“দোসরা জুলাই, উনিশ সাল সুবে-বাংলাও বাঙ্গাঁলির জাতীয় বীর নবাব সিরাজুদ্দৌলার দুইশত বাষট্টিতম শাহাদাত বার্ষিকী ঃ স্মরনঃ শ্রদ্ধাঞ্জলী: রুহের মাগফিরাত কামনা॥
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ দোসরা জুলাই দুই হাজার উনিশ সাল, সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ, বাংলা ও বাঙ্গাঁলির জাতীয় বীর নবাব সিরাজুদ্দৌলা মনসূরুল মুলক হায়বত জং বাহাদুরের দুইশত বাষট্টি তম শাহাদাত বার্ষিকী। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদ এর অনতি দুরে পলাশীর প্রান্তরে ষড়যন্ত্র মূলক পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় ও পতনের পর নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ করতঃ বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনায় নৌপথে পাটনা বার পথে মীর জাফর-মীরন বাহিনীর অনুচরদের হাতে ধৃত ও বন্দী হন নবাব সিরাজুদ্দৌলা, বেগম লুৎফুন্নেছা এবং একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জহুরা। মীরন বাহিনী অসম্মানের সাথে নবাবকে বন্দী করতঃ
অসৌজন্য মূলক আচরন করে, রাজধানী মুর্শিদাবাদের হীরা ঝিল প্রাশাদে বন্দী করে রাখে। পলাশীর যুদ্ধের পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী রভার্ট ক্লাইভ যখন রাজধানী মুর্শিদাবাদ অভিমুখে রওয়ানা হন তখন সুবে বাংলার ভাগ্যাহত নবাবের পলাশীর বিপর্য্যয়ের কোন খবরই জানেন না রাজধানী মুর্শিদাবাদ এর সাধারণ জনগণ। একজন ইংরেজ ঐতিহাসিকের মতে রাজধানী বাসি যদি এই বৈদেশিক আক্রমণকারীগণকে পাদুকা দিয়েই প্রতিরোধ করতেন তাহলে রভার্ট ক্লাইভ এর এত সহজে রাজধানী মুর্শিদাবাদ দখল সম্ভব হত না। ইতিপূর্বে পলাশীর যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে বাংলার প্রজা বৎসল নৃপতি নবাব আলী বর্দী খানের মৃত্যোর পর তাঁর প্রিয় দৌহিত্র, নিত্যসহচর ও যোগ্য উত্তর সূরী স্বাধীন চেতা সিরাজুদ্দৌলা মাত্র তেইশ বৎসর বয়সে সিংহাসন আরোহন করে কঠোর হস্তে আভ্যন্তরীন-প্রাষাদ ষড়যন্ত্র এবং বৈদেশিক আক্রমণ মোকাবিলা ও দমন করেন। তরুন নবাব সিরাজুদ্দৌলাও ছিলেন দাদু আলী বর্দীর মত দেশ প্রেমিক, বীর যোদ্ধা এবং বৃটিশ বিদ্বেসী। বাংলার লোক প্রিয় নবাব আলী বর্দী খাঁন অপুত্রক, তিন কন্যার জনক ও মানব দরদি শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনামলে ইরাকের নজফ থেকে ভাগ্য উন্নয়নের আশায় মীর জাফরের ভাগ্যহীন পরিবার নবাব এর দরবারে এসে আশ্রয় ও সাহায্য চাইলে মানবদরদি নবাব আলী বর্দী খাঁ ইরাকের সম্ভান্ত এই পরিবারকে আশ্রয় দিয়ে মীর জাফরকে একশত টাকা বেতনে উমেদার এর চাকরি দিয়ে ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের মূল পরিকল্পক ও খলনায়ক মীর জাফর একজন ধূরন্দর, বেঈমান, প্রতারক এবং ভক্তি চোট্টা প্রকৃতির লোক ছিলেন। নবাব আলী বর্দী মীর জাফর এর চালাকি-চতুরতায় বিশ্বাসী হয়ে বৈমাত্রেয় ভগ্নি শাহ খানমকে মীর জাফরের সঁেঙ্গ শাদী দিয়ে শাহী আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করলেন, সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে পরবর্তীকালে সুবে বাংলার সিপাহ সালার নিযুক্ত করেন। লোভী ও স্বার্থপর মীর জাফর তখন থেকেই নিজেকে অপুত্রক নবাব আলী বর্দীর উত্তরসূরী ভেবে বাংলার সিংহাসনের দিকে বদ নজর দেন। কিন্তু নবাব আলী বর্দী খাঁন যুবরাজ সিরাজকে তাঁর উত্তর সূরী ঘোষনা করলে স্বার্থপর মীর জাফর মনক্ষুন্ন হয়ে প্রাসাদ ঘড়যন্ত্রে মেতে উঠেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও নূতন নবাবের কাছ থেকে বানিজ্যিক সুযোগ সুবিধা না পেয়ে গোপনে নবাব বিরোধী শিবিরের সঙ্গেঁ যোগাযোগ করতে থাকেন। তারই ফলশ্রুতিতে জগৎশেঠ নামে কুখ্যাত সুদখোর মহাজন মাহতাব চাঁদ এর বাড়ীতে সিপাহ সালার মীর জাফার আলী খাঁন, রাজা রাজ বল্লভ, রায় দূর্লভ, উমি চাঁদ, সেনাপতি এয়ার লতিফ খাঁন কোম্পানীর প্রতিনিধি মিঃ ওয়াটস এর উপস্থিতিতে, বৈঠক, গোপন চুক্তি মোতাবেক বাংলার নবাবীকে নীলামে উঠানো হয়। বিশিষ্ট গবেষক- বাংলা দেশ জাতীয় আর্কাইভস এর পদস্থ কর্মকর্তা মীর ফূজলেহ্ আহমদ চৌধুরী তাঁর গবেষনা গ্রহ্ণ-দলিল পত্রে পলাশীর যুদ্ধের তথ্যমতে ১৭৫৭ সালের ১০ই মে বারোটি চুক্তি হয়েছিল উভয় পক্ষে। চুক্তির সারমর্ম ছিল সিরাজুদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করে সেনাপতি মীর জাফর-কে বাংলার নবা বানানো হবে, ইংরেজ কোম্পানী বিপুল পরিমান অর্থ ও বিনা শুল্কে বাংলায় বানিজ্য ও কুঠি নির্মানের সুযোগ পাবে। এক কথায় এই চুক্তি মতে বাংলার স্বাধীনতাকে কোম্পানীর হাতে বিক্রী করে দেয়া হল। এই গোপন চুক্তির বলেই বলীয়ন হয়ে কোম্পানীর কর্মচারী রভার্ট ক্লাইভ ১৭৫৭ সালের ১৩ইং জুন মাত্র এক হাজার ইংরেজ সৈন্য, দুই হাজার দেশীয় সিপাহী ছোট বড় মাত্র দশটি কামান নিয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যুদ্ধ যাত্রা করে ১৯শে জুন নবাবের নিয়ন্ত্রাধীন কাঠোয়া দখল করতঃ ২২ শে জুন ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীর আ¤্রকাননে শিবির স্থাপন করে ছিলেন। গোপন সূত্রে গুপ্তচর মারফত এই সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে বাংলার স্বাধীন চেতা নবাব কোম্পানীর সঙ্গেঁ কোন আলোচনা কিংবা সন্ধির প্রস্তাবনা পাঠিয়ে সরাসরি যুদ্ধের জবাব যুদ্ধের মাধ্যমে প্রদানের জন্য যুদ্ধ যাত্রা করেন। অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী মিলিয়ে নবাবের সৈন্য ছিল সাত চল্লিশ হাজার পঞ্চাশটি ছোট বড় কামান নবাবের অনুগত ফরাসি সেনাপতি সাঁ-ফ্রে- এর শখানেক প্রশিক্ষিত সৈন্য এবং চারটি ছোট কামান। তবুও সেনাপতি মীর জাফর, রাজা রাজ বল্লভ, রায় দূর্লভ এবং এয়ার লতিফের বিশ্বাস ঘাতকতায় পলাশীর যুদ্ধে পরাজয় বরন করতে হল বাংলা বাহিনীকে। নবাবের একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্থ সেনাপতি মীর মদন বীর দর্পে যুদ্ধ করে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই শহীদ হলেন রাজা মোহন লাল আহত হলেন, দূরে দাঁড়িয়ে সিপাহ সালার মীর জাফর ও তাঁর সহচরগণ ইংরেজের রন নৈপুন্য দেখছিলেন আর নবাব রাহিনার