সমৃদ্ধি লাভ করবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার মাহমুদুল হাসান খান বলেন, এ উপজেলায় সাধারণত খাসি ও নাগপুরি জাতের কমলা চাষ হয়ে থাকে। কিন্তু কৃষি বিভাগের লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় কৃষককে প্রশিক্ষণ, সার ও চারা প্রদান এবং স্প্রে মেশিন প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন বাগান সৃজন করছি। এখানে বারি-১, বারি-২ ও দার্জিলিং জাতের কমলার জাত গুলো এ প্রকল্পের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। আশা করছি এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভিটামিন সি এর ঘাটতি পূরণ হওয়ার পাশাপাশি কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মৌলভীবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ বলেন, উপজেলা কৃষি অফিস কমলা চাষীদের কে সার ও কীটনাশক দেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কমলা চাষিরা আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী কমলা গাছের যত্ন করে পোকামাকড়, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তিনি আরো বলেন, লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ প্রকল্পে (২০১৯-২০২৪) বছরমেয়াদি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে বারি কমলা-১, ২ ও ৩ দিয়ে নতুন বাগান করা শুরু হয়েছে।
মন্তব্য করুন