“নারীদের অহংকার বৃটিশ বিরোধী, সর্ব ভারতীয় মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী হযরত মহলঃ খাওয়াসিন- থেকে ইফতিখার-উল নিসাঃ কর্ম ও জীবন দর্শন॥
মুজিবুর রহমান মুজিবব॥ “অযোদ্ধা” প্রাচীন ও আধুনিক ভারত বর্ষের ইতিহাসে একটি প্রাচীন, ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধ জনপদ। প্রথমতঃ অযোধ্যার রাজধানী ছিল ফৈজাবাদ। অযোদ্ধার চতুর্থ বিখ্যাত শাসক নবাব আসফ-উদ-দৌলা (১৭৭৫-১৭৯৭) ফৈজাবাদ থেকে রাজধানী “লক্ষেèীতে” স্থানান্তরিত করেন। মুঘল আমলে ঐতিহাসিক অযোদ্ধা ছিল একটি “সুবা” বা প্রদেশ। অযোদ্ধার প্রথম শাসক সাদত আলী খান বুরহানুল মূলক (১৭২০-১৭৩৯) মুঘল সম্রাটদের দুর্বলতা, দুর্বল কেন্দ্রীয় শাসন এবং অবশেষে মুঘল সম্রাজ্যের পতনের পর প্রদেশ সমূহের উপর দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেলে অযোদ্ধার “উজির” পদবীধারী শাসকগণ স্বাধীন শাসকে পরিণত হন। ১৮৫৭ সালের ভারতের “সিপাহী বিদ্রোহ” নামে খ্যাত ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ববর্তী সময় সোয়াশত বৎসরাধিক কাল অযোধ্যা শাসন করেছেন নবাব শাদাত আলী খানের অধঃস্থন এগারোজন বংশধর। অযোধ্যার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্ (১৮৪৭-১৮৫৬)।
ভারতের ইতিহাসে অযোধ্যার নবাবগণ বহুবিধ সঙ্গত কারণে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছেন। অযোধ্যার চতুর্থ শাসক নবাব আসাফ-উদ-দৌলা ছিলেন সঙ্গীত, নৃত্যকলা, শিল্প সংস্কৃতির উদার পৃষ্টপোষক। প্রখ্যাত পরিবেশবিদ, বৃক্ষ ও প্রকৃতি প্রেমি, শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন্দ্র শর্মার মতে ভারতবর্ষে বাগান চর্চার পথিকৃত ছিলেন মধ্য এশিয়ার মুঘলরা। কিন্তু অযোধ্যা ও অযোধ্যার রাজধানী লক্ষেèৗকে উদ্যানের নগরিতে পরিণত করেছিলেন নবাব আসফ-উদ-দৌলা। বিপুল বিত্ত বেসাতের অধিকারী নবাব আসফ-উদ-দৌলা ছিলেন উদার, দানশীল ও প্রবাদ পুরুষের মত। তার দান খয়রাত ও মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর নামে রচিত একটি কবিতায়-
“জিস্কো না-দে মওলা তিসকো দে আস্ফ-উদ-দৌলা।”
ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী অযোধ্যার শেষ স্বাধীন শাসক ছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ (১৮৪৭-৫৬)। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুল শাহ জাফরের মত তিনিও ছিলেন দুর্বল চিত্তের অধিকারী। বিলাসী। সৌখিন। আমুদে। কবি ও শিল্পানুরাগী। তাঁর শাসনামলে শাসন কার্য্য, রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রজাকল্যানের চাইতে বিলাসব্যাসন আমুদ-ফূর্তি, রঙমহলেই সময় কাটাতেন তিনি। তাঁর রঙমহলে বাঈজিদের সংখ্যা ছিল বেসুমার।
নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের দুই বিশ্বস্থ অনুচর “আম্মান” ও “ইমমান” একদিন অযোধ্যার অখ্যাত এক পল্লী গ্রামে এক অচেনা পল্লী বালার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হলেন। দুই রাজ কর্মচারী পল্লীবালার অপরূপ রূপে গুণে বিমুদ্ধ হয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন এমন রূপসী কন্যার স্থান দরিদ্র কিষাণ কিষানীর পর্ণ কুঠির নয়, এমন রূপবতীর স্থান হবে নবাবের রংমহলে। যেই কথা সেই কাজ। রাজ কর্মচারীদ্বয় প্রস্তব দিলেন রূপসী পল্লীবালার পিতা-মাতাকে। শাহী মহলে সম্মানের চাকরী হবে। শান শওকত-মান সম্মানে জীবন কাটাবে দরিদ্র এই পল্লীবালা। দরিদ্র পিতা মাতা লোভ ও রাজ আনুকূল্য প্রাপ্তির প্রত্যাশায় প্রিয় কন্যা সন্তানকে তুলে দিলেন রাজ কর্মচারীদ্বয়ের হাতে। কে জানত নাম পরিচয়, দাগ-খতিয়ানহীন এই পল্লীবালাই একদিন হবেন অযোধ্যার বেগম? হবেন ভারতের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী।
