দেশের সর্বকনিষ্ঠ জেলা প্রতিনিধি
সায়েক আহমদ॥ সাংবাদিকদেরকে নিয়ে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করেন। কিন্তু তারা যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনই নিত্য-নতুন সংবাদ আমাদের সামনে হাজির করছেন, সে সংবাদ কয়জনই বা রাখি? প্রাণঘাতি করোনা মহামারীর সময়েও সংবাদ কর্মীরা ঘরে বসে নেই। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তারা তাদের কাজ করেই যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দেশের প্রতিথযশা কয়েকজন সাংবাদিকসহ অনেক সংবাদকর্মীর করোনায় আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুবরণ করার সংবাদও আমরা জেনে ফেলেছি। কাজেই এ পেশাটিকে মোটেও বাঁকা চোখে দেখাটা উচিত নয়। মুষ্টিমেয় কিছু দুর্নীতিবাজ সংবাদকর্মীর কারণে মিডিয়াজগত কলংকিত হয়েছে এবং হচ্ছেও, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এদেরকে দিয়ে মিডিয়াজগতকে মূল্যায়ন করা যুক্তিসঙ্গত নয়। দেশের কোন সেক্টরে দুর্নীতিবাজ নেই? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর চারপাশের দুর্নীতিবাজদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড দেখে মনের দুঃখ লাঘবের জন্য একটি কবিতা লিখেছিলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বঙ্গবন্ধু সারা জীবনে এই একটি মাত্র কবিতা লিখেছিলেন। তিনি স্বভাব কবি নন। কিন্তু তাঁর কবিতায় বিস্ময়করভাবে ফুটে উঠেছে দুর্নীতিবাজদের কর্মকাণ্ডের ঘৃণ্য চিত্র। কবিতাটি হল-
‘আমার কবিতা নীরবে নিভৃতে কাঁদে
বাংলার ভদ্রলোকেরা চুরি করে
আর মানুষকে ঠকায় ফেলে ফাঁদে।
আমি লালঘোড়া দৌড়াতে চাই
বুকে পাই ব্যথা
দেশটাকে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য
এনেছি কি স্বাধীনতা?’
কবিতাটির মূল কপি আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর নিকট সুরক্ষিত আছে।
এ উদাহরণটি দেয়ার উদ্দেশ্য হল দেশের সব জায়গাতেই দুর্নীতিবাজদের দাপট রয়েছে। মিডিয়াজগতেও আছে। এটা বিচিত্র কোন ব্যাপার নয়। তবে এদের কারণে মিডিয়াকর্মীদেরকে ঢালাওভাবে ‘সাংঘাতিক’ বলে অভিহিত করা সমীচিন নয়। তাই বলে মিডিয়াজগতে আদর্শ সাংবাদিক এবং সংবাদকর্মীদের অভাব নেই। এখনো জাতি আদর্শ সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে ভুলে যায়নি। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং এ আদর্শ সাংবাদিককে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। বঙ্গবন্ধু তার ‘মানিক ভাই’ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৪৯-এর সেপ্টেম্বর মাসের ১৫-১৬ তারিখ খবর এল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিরা শান্তি সম্মেলনে যোগদান করবে। শ্লোগান হলো, ‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই’। আমাদেরও যেতে হবে পিকিংয়ে, দাওয়াত এসেছে। সমস্ত পাকিস্তান থেকে ত্রিশজন আমন্ত্রিত। মানিক ভাই বললেন, তাঁর যাওয়া হবে না, কারণ ইত্তেফাক কে দেখবে? টাকা কোথায়? ইত্তেফাকে লিখবে কে? কিছু সময় পর খবর পেলাম চব্বিশ ঘণ্টা প্লেন লেট। আগামী দিন বারোটায় প্লেন আসবে, একটায় ছাড়বে। মানিক ভাইকে অনেক করে বললাম, একটু করে রাজি হলেন, তবে ঠিক করে বলতে পারছেন না। পরের দিন সকালে প্রস্তুত হয়ে আমি মানিক ভাইয়ের বাড়িতে চললাম। তখন ঢাকায় রিকশাই একমাত্র সম্বল। সকাল আটটায় যেয়ে দেখি তিনি আরামে শুয়ে আছেন। অনেক ডাকাডাকি করে তুললাম। আমাকে বলেন, কী করে যাব, যাওয়া হবে না, আপনারাই বেড়িয়ে আসেন। আমি রাগ করে উঠলাম। ভাবিকে বললাম, ‘আপনি কেন যেতে বলেন না, দশ-পনের দিনে কী অসুবিধা হবে? মানিক ভাই লেখক, তিনি গেলে নতুন চীনের কথা লিখতে পারবেন, দেশের লোক জানতে পারবে। কাপড় কোথায়? সুটকেস ঠিক করেন। আপনি প্রস্তুত হয়ে নেন। আপনি না গেলে আমাদেরও যাওয়া হবে না।’ মানিক ভাই জানেন যে আমি নাছোড়বান্দা। তাই তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিলেন।’
