দোয়েল বন্ধু

May 22, 2020,

সায়েকা আহমদ॥

এক: আমি যখন খুব ছোট তখন ভাবতাম পাখিদের রাজা হচ্ছে দোয়েল। আবার অনেকগুলো দোয়েল পাখি একসাথে দেখে চিন্তা করতাম এতগুলো রাজা হয় কীভাবে? রাজা তো হয় একজন। যেমন পিঁপড়ে বা মৌমাছিদের রানী আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সবাই তো রানী নয়। তাহলে কি দোয়েলদের মধ্যেও এরকম রাজা আছে। বাকী দোয়েল পাখিগুলো সে রাজারই সৈন্যবাহিনী? এসব চিন্তা করতে করতে আমি বড় হচ্ছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম জাতীয় পাখি আর পাখিদের রাজা একসাথে মিশিয়ে দেয়ার জন্যই আমার সমস্যাটি হয়েছিল। বনের রাজা যেমন সিংহ, তেমন আমি পাখিদের রাজা হিসেবে দোয়েলকেই চিন্তা করতাম।

দুই: একদিনের কথা। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। সেদিনও উঠেছি। হাত-মুখ ধুয়ে মনোযোগ সহকারে কিছু সময় পড়াশোনা করলাম। আম্মু যখন নাস্তা খাবার জন্য ডাকলেন তখন পড়াশোনা শেষ করে নাস্তা করলাম। নাস্তা করে ভাবলাম বাইরে থেকে একটু হাঁটাহাটি করে আসি।

বাসা থেকে বের হয়ে একটু সামনে যাওয়ার পর দেখলাম রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটি পাখি পড়ে আছে। আমি সেই পাখিটির কাছে গেলাম। সাদা আর কালো রঙের খুব সুন্দর পাখিটি। লেজ সামান্য লম্বা। আমি পাখিটিকে দেখেই চিনে ফেললাম। সাথে সাথে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলাম, ‘এটা তো একটি দোয়েল পাখি!’

পাখিটি তার পায়ে খুব ব্যথা পেয়েছে। দুটি পা-ই কেটে গেছে। পাখিটি যন্ত্রণায় নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে। আমি কাছে যেতেই পাখিটি চেঁচাতে শুরু করল। আমি ভাবলাম পাখিটি বোধহয় তার নিজস্ব ভাষায় তার ব্যথা পাওয়ার কাহিনীটি আমাকে বলছে। আমার খুব মায়া হল। আমি পাখিটিকে খুব যত্ন সহকারে হাতে তুলে নিলাম। দ্রুত বাসায় চলে এলাম।

তিন: আম্মুকে দেখাতেই তিনি তাড়াতাড়ি সামান্য কাঁচা হলুদ বেঁটে দিলেন। আমি সেই পেঁষা হলুদটুকু পাখির পায়ে লাগিয়ে খুব সাবধানে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। দেখে বুঝলাম পাখিটি একটু আরাম পেয়েছে। এরপর পাখিটিকে সামান্য খাবার খেতে দিলাম। প্রথমে ভয় পেয়ে খেতে চায়নি। তবে একটু পরই পাখিটি খাবারটুকু খেয়ে ফেলে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল। আমি একটি বোতলের মুখে সামান্য পানি নিয়ে পাখিটিকে পান করতে দিলাম। পাখিটি তাঁর দুঠোঁট দিয়ে অদ্ভুতভাবে পানিটুকু পান করল। সে পানির মধ্যে ঠোঁট ভিজিয়ে মুখে পানি নেয়, তারপর মাথা আকাশের দিকে তুলে পানিটুকু পান করে। এভাবে কয়েকবার পানি পান করে পাখিটি শান্ত হল। আমি পাখিটিকে একটি খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলাম। পাখিটির সেবাযত্ন করায় সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হল না। ভেবেছিলাম আম্মু খুব রাগ করবেন। কিন্তু তিনি স্কুলে না যাওয়ার জন্য কোন রাগারাগি করলেন না। বুঝলাম তিনিও চাইছেন পাখিটি সুস্থ হয়ে যাক।

চার:পরদিন পাখিটিকে আম্মুর জিম্মায় রেখে আমি স্কুলে গেলাম। টিফিন আওয়ারে দৌঁড়ে বাসায় এসে পাখিটিকে খাবার খাইয়ে আবার স্কুলে চলে গেলাম। স্কুল ছুটি হতেই আবার দৌঁড়ে বাসায় চলে এলাম। বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলতেও গেলাম না। এভাবে তিনদিন চলার পর দেখলাম পাখিটি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। আম্মু বললেন এবার পাখিটিকে ছেড়ে দিতে পারো।