ধূর্ত রাজ কর্মচারীদ্বয় নবাবকে তুষ্ট করে করে অন্যায় লাভ, উপহার-উপটৌকন প্রাপ্তির দুরাশায় এই পল্লীবালাকে নৃত্য-গীতে পারদর্শী করে, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতঃ নবাবের খেদমতে উপস্থাপন করা হলো নামহীনা অপরূপ রূপশী ও গুণবতী এই পল্লীবালাকে । শিল্প সংস্কৃতির সমঝদার, কাব্যানুরাগী নবাব বাহাদুর পল্লী বালার রূপে অতঃপর গুণে বিমুগ্ধ হলেন। বিমোহিত হলেন। নবাব হারেমে স্থান দিলেন। নাম দিলেন “মহকপরী” হিসাবে। সাধারণতঃ শাহী হেরেমে মেয়েদের পরিচিতি থাকে “খাওয়াসিন” পরিচারিকা হিসাবে। নবাবের পছন্দ ও ইচ্ছানুসারে একজন “খাওয়াসিনের” পদোন্নতি হয় “পরি” কিংবা “নর্তকি” হিসাবে। নবাব কাউকে উপ-পতœী হিসাবে গ্রহণ করলে তিনি “বেগম” হিসাবে আখ্যায়িত হন। নবাবের ঔরষে ঐ বেগমের গর্ভে সন্তান এলে তিনি “মহলের” মর্যাদা লাভ করেন। নবাব হারেমের সকল “খাওয়াসিনের” খাস আশা ও আকাঙ্খা থাকে “মহল” হওয়ার। কিন্তু খুব কম সংখ্যক “খাওয়াসিনের” সেই খাস স্বপ্ন সফল হয়। অধিকাংশ সংখ্যা গরিষ্টাংশকেই বিফল হতে হয়। কারণ নবাবের “বেগম” “মহল” বলে কথা।
এই প্রেক্ষিতেই বড়ই সৌভাগ্যবতী অযোধ্যার এই পল্লীবালা “মহকপরি”। “মহক পরির” অপরূপ গুণ, অপূর্ব নৃত্যকলা, অযোধ্যার নবাব কবি ওয়াজেদ আলী শাহ-কে বিমুদ্ধ-বিমোহিত করল। তার স্থান হল নবাবের স্বর্ণহৃদয়ে। নবাবের ঘনিষ্টজন হিসাবে। “মহকপরির” নারী জীবনের সকল স্বপ্ন সফল হল। নবাবের ঔরসে গর্ভসাধরণ করলেন তিনি। “মহকপরি”র গর্ভধারণের সংবাদ শুনে আবেগ ও আনন্দে আপ্লুত হয়ে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ-কে বিমুগ্ধ-বিমোহিত করল। আবেগ ও আনন্দে আপ্লুত হয়ে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ “মহক পরীকে”- মহলের” মর্যাদা দিলেন। খেতাব দিলেন “ইফতিখার-উল-নেসা”। “ইফতেখার-উল-নেসা”- অর্থ নারীদের অহংকার। সত্যিকার অর্থেই ভারতীয় নারীদের অহংকারেই পরিনত হয়েছিলেন অযোধ্যার এই পল্লীবালা। ধূর্ত ইংরেজ কর্তৃক নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে গ্রেফতার ও বন্দীর পরে অযোধ্যা তথা ভারতের সিপাহী বিদ্রোহ তথা ভারতের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন তিনি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন এই বীর নারী। এই মহিয়সী রমনী, গুণবতী কৃষক কন্যা, আত্মসমর্পন করেননি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
গর্ভবতী “ইফতিখার-উল-নেসা” যথাসময়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। নবজাতকের নাম রাখা হল মির্জা বিরজিস কাদার। শিশুটি নবাবের চতুর্থ পুত্র। নবাবের চতুর্থ পুত্রের শুভাগমনে এগারোবার তোপধ্বনি করা হল। অযোধ্যা ব্যাপী নবাবের নির্দেশে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হল। “মহক পরি” “হযরত মহল” নামে খ্যাত হলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য অযোধ্যাবাসীর। রূপে গুণে, কাজে-কর্মে “হযরত মহল” যখন ক্রমশ ক্ষমতা ও প্রাপ্তির শীর্ষ বিন্দুতে আরোহন করেছিলেন তখন অযোধ্যার শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি ক্রমোবনতির দিকে নিমজ্জিত হচ্ছিল। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্ ক্রমশ অলস ও হারেম মুখী হয়ে উঠছিলেন।
রাজ্য এবং শাসন ব্যবস্থায় তার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রন ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। ইতিমধ্যে ভারতীয় রাজন্যবর্গের অনৈক্য ও দুর্বলতা, ভারত ব্যাপী বেনিয়া ও ধূর্ত ইংরেজদের শক্তি বৃদ্ধি, ভারতব্যাপী ইংরেজ শাসন জেকে বসেছে। ক্রমশঃ “বণিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজ দন্ড রূপে”। বিনাযুদ্ধে অযোধ্যার সোয়াশতাধিক বৎসরের নবাবী শাসনের অবসান হল। ১৮৫৬ সালে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ধূর্ত ইংরেজরা নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে অযোধ্যার শাহী তখন থেকে উৎখাত করে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্দি অবস্থায় তাঁকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিল। নবাবের পুত্র মির্জা বিরজিস কাদার, নবাব মহিষী হযরত মহলসহ নবাব পরিবারের সকল সদস্য বৃটিশের তত্ত্বাবধানে রাজধানী লক্ষেèৗতে রইলেন। অনেকটা বন্দীর মত।