বর্তমান সময়ে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মত আদর্শ সাংবাদিকের বেশি বেশি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেজন্য আদর্শ সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদেরকে এখন থেকে তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ব্যাপারে সিনিয়র সাংবাদিকদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সাংবাদিক মানেই যেন ‘চাঁদাবাজ’ ও ‘ধান্দাবাজ’ এ দুটি শব্দ যেন আমাদেরকে শুনতে না হয়। সাংবাদিক মানেই যেন ‘ব্ল্যাকমেইলার’ ও ‘হলুদ সাংবাদিক’ এ টাইটেলগুলোও যেন শুনতে না হয়। সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী বলতে অল্পশিক্ষিত ও গোয়ারগোবিন্দমার্কা কোন ছবি যেন আমাদের চোখের সামনে ভেসে না উঠে। অসংখ্য ভুল বানানের ছড়াছড়ি দেখে কেউ যেন কটু কথা বলতে না পারে।
এবার সবার সামনে উপস্থাপন করব এক ক্ষুদে সংবাদকর্মীর কথা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, মাত্র পনের বছর বয়সের এ সংবাদকর্মী দেশের সর্বকনিষ্ঠ জেলা প্রতিনিধি। সে পড়ে ক্লাস নাইনে। কিন্তু ইতোমধ্যেই সে দৈনিক জয়বার্তার শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রতিনিধি এবং আলোড়ন টিভির মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছে। কৌতুহলবশত তার টাইমলাইনে ঢুকে আমি বেশ অবাকই হলাম। কারণ তার সংবাদ এবং প্রতিবেদন লেখার স্টাইলটি বেশ ভাল। হয়ত এখনো সে অনভিজ্ঞ। এখনো সংবাদকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে তার প্রচুর প্রশিক্ষণ এবং স্টাডি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাকে নিয়ে লেখার উদ্দেশ্য হল, আমরা সবাই মিলে একজন আদর্শ সংবাদকর্মী তৈরি করে নিতে পারি। কারণ তাকে যদি সঠিক গাইড লাইন দেয়া না হয়, তাহলে হয়তো সে কপি-পেস্ট করা রিপোর্টিংকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে পারে। হয়তো অভিজ্ঞতার অভাবে এমন কোন হঠকারী রিপোর্ট লিখে ফেলতে পারে যার কারণে তার জীবনও বিপন্ন হতে পারে।
প্রথমে তার পরিচয়টুকু দেয়া প্রয়োজন। তার নাম মো. আবদুল্লাহ আল যোবায়ের। সে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ছোটবেলা থেকে টিভিতে খবর দেখে এবং পত্র-পত্রিকা পড়ে সে সাংবাদিক হওয়ার লক্ষ্য স্থির করে। একদিন সে অনলাইনে একটি পএিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখতে পায়। সে তার পিতা এরশাদ হোসেন এবং মা কোহিনুর বেগমের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে। তার আগ্রহ দেখে তার পিতামাতাও উৎসাহ দেন। সে সংবাদকর্মী হিসেবে নিয়োগলাভের জন্য আবেদন করে। কিন্তু অল্পবয়সী দেখে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাকে নিরুৎসাহিত করেন। এরপর তার পিতা-মাতা তাকে অন্য জায়গায় চেষ্টা করার জন্য উৎসাহিত করেন। তারপর থেকে সে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগলাভের জন্য আবেদন করে। পরবর্তীতে সে দৈনিক জয়বার্তার শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রতিনিধি এবং আলোড়ন টিভির মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করে। পড়াশোনার পাশাপাশি সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করার আগ্রহ দেখে আমিও তাকে উৎসাহ প্রদান করি। কিন্তু একজন আদর্শ সংবাদকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করার জন্য তাকে কিছু নির্দেশনা প্রদান করার তাগিদ অনুভব করি। আশা করি এ লেখা থেকে অনেক কিছু উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। অনেকের হয়ত দ্বিমত থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট আকারে পরামর্শগুলো প্রদান করলে পরবর্তী লেখায় আমি তা সংযোজন করার আশা পোষণ করি।
১৯৮৪ সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমার লেখালেখির দিকে ঝোঁক বেড়ে গেল। সে সময় স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন এবং ঢাকা হতে প্রকাশিত ছোটদের কয়েকটি পত্রিকা যেমন শিশু, নবারুণ, ফুলকুড়ি ইত্যাদিতে সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি আমার কয়েকটি ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়ে গেল। সিলেট হতে প্রকাশিত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক যুগভেরী (বর্তমানে দৈনিক, প্রথম প্রকাশ-১৯৩০) পত্রিকায় ছড়া-কবিতা-গল্পের পাশাপাশি সংবাদদাতা হিসেবে হাতেখড়ি হয়ে গেল। লেখালেখি এমন তুঙ্গস্পর্শী পর্যায়ে পৌঁছল যে, সাপ্তাহিক যুগভেরীর একটি সংখ্যায় চার পৃষ্ঠার মধ্যে তিন পৃষ্ঠা জুড়েই আমার লেখা প্রকাশিত হল। আমার এ অভাবনীয় কান্ডটি অল্প সময়ের মধ্যে অনেকের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করল।
এইচএসসি পরীক্ষার পর অখন্ড অবসরে ‘রহস্যপত্রিকা’, ‘শিশু’, ‘নবারুন’, ‘ইত্তেফাক’, ‘ইনকিলাব’, ‘সংবাদ’ ইত্যাদি সহ বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হওয়ায় একটা সাহিত্যিক সাহিত্যিক ভাব চলে এসেছে। ইতোমধ্যে কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হতে শুরু করেছি। কিন্তু অন্তর্মুখীতার কারণে বাসায় বসে নীরবেই লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
বই পড়ার নেশাটাও তখন তুঙ্গে উঠেছিল। বিভিন্ন কৌশলে, খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়ে বই কিনি আর পড়ি। ধার করে বই পড়াতো চলছিলই। লেখালেখির অভ্যাসটাও বেশ জমে উঠেছে। অনেকগুলো গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখা হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিএসসি পরীক্ষাটাও দিয়ে ফেলেছি। অবশেষে ফুরসত পেলাম। সুযোগও পেলাম হুমায়ূন আহমেদ, কাজী আনোয়ার হোসেন, শামসুর রাহমান, মো. নাসিরউদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল সহ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে যাবার।
‘বাংলাবাজার পত্রিকা’র একটি সংখ্যায় পূর্ণপৃষ্ঠাব্যাপী জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সেলিম চৌধুরীর সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়েছিল। লেখালেখির তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ২০০০ সালে যখন প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলাম, তখন একটু থমকে যেতে হল। কারণ প্রধান শিক্ষক হিসেবে লেখালেখির সুযোগটা খুব কমই থাকে। নিয়মিত লেখক হিসেবে ২০০০ সালের মার্চ মাসে আমার সর্বশেষ লেখা ‘দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে অনিয়মিত হতে হতে একসময় লেখালেখি হতে বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছিলাম। করোনা দুর্যোগের এ মহামারীর সময় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার সুবাদে পেলাম বাধ্যতামূলক অষন্ড অবসর। সময় কাটাবার জন্য আবারো পুরাতন অভ্যাসটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তাই আবারো লেখালেখির জগতে ফিরে আসতেই হল।
এবার ফিরে আসি আমার অভিজ্ঞতা থেকে কিশোর সংবাদকর্মী যোবায়ের প্রসঙ্গে। আশি বা নব্বইয়ের দশকে পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়া কত কঠিন বিষয় ছিল, তা পুরাতন সাংবাদিক এবং লেখকরাই ভাল বলতে পারবেন। বারবার যাচাই-বাছাই করতে করতে লেখা প্রকাশিত হত বিধায় অনেক লেখাই সম্পাদকের কলমের পিষ্টেই মৃত্যুবরণ করত। কাজেই এত কড়াকড়ির মধ্যে ভাল এবং মানসম্পন্ন লেখা ছাড়া অন্য লেখা প্রকাশের সুযোগই থাকত না। তখন লেখা প্রকাশের জন্য সম্মানীও প্রদান করা হত। এতে লেখক কিংবা সংবাদকর্মীর উৎসাহও বেড়ে যেত। যদিও তা ছিল খুবই অপ্রতুল। লেখালেখি করে টাকা-পয়সা উপার্জনের চিন্তাও করা যেত না।
এখন আসা যাক, বর্তমান প্রেক্ষাপটে। অনলাইন পোর্টালসহ মিডিয়াজগত এখন বিশাল অবয়ব ধারণ করেছে। অনলাইন সাংবাদিকতার একটি নতুন ধারাও তৈরি হয়ে গেছে। তবে এগুলোর সবই যে মানসম্মত, তা মোটেও নয়। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা অনলাইন পোর্টাল, মানহীন ও নামসর্বস্ব পত্র-পত্রিকা মিডিয়াজগতকে কলুষিত করছে। এদের কল্যাণে অল্পশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত সংবাদকর্মী গজিয়ে উঠছে। এরা নিজেদেরকে সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচয় না দিয়ে স্বঘোষিত ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দিয়ে এলাকায় দাপটে ঘুরে বেড়ায়। সব জায়গাতেই মিডিয়াকর্মীদের মধ্যেও এখন বিভাজন রয়েছে। কাজেই নিজ নিজ স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াকর্মীরাও এদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। আর এভাবেই এরা দাপটের সাথে পুরো মিডিয়াজগতকেই কলুষিত করছে।
প্রতিষ্ঠিত এবং আদর্শ সাংবাদিক, সংবাদকর্মী কিংবা মিডিয়াকর্মীদেরকে এখন আদর্শ মিডিয়াজগত গড়ে তোলার সময় এসেছে। যারা ইতোমধ্যে যেভাবেই হোক মিডিয়াজগতে পা দিয়েই ফেলেছে, তাদেরকে সৎ এবং আদর্শভাবে সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সিনিয়রকে স্ব-উদ্দ্যোগে এদেরকে অনানুষ্ঠানিক কিংবা সম্ভব হলে আনুষ্ঠানিকভাবেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যোবায়েরের মত প্রতিশ্রুতিশীল ও উদীয়মান সংবাদকর্মীরা যেন নিজেদের আদর্শ স্থির করে নিতে পারে। তরুণ ও উদীয়মান সংবাদকর্মীদেরকে প্রথমেই লেখাপড়ার দিকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রমিত বাংলা বানান অনুশীলনের ব্যাপারে এদেরকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। সংবাদ সংগ্রহের নীতিমালাও এদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের কৌশলটুকুও এদেরকে শিখিয়ে দিতে হবে। একটা সংবাদ সংগ্রহের জন্য কপি-পেস্ট সাংবাদিকতা না করে সরজমিন পরিদর্শনসহ সকল পক্ষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সৌজন্যটুকুও এদেরকে শিখিয়ে দিতে হবে। যাচাই-বাছাই না করে ফেসবুকে ফস করে একটা কিছু লিখে বিভ্রান্তি ছড়ানো যে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, তাও এদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়াবহ দিকটাও এদের সামনে উম্মোচন করতে হবে। সর্বোপরি স্ব স্ব নিরাপত্তা বিধানের কৌশল এবং আত্মরক্ষার ব্যাপারটি তাদের মনে গেঁথে দিতে হবে। তাছাড়া বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ঘেঁটে তথ্যবহুল ঘটনাগুলো আগে স্টাডি করে পরবর্তীতে তা উৎসসহ সংবাদের সাথে সংযোজনের নীতিমালা গ্রহণের পথটাও দেখিয়ে দিতে হবে।