পাখিটির প্রতি আমার খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম পাখিটিকে আমার কাছেই রেখে দেব। কিন্তু চিন্তা করলাম এ পাখিটিরও তো মা বাবা আছে। হয়ত ছেলে মেয়েও আছে। কাজেই পাখিটিকে বন্দী করে আমার কাছে রাখাটা ঠিক হবে না। তাই আমি পাখিটিকে খাঁচা থেকে বের করে আনলাম। ব্যান্ডেজটা খুলে দেখলাম কাঁটা জায়গাটা শুকিয়ে গেছে। কাজেই এখন পাখিটি সহজেই উড়ে যেতে পারবে।

আমি পাখিটিকে শেষবারের মত আদর করে দিলাম। খাবার খাওয়ালাম। তারপর বললাম, ‘শোন ছোট পাখি। তোমাকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। এখন তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছো। তাই তুমি তোমার পরিবারের কাছে চলে যাও। হয়ত তারা তোমার জন্য খুব চিন্তা করছে। যদি উড়তে পারো, তাহলে আকাশে উড়ে যাও।’

পাখিটি বোধহয় আমার কথাটি বুঝতে পারল। তোমরা কে কি ভাবছো জানি না। তবে আমার কাছে তাই মনে হল। সে আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর ডানা দুটো ঝাপটে সহজেই উড়ে গেল। প্রথমে বাসার সামনের গাছটিতে গিয়ে বসল। কিচিরমিচির করে একটু ডাকল। আমার মনে হল আমাকে বোধহয় ধন্যবাদ জানাল। তারপর পাখিটি উড়াল দিয়ে আকাশে ছোট্ট বিন্দুর মত মিলিয়ে গেল। আমি পাখিটির গমনপথের দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে রইলাম।

পাঁচ: দোয়েল পাখির বিদায়ের পর অনেকদিন কেটে গেছে। আমি আর পাখিটিকে দেখিনি। কয়েকদিন আমার মনটা খারাপ ছিল। তারপর বান্ধবীদের সাথে খেলতে খেলতে পাখিটির কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

সেদিন ছিল রবিবার। বিকেলবেলা। আমি বাসার ছাদে উঠে আমগাছের পাকা আমগুলো দেখছিলাম। আমগাছে সারি সারি লাল পিঁপড়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে আসা যাওয়া করছে। সে দৃশ্য দেখছিলাম। হঠাৎ কিচির মিচির শব্দে আমি চমকে উঠলাম। দেখি কিচিরমিচির করে করে একটি দোয়েল পাখি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মুখে একটি পুটলি। কাছে আসার পর আমি পাখিটিকে চিনতে পারলাম। এটা নিঃসন্দেহে আমার সেই দোয়েল বন্ধু।

উড়ে এসে দোয়েল বন্ধুটি আমার কাঁধে বসল। আমি হাত বাড়াতেই সে আমার হাতে উঠে এল। তারপর ঠোঁট থেকে ছোট্ট পুটলিটি আমার হাতে রেখে দিয়ে আবার উড়ে চলে গেল। আমি কোন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে দোয়েল বন্ধুটি আবারো হারিয়ে গেল।

ছয়: কি আর করব। আমি পুটলিটা খুললাম। ওটার ভেতরে কয়েকটি বীজ আর একটি ছোট্ট চিঠি আছে। আমি চিঠিটি পড়লাম। চিঠিতে লিখা-

প্রিয় মাহি,

আশা করি তুমি ভাল আছো। আমিও ভাল আছি। তুমি আমার অনেক সেবাযত্ন করেছো। উপকার করেছো। যতদিন বাঁচব, সেগুলো আমার মনে থাকবে। তাই তোমাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি তোমাকে যে বীজগুলো দিয়েছি, সেগুলো তোমার ফুলের বাগানে লাগাবে। নিয়মিত পানি দেবে। যত্ন করবে। বীজগুলো থেকে চারা বের হবে। প্রতিটি চারা এক একটি ফুলের গাছ হবে। যখন সে গাছগুলো থেকে ফুল ফুটবে, সেদিন আমি আবারো আসবো। বিদায়।

ইতি

দোয়েল বন্ধু।

আম্মুর ডাকাডাকিতে আমার সুন্দর স্বপ্নটি হারিয়ে গেল। ঘুম ভাঙ্গতেই আমি রাগ করে আম্মুকে বললাম, ‘ইস, তুমি আর ডাকাডাকির সময় পেলে না। এত সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখছিলাম। তুমি আমার স্বপ্নটা নষ্ট করে দিয়েছো।’

আম্মু বললেন, ‘ঠিক আছে। আর কখনো এভাবে ডাকবো না।’

আমি আম্মুকে বললাম, ‘এখন বলো, কেন আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছো?

আম্মু বললেন, ‘দরজা খুলে দেখি ছোট্ট একটি পুটলি পড়ে আছে। পুটলিটির মধ্যে কয়েকটি ফুলের বীজ আছে। ভাবলাম তুমি তো ফুলের বাগান করতে পছন্দ করো। তাই তোমাকে ডেকে তুলেছি। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হবার আগেই বীজগুলো রোপন করে ফেলো।’

আমি বললাম, ‘বীজগুলো কে দিয়েছে মা?’

আম্মু বললেন, ‘সেটা তো জানি না। তবে আমার মনে হয় কিছুক্ষণ কারেন্ট ছিল না। ঐ সময় কেউ বোধহয় এসে কলিংবেল টিপে কোন সাড়া না পেয়ে বীজের পুটলিটা দরজার সামনে রেখে গেছে।’

আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় পুটলিটি মা?’

আম্মু আমাকে পুটলিটি দিলেন। আমি চমকে উঠলাম। স্বপ্নে দেখা অবিকল সেই পুটলি। আমি পুটলিটি খুলে দেখলাম স্বপ্নে দেখা হুবহু সেই ফুলের বীজগুলোই আছে। তবে সাথে কোন চিঠি নেই। ভাবলাম দোয়েল পাখি তো আর চিঠি লিখতে পারে না। তাই বোধহয় স্বপ্নের মাধ্যমে তার মনের কথাগুলো বলে গেছে।

আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এগুলো কে দিয়েছে আম্মু?’

আম্মু বললেন, ‘সেটা তো জানি না মা। তবে সম্ভবত তোমার আব্বুর কোন ছাত্র কিংবা কোন অভিভাবক হয়তো এগুলো রেখে গেছে।’

সাত

আমি দ্রুত ছাদে উঠে বীজগুলো টবের মধ্যে লাগিয়ে ফেললাম। ছাদেই আমার ফুলের বাগান। খুব যত্ন সহকারে আমি সেই বাগানটি করেছি। অবশ্য আম্মু আমাকে বাগান তৈরি করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।

প্রতিদিন ভোরবেলা এবং বিকেল বেলা আমি ঘুম থেকে উঠে ছাদবাগানে কিছুটা সময় কাটাই। ফুলের গাছগুলোতে পানি দেই। আগাছা পরিষ্কার করি। গাছগুলোর যত্ন করি। কিছুদিনের ভেতরেই গাছগুলো বড় হয়ে গেল। বসন্তকাল এসে গেল। এখন তো গাছে গাছে ফুল ফোটারই সময়।

আট

সেদিনও আমি ভোরেই ঘুম থেকে উঠলাম। ছাদবাগানে গিয়ে চমকে উঠলাম। চারদিকে শুধু ফুল আর ফুল। হরেক রকম ফুলগুলো ফুটে বাগানকে যেন আলোকিত করে ফেলেছে। আমি এতই মুগ্ধ হলাম যে, ভাবলাম পুরো বাগানের দৃশ্যাবলী আমার আব্বুর মোবাইল ফোনে ভিডিও করে ফেলব।

কিচির মিচির শব্দে আমি আবারো চমকে উঠলাম। দেখি একটি দোয়েল পাখি উড়ে এসে আমার সামনের গোলাপ গাছে বসল। আরো তিন চারটি পাখি একটু দূরে আমগাছটিতে বসে কিচির মিচির করছে। আমি নিশ্চিত হলাম এটিই আমার দোয়েল বন্ধু। সে বোধহয় আমাকে তার ভাষায় কিচির মিচির করে অনেক কথা বলছে। হঠাৎ পাখিটি উড়ে গিয়ে আমগাছটিতে অন্য পাখিদের সাথে বসল। তারপর আবার উড়ে এসে আমার সামনের গোলাপ গাছটিতে বসল। আমি বুঝলাম আমাকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে দোয়েল বন্ধুটি। হয়তো সাথে তার স্বামী এবং ছেলেমেয়েরা আছে। এরা সবাই এক নাগাড়ে কিচির মিচির করেই চলেছে।

আমি ভাবছিলাম পাখিটিকে একটু আদর করবো। কিন্তু হঠাৎ করে আম্মুর গলা শোনা গেল। তিনি আমাকে ডাকতে ডাকতে ছাদে উঠে আসছেন। তাই পাখিটিকে আমার আর আদর করা হল না। কারণ আম্মুর গলার আওয়াজ পেয়েই দোয়েল বন্ধুটি কিচির মিচির করে আরো কিছু কথা বলে উড়ে গিয়ে সেই আমগাছে বসল। তারপর সেখান থেকে সবাইকে নিয়ে উড়ে চলে গেল। আমি তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবতে থাকলাম আবার কবে দেখা হবে আমার প্রিয় দোয়েল বন্ধুটির সাথে?

[সায়েকা আহমদ, ৪র্থ শ্রেণি, বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।]

 

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com