অযোধ্যা, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী অযোধ্যায় বৃটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে ও অযোধ্যার বীর জনতার পক্ষ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হলেন বৃটিশ কর্তৃপক্ষ। তাঁরা অযোধ্যার বৃটিশন শাসন বিনা বাধায় মেনে নেননি। অযোধ্যার বীর জনতা, বৃটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় বিক্ষুব্ধ সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সারা ভারত ব্যাপী তখন “সিপাহী বিদ্রোহ”, ভারতের মহান স্বাধীনতা সমর। সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী তখন একটা কথা-প্রবাদ প্রচলিত হয়েছে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ থেকে ১৮৫৭ সালে একশত বৎসর পূর্ণ হয়েছে। ভারতবর্ষে কোম্পানীর শাসন শতবর্ষের বেশী চলতে পারে না। সমগ্র অযোধ্যা জুড়ে তাই তখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ ভারতের দেশ প্রেমিক “বীর সিপাহীরা” বীর বিক্রমে বিজয়ের বেশে এগিয়ে আসছিলেন অযোধ্যার রাজধানী লক্ষেèৗর দিকে। স্যার হেনরি লরেন্স তখন অযোধ্যায় কোম্পানী প্রতিনিধি-চীফ কমিণার হিসাবে কর্মরত। গোমতীর তীরে নবাব আসফ-উদ-দৌলা নির্মিত বিশাল রাজপ্রাসাদেই তখন অবস্থান করছিলেন চীফ কমিশনার লরেন্স। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুভব করে কমিশনার লরেন্স তাঁর অধীনস্থ বৃটিশ বাহিনীকে বিশাল দুর্গবেষ্টিত প্রাসাদ “মচ্ছি” ভবনে জড়ো করেন। ভারতীয় বিদ্রোহী সিপাহীদের ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়ে সংকিত ধূর্ত বৃটিশ মিঃ লরেন্স তাঁর বাহিনীকে নিয়ে লক্ষেèৗ থেকে ৬ মাইল দুরে “চিনহাট” গ্রামে নিয়ে যান। ১৮৫৭ সালের ৩০শে জুন অযোধ্যা বাসীর একটি স্মরণীয় দিন।
ভারতের বীর সিপাহীরা হটিয়ে দিল ইংরেজ বাহিনীকে। কমিশানর স্যার হেনরীর বিপর্যস্ত বৃটিশ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলেন। আ¤্রয় নিলেন রাজপ্রাসাদে। প্রাথমিক বিজয়ে ভারতীয় সিপাহীদের মনোবল অধিকভাবে বৃদ্ধি পেল। ইংরেজদের পক্ষে শেষ রক্ষা হল না। “লক্ষেèৗর” পতন হল। বিজয় হল সিপাহীদের। সমগ্র অযোধ্যা থেকে বৃটিশদের কর্তৃত্ব অবসান হল। বিজয়ী সিপাহীরা অযোধ্যা বিজয়ের পর লাগামহীন উচ্ছাসে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুললেন। বৃটিশ বাহিনী থেকে চাকুরীচ্যুত সিপাহীদের নেতা ও দিক নির্দেশনার প্রয়োজন হল। অযোধ্যার নবাব হতে পারতেন স্বাধীনতা সমরের মহানায়ক। নেতা। কিন্তু তিনি তখন ইংরেজদের হাতে কোলকাতায় বন্দী। নেতৃত্বহীন বিদ্রোহী সিপাহিরা স্মরনাপন্ন হলেন অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের বেগম ও সন্তানদের। কিন্তু নবাবের কোন উত্তরাধিকারী এগিয়ে আসতে সাহস পেলেন না বরং শক্তিশালী ইংরেজদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীতা করলেন অনেকেই।
অযোধ্যার এই মহাসংকটকালে বিদ্রোহী সিপাহীগণ নিরুপায় হয়ে সেদিনের “মহক পরি”- “হযরত মহলের”- কাছে গেলেন। “মহক পরি” “হযরত মহল” অযোধ্যার রাজ পরিবারের সদস্য নহেন। নবাব পরিবারে তাঁর জন্ম হয়নি। সম্প্রতি এক নবাব জাদার জননী হয়েছেন তিনি। অযোধ্যার এক অখ্যাত পল্লীগ্রামে হযরত মহলের জন্ম। পিতা-মাতা, বিত্ত-বেসাত, নাম-ডাক কিছুই নেই। অযোধ্যার এই দুঃসময়ে অযোধ্যার স্বাধীনতা রক্ষার মহাসমরে এগিয়ে এলন, দায়িত্বভার ও নেতৃত্ব নিলেন অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের বেগম, পল্লীবালা “হযরত মহল”। অযোধ্যