দেশে প্রথম বারের মতো পালিত হলো জাতীয় চা দিবস : বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডে প্রথম বাঙালী চেয়ারম্যান ছিলেন
বিকুল চক্রবর্তী॥ শুক্রবার ৪ জুন থেকে সিলেট বিভাগসহ সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় চা দিবস। সকাল ১০ টায় ঢাকা ওসমানী মিলনায়তনসহ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্রে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানাদির। দিবসটিতে উন্মুক্ত করা হবে বিটি-২২ ও বিটি-২৩। এ জাত দুটি বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ গবেষনা শেষে উন্মুক্ত হচ্ছে। যার একটি খড়া সহিষ্ণ ও অপরটি কোয়ালিটি চা ।
বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী জানান, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সোনার বাংলার রূপকার, জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ৪ ঠা জুন ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডে প্রথম বাঙালী চেয়ারম্যান হিসেবে চেয়ারম্যানের আসনটি অলংকৃত করেছিলেন। তাঁর সময়কালে নেয়া যুগান্তকারী পদক্ষেপসমূহ। যা বাংলাদেশ চা শিল্পকে করেছে সাফল্যমন্ডিত। চা শিল্পে ৪ঠা জুনের এই মাহেন্দ্র ক্ষণটিকে স্ম^রনীয় করে রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার দিনটিকে ’জাতীয় চা দিবস’ ঘোষনা করেছে। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রথমবারের মত ৪ জুন ২০২১ সালে জাতীয় চা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। চা বাগান বাংলাদেশকে তিনটি চা জোন অঞ্চল হিসেবে ঘোষনা দিয়েছেন। এর মধ্যে এক নম্বর সিলেট অঞ্চল, ২য় চট্টগ্রাম অঞ্চল ও তৃতীয় হচ্ছে পঞ্চগড় অঞ্চল।
বাংলাদেশ চা শিল্প প্রায় দেড়শ বছরের পুরানো। একটু একটু করে এই চা শিল্প একটি স্থায়ী টেকসই কাঠামোতে রূপ নিয়েছে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে চা আবাদ শ্রমঘন কৃষি ভিত্তিক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তিনি জানান, এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে চা খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চা বোর্ড প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অবাঙালীরাই চা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ জুন ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসাবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেন। তিনি চা বোর্ডের নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য ঢাকাস্ত মতিঝিলে ০.৩৭১২ একর জমি বরাদ্দ গ্রহণ করেন। তাঁর দিক নির্দেশনায় উক্ত বরাদ্দকৃত ভূমিতে চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্স স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি এবং শ্রীমঙ্গলস্থ ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যো গ্রহণ করা হয়। তিনি “টি অ্যাক্ট-১৯৫০” সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন যা এখনও চালু রয়েছে।
অত:পর ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের চা বাগানসমূহ পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক ব্যাপকভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। মহান স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময়ে তিনি ধ্বংস প্রাপ্ত চা বাগানসমূহ পুন:গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য “বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (BTIMC) গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন/পরিত্যাক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়াও যুদ্ধে বিদ্ধস্ত পরিত্যক্ত বাগান মালিকদের নিকট পুনরায় হস্তান্তর করেন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধ্বংস প্রাপ্ত চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। উক্ত সার সরবরাহ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন। যার সুবিধাদির মধ্যে ছিলো বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। তিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঞজও) নামে পরিচিত। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর উদ্ভাবিত নতুন নতুন টেকনোলজি এবং উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশের চা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুন।
চা শিল্পে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে চা শিল্প আজ টেকসই এবং মজবুত ভিত্তির উপর দাড়িয়েছে। ফলশুতিতে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে যেখানে চায়ের উৎপাদন ছিল ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি সেখানে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ৯৬.০৭ মিলিয়ন কেজি এবং ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ হতে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গত ০৫ বছরের উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দেশের জাতীয় গড় উৎপাদন ৮৫.৭২ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত হয়েছে। এ হতে প্রতিয়মান হয় যে, দেশের চা শিল্প একটি টেকসই অবস্থানে আসীন হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট ব্রান্স চেয়ারম্যান গোলাম মো: শিবলী জানান, এটি একটি আনন্দের সংবাদ। এতে এক দিকে বাংলাদেশের স্তপতিকে যেমন স্মরণ করা হবে তেমনি এদেশের চা শিল্প সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় আরো ব্যাপক ভাবে তুলে ধরা হবে। তবে তিনি জানান, এ দিবসের সার্থকতা তখনই পূণ্য হবে যখন আমাদের দেশে উৎপাদন আরো বাড়বে। দেশীয় চাহিদা পুরণ করে আগের মতো আমরা যখন চা বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশীক মুদ্রা অর্জন করতে পারবো।
এ ব্যপারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. রফিকুল হক জানান, বাংলাদেশে চা শিল্পের জন্য এটি একটি বড় প্রাপ্তি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের ফলে এদেশে চা শিল্পের আমুল পরিবর্তন হয়েছে। চা দেশের অন্যতম রপ্তানিকারক পন্য হিসেবে অধ্যিষ্টিত হয়। এর দ্বারা বহু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়। বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার পাশাপাশি অভ্যান্তরিন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়ায় রপ্তানি কমে গেছে। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সু চালো পদক্ষেপে দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে এতে আশা করা যায় আগামীতে রপ্তানী বাড়বে। আর উৎপাদন বৃদ্ধিসহ চা শিল্পকে পূর্বের ন্যায় রপ্তানিমূখী করতে এ দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
মন্তব্য করুন