সবার আগে নবীন সংবাদকর্মীদেরকে এ জগতের ঝুঁকিটুকু উপলব্ধি করিয়ে দিতে হবে। অযথা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের ভয়াবহ দিক সম্বন্ধে সতর্ক করে দিতে হবে। তবে সর্বাগ্রে প্রতিবেদন লেখার কঠোর অনুশীলনের দিকে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলা বানান, বাক্য গঠন, অনুচ্ছেদ তৈরি, পরিদর্শন রিপোর্ট প্রস্তুতি এবং সবার শেষে নৈতিক উপলব্ধি কীভাবে রচনা করতে হবে তাও শিখিয়ে দিতে হবে।
সর্বশেষ কথা হল কারা এ দায়িত্ব গ্রহণ করবে? আদর্শ সাংবাদিক এবং সংবাদকর্মী গড়ে তুলতে হলে আদর্শবাদীদেরকে স্ব-উদ্যোগেই এগিয়ে আসতে হবে। নাহলে এক সময় এরাই হয়ে উঠবে এক একজন ফ্রাংকেনস্টাইন। এরাই শেষে আদর্শবাদীদের ঘাড় মটকে ফেলবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে সারাজীবন আদর্শের সাথে লড়াই করে বঙ্গবন্ধুও একসময় দুর্নীতিবাজদের কর্মকাণ্ডে প্রচন্ড হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোনদিনই অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করেননি। শৈশবেও করেননি, যৌবনে তো নয়ই, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তও ছিলেন আদর্শে অবিচল। মিডিয়াজগতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। তিনি অসংখ্যবার বঙ্গবন্ধুকে উজ্জ্বীবিত করেছেন। একই সাথে দেশকে আদর্শের মহান রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার সুপরামর্শ দিয়েছেন।
আব্দুল্লাহ আল যোবায়ের দেশের সর্বকনিষ্ঠ জেলা প্রতিনিধি। এটা অবশ্যই গৌরবের বিষয়। সে তার যোগ্যতাবলেই হয়ত এ পদে আসীন হয়েছে। তবে সে যদি লেখাপড়াকে জীবন গড়ার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয়, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় তার জন্য অপেক্ষা করছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কারণ সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত হয়ে সমাজকে কলংকিত করার কোন প্রয়োজন নেই। আদর্শ শিক্ষাই একজন আদর্শ সাংবাদিককে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়ে তুলবে।
মৌলভীবাজার জেলায় আমি একজন সাংবাদিককে পেয়েছিলাম যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী। তিনি একসময় রাজনগর ফাজিল মাদ্রাসায় অধ্যাপনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন। আমার প্রিয় ছাত্রী সৈয়দা সানজিদা শারমীনকে লেখালেখির প্রতি উৎসাহী দেখে আমি সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য তাকে উৎসাহিত করেছিলাম। সেও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেছিল। যারা প্রকৃত এবং আদর্শ সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়, তাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আগে সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করা। তারপরই সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। তাহলে মিডিয়াজগতে ভাল অবস্থান নেয়াও সম্ভব হবে, ভালো সম্মানীও পাওয়া সম্ভব। সাংবাদিক হতে হলে যে সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করা বাধ্যতামূলক তাও সঠিক নয়। তবে সম্মান এবং সম্মানীর ক্ষেত্রে এবং আদর্শ সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সেটাই অত্যাবশ্যক।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন