‘নাগার’ ঘ্রাণই যাদু বছরে বিক্রি হচ্ছে ১৫ কোটি টাকার “নাগা”
ইমাদ উদ দীন॥ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এবং কমলগঞ্জ। এই দুই উপজেলায় এখন “নাগা” মরিচের রাজত্ব। ওখানকার পাহাড়ী টিলায় উৎপাদিত মরিচ সাফল্যের হাঁসি ফোঁটাচ্ছে চাষিদের। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক চাষ তাদের সাফল্যের উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ। নানা জাতের লেবু আর মরিচ চাষ হচ্ছে একই সাথে একই বাগানে। একই সাথে এই দু ফসলের চাষে লাভবান হচ্ছেন চাষীরা। এ দু’ উপজেলার উৎপাদিত “নাগা” মরিচের বাৎসরিক বিক্রিয় মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এমন তথ্য সংশ্লিষ্টদের। স্থানীয় ও দেশ বিদেশের ব্যাপক চাহিদার এ মরিচ ঝাল , ঘ্রাণ আর রং এই তিন গুণেই আকৃষ্ট করে ভোজন রসিকদের। সিলেট অঞ্চলের ব্যাপক জনপ্রিয় “নাগা” মরিচের ঘ্রাণ আর সাতকরা কিংবা আদা লেবুর স্বাদে তৃপ্ত এ অঞ্চলের ভোজন রসিক। রন্ধন শিল্পের শৈল্পিকথার অন্যতম এ উপকরণ তিনটিই খাবারে ভাড়ায় রুচি। পরিবেশনে আনে বৈচিত্র্যতা। আর স্বাদে দেয় এক অন্যরকম তৃপ্তি। তাই ঐতিহ্যের এই চলিষ্ণু রেওয়াজ অনুযায়ী সিলেটিদের খাবারের তালিকায় পচন্দের শীর্ষে এই তিন পদই।
পাহাড়ী এ অঞ্চলে নানা জাতের লেবুর মধ্যে সাতকরা আর আদা এ দু’জাতের লেবুই স্থান করে নিয়েছে স্বাদ ও ঘ্রাণের অনন্য গুণে। অনুরুপ এখানকার নানা জাতের মরিচের মধ্যে “নাগা” স্বাদের চাইতে তার যাদুময়ী ঘ্রাণ আর রং বিমোহীত করে ভোজন রসিকদের। নাগা মরিচ শুধু ঝাল মুড়ি, ভর্তা, চাটনি, শাক,সবজি কিংবা শুটকির তরকারীতে নয়। এখন নাগা মরিচের আচারও ব্যাপক জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন। দেশের নামী দামি কোম্পানী গুলোও তৈরী করছে নাগা মরিচের আচার, জেলি ও সস। দিন দিন যেমন বাড়ছে নাগা মরিচের চাহিদা। তেমনি স্থানীয় ভাবে বাড়ছে এর উৎপাদনও।
অল্প খরচে স্বল্প জায়াগায় কম পরিশ্রমে অধিক লাভজন এ ফসল চাষে এখন ঝুঁকছেন স্থানীয় চাষীরা। স্থানীয় চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নাগা মরিচের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেমনি ধীরে ধীরে দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তাই দেশ বিদেশের চাহীদার যোগান দিতে স্থানীয় কৃষকরা এখন ব্যাপক পরিসরে চাষ করছেন ঝালের রাজা “নাগা” মরিচ। জেলার ৭টি উপজেলার পাহাড়ী টিলায় দিন দিন নতুন করে বিস্তৃত হচ্ছে নাগা মরিচের চাষ। সখের বশে বাড়ির আঙ্গিনা আর ক্ষেতের আইলের চাষকৃত নাগা মরিচ এখন পাহাড়ী টিলার বিশাল এলাকা জুড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে। জেলার কুলাউড়া,জুড়ী বড়লখাসহ অনান্য উপজেলাতে কম বেশি নাগা মরিচ চাষ হলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক পরিসরে চাষ হচ্ছে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে। কমলগঞ্জের লাউয়া ছড়া জাতীয় উদ্যানের উত্তর পশ্চিম পাশের (কমলগঞ্জ ইউনিয়নের ৪নং ওর্য়াড এলাকায়) পাহাড়ী এলাকায় ১৫-২০টি লেবু বাগানের সাথে চাষ হচ্ছে নাগা মরিচ।ওখানকার চাষী দেলওয়ার হোসেন, এনামূল হক, মো: নাজমুল হক, হেলেনা আক্তার, দিলারা বেগম ও বালি গাঁয়ের মো: সানুর মিয়াসহ অনেকেই জানালেন লেবু বাগানের সাথে তারা চাষ করছেন নাগা মরিচ।