পরাজয় কামনা করতঃ নবাবীর দিবা স্বপ্ন দেখাছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধ প্রসঙ্গেঁ Cornel Malison Zuvi weL¨vZ MÖnè Decisive Battles of India ‡Z e‡jb- Ò Yes as a victory, Plessey was in its consequences perhaps the greatest ever gaind, but as a battle it is not incline opinion a matter to be proud of, in the first place it was not a fair fight, who can doubt. That if the three principal Generals of Sirajuddala had been faithful to their master, Plessey would not have been won”নবাব সিরাজুদ্দৌলার চরিত্র ও কৃতিত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে এই ইংরেজ ঐতিহাসিক অকপটে স্বীকার করেন-ঐ গ্রহ্ণেই আরো বলেন, সেই দুঃখময় নাটকের প্রধান অভিনেতাদের মধ্যে তিনি (সিরাজুদ্দৌলা) ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোন প্রতারনার আশ্রয় নেন নি”।
পলাশীর যুদ্ধের পর শুধুমাত্র বাংলায় নয় সমগ্র ভারত বর্ষেই অর্থনীতিতে পরিবর্তন ও বিপর্য্যয় নেমে আসে। ভারত থেকে বিলেতে ধন সম্পদ পাচার হতে থাকে। অর্থনীতিবিদগণ একে Plunder of Plessey পলাশীর লুন্ঠন Drain of wealth সম্পদের সিঃসরন বলে অভিমত প্রদান করেছেন। তেইশে জুনের দিবাবসনে চব্বিশে জুনের সুর্য্যােদয়-এ- বনিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজদন্ড রূপে, পোহালে শর্বরী-।” এই প্রসঙ্গেঁ উপমহাদেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ শ্রদ্বেয় স্যার যদুনাথ সরকার যথার্থই বলেন-“ Thus ended muslim rule in Bengal the foreign master of the sord had became kingmaker.
কোম্পানী মীর জাফর চুক্তি মোতাবেক সিপাহ সালার মীর জাফর আলী খাঁনকে সুবে বাংলার সিংহাসনে বসানো হল। কোম্পানী প্রচুর পরিমান অর্থ ও ধন সম্পদন প্রাপ্ত হলেন। বাংলার নবাবীকে নিষ্কন্টক করার জন্য বেঈমান মীর জাফর আলী খাঁন নবাবের অল্প বয়সী ভ্রাতা মির্জা মাহদি উদ্দৌলাকে তক্তা চাপা দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। নবাব পরিবারকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে রাখা নিরাপদ মনে না করে ঢাকায় জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখে।
নবাব জননী আমিনা বেগম, খালা খসোট বেগম নবাব পতিœ বেগম লুৎফুন্নেছা, শিশু কন্যা উম্মে জহুরা ঢাকার জিঞ্জিবা প্রাসাদে কারা যাতনা ভোগ করেন। বাংলার ভাগ্যাহত নবাব সিরাজুদ্দৌলা-কে ক্লাইভ-মীর জাফরের কু-পরামর্শে দোসরা জুলাই হীরা ঝিল প্রাসাদে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। বন্দী নবাবকে আঘাত করতে কেউ এগিয়ে না এলে নবাব পরিবারের লালিত পালিত মোহাম্মদী বেগ ছুরিকাঘাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে হত্যা করে।
জনমনে ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য মীর জাফর পুত্র মীরন শহীদ সিরাজুেেদ্দৗলার লাশকে খন্ড-বিখন্ড করে হাতি মারফত রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রদর্শন করিয়ে রাজধানীর রাজপথে ফেলে দেয়।