প্রতিটি বাগানে ১হাজার থেকে শুরু করে ১৫-২০ হাজার গাছও লাগানো হয়েছে। তারা জানালেন লেবু গাছের গোড়া ঠান্ডা রাখতে লেবু গাছের গোড়ার পাশেই রোপন করা হয় নাগা মরিচের গাছ। মরিচ গাছের পাতা ও ডাল, পালা রোদের আলো থেকে রক্ষা করে ঠান্ডা রাখে লেবু গাছ কে। আর লেবু গাছের গোড়ায় দেওয়া সার গোবর থেকে খাদ্য পায় মরিচ গাছ। তাই উভয় ফসলই একে অপরের উপকারী হয়ে ভালো ফলন দেয়। ফলের লেবুর পাশা বাড়তি আয় হচ্ছে নাগা মরিচ দিয়ে। শ্রীমঙ্গলের রাধানগরের কাজী জাহাঙ্গীর, তাহের মিয়া, বিক্রমপাশী জানান তাদের এলাকায় কম বেশি নাগা মরিচের চাষ হলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক পরিসরে শতাধীক লেবু বাগানের সাথে নাগা মরিচের চাষ হচ্চে শ্রীমঙ্গলের রাধানগর,বিষামনি, মহাজিরাবাদ,ডলুবাড়ি ,ইস্পাহানীতে। চাষীরা জানালেন প্রাকৃতিক অবস্থা অনুকূলে থাকলে বছরে প্রতি একর জমিতে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে উৎপাদিত নাগা মরিচ বিক্রি করে সব খরচ শেষে ৮০ থেকে লক্ষাধীক টাকা আয় করা সম্ভব। জেলার মধ্যে নাগা মরিচের সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার শ্রীমঙ্গল।এই বাজারের মজই মার্কেটের নাগা মরিচের আড়তদার মো: তুহিন মিয়া, মো: আইনূল হক, মো: জিতু মিয়া, মো: কদ্দুছ মিয়া জানান লেবু বাজারের পর দুপুর থেকে বিক্রি চলে নাগা মরিচের। হাজার বা বস্তা হিসেবে তারা নাগা মরিচ ক্রয় বিক্রয় করে থাকেন। তারা জানান প্রতিদিন শ্রীমঙ্গল বাজারে ৩-৪ লক্ষ টাকার নাগা মরিচ বিক্রি হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত নাগা মরিচ দেশ বিদেশে ব্যাপক চাহীদা। (পাইকারী) ক্রেতারা তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার নাগা মরিচ দেশে নানা স্থানে পাঠানোসহ ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যেসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করে। তারা জানান বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে নাগা মরিচের। সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায় নাগা মরিচের পরিবার হলো সোলানেসি, জাত-ক্যাপসিকাম এবং প্রজাতি-ক্যাপসিকাম চাইনিজ। নাগা মরিচের ঝাল পৃথিবীর সব মরিচের চেয়ে অনেক বেশি বলে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচ হিসেবে খ্যাত। ঝালের ইউনিট এসএইচইউ। স্কোভিল (ঝাল পরিমাপের মানদন্ড) অনুযায়ী নাগা মরিচের সাধারণ মান ১০ ++++। নাগা মরিচের ঝাল ১ লাখ থেকে ৩ লাখ এসএইচইউ পর্যন্ত। ২০০৭ সালে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বুকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঝাল ও সুগন্ধি মরিচের স্বীকৃত পায় নাগা মরিচ। চাষীরা জানান শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে নাগা মরিচ চাষাবাদ করা যায়। ফসলের প্রাথমিক অবস্থায় অল্পবৃষ্টিপাত এবং ফসলের বাড়ন্তির সময় পরিমিত বৃষ্টিপাত হলে মরিচ খুব ভালো হয়। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি মরিচের জন্য ক্ষতিকর। ছায়ামুক্ত ও বৃষ্টির সময় পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু জমি মরিচ চাষের উপযোগী। চারা লাগানোর দেড় দুই মাস পর থেকেই ফল আসে। একটি পরিপক্ষ নাগা মরিচের গাছ থেকে ৩-৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। চাষীরা জানান নাগা মরিচের গাছে পোকা মাকড় সমস্যা ছাড়াও পাতা কুঁকড়ানো, থ্রিপস পোকা, অতিক্ষুদ্র গাঢ় বাদামি মাকড়সা, জাব পোকা, ফলছিদ্রকারী পোকা অন্যতম। আর রোগের মধ্যে কান্ডপচা, ঢলেপড়া রোগ, মরিচপচা, ডগা শুকিয়ে যাওয়া ও ফল পচা বা অ্যানথ্রাকনোজ তাদের মরিচ গাছ গুলির ক্ষতি করে। তবে তাদের অভিযোগ স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে তাদেরকে নূন্যতম কোন ধরনের সহযোগীতা করা হয় না। বরং কোন সমস্যায় পড়ে তাদের দ্বারস্থ হলে তাদের কে টাকা গুনতে হয়। সাথে বাগানের অনান্য ফসলাদিও তাদেরকে দিতে হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলায় আরো অধিক পরিমাণে ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নাগা মরিচ চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড় টিলা বেষ্টিত এ জেলা নাগা মরিচ চাষের সম্পূর্ণ উপযোগী।
মন্তব্য করুন