অবশেষে দীনহীন-সাধারণ ভাবে শহীদ সিরাজদ্দৌলাকে খুশবাগের শাহী গোরস্থানে দাফন করা হয়। বেগম লুৎফুন্নেছাকে মুক্তি দিয়ে নফর নবাব মীর জাফর আলী খান শাদীর প্রস্তাব দিলে তিনি তা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেন। বেগম লুৎফুুন্নেছা একমাত্র কন্য্যা সন্তানকে নিয়ে সীমাহীন কষ্টে কালাতিপাত করে বাংলা-ভারতের এক মুসলিম-নারীও বিধবা হিসাবে উন্নত নৈতিকতার পরিচয় প্রদান করেন। অথছ আধুনিক বিশ্বের আধুনিক জমানায় আমেরিকার এককালীন সুদর্শন ফাষ্ট লোভী স্বর্ণ কেশী জ্যেকুলীন কেনেডী স্বামী প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডীর মৃত্যের পর নবোতি পর বৃদ্ধ গ্রীক ধনকুবের জাহাজ ব্যবসায়ী এরিষ্টটল ও নাসিসের সাথে পুনঃ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছিলেন।
নবাব সিরাজ- লুৎফার ভালোবাসার ফল ও ফসল একমাত্র কন্যা সন্তান উম্মে জহুরা চৌদ্দ বৎসর বয়সে পদার্পন করলে গরিবী হালতে বিয়ে দেয়া হয়। উম্মে জহুরা চার কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে ইন্তিকাল করেন। এই চার কন্যা সন্তান হলেন ১. শরফ উন নিসা, ২. আসমত উন নিসা, ৩. সাকিনা বেগম এবং ৪. উম্মে তুলা বেগম। এদের উত্তরাধিকারীগণ নবাব সিরাজুদ্দৌলার অধ:স্থন বংশধর। সাংবাদিক লেখক নবাবজাদা আলী আব্বাসুদ্দৌলা- নবাবেরই অধ:স্থন বংশধর। তিনি রাজধানী ঢাকায় বসবাস করছেন। আমাদের সিরাজদ্দৌলা কিছু গল্প কথা-তাঁর লেখা তথ্য বহুল এক খানা নবাব বিষয়ক গ্রহ্ণ। ভারতের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ডক্টর অমলেন্দু দে-তাঁর গবেষনা গ্রহ্ণে নবাব সিরাজুদ্দৌলার আলেয়ার গর্ভজাত যুগল কিশোর রায় চৌধুরী নামে একজন পুত্র সন্তান ছিলেন এবং সিলেটের যুগল টি লাই তাঁর স্মৃতি বহন করছে বলে তথ্য দিলেও নবাব জাদা আলী আব্বাসুদ্দৌলা তা অস্বীকার করেন।
বেগম লুৎফুন্নেছা স্বামীর কবর দেখভাল করে নামাজ আদায় রত অবস্থায় স্বামীর কবেেরর পাশেই ইন্তিকাল করেন। শহীদ সিরাজুদ্দৌলার কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। খুশবাগের শাহী গোরস্থানে চীর শয়ানে শায়িত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ সিরাজুদ্দৌলা। ইতিহাস গবেষক ও পর্য্যটকগণ পলাশীর আ¤্রকানন পরিদর্শন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ ও রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। অপর পক্ষে বেঈমান মীর জাফর আলী খাঁন এর কবরস্থান-বাসস্থান এলাকা নিমক হারামের দেউরি হিসাবে কুখ্যাত। পর্য্যটকগণ সেখানে থু থু-ফেলেন- ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। রোজ কিয়ামত পর্য্যন্তই তাই চলবে।
বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ নবাব সিরাজুদ্দৌলার উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি। ২৩শে জুন পলাশী দিবস এবং দোসরা জুলাই শহীদ দিবস জাতীয় ভাবে উদযাপনের জোর দাবী জানাচ্ছি।
(মুক্তিযোদ্ধা। এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব, কলামিষ্ট।)
মন্তব্য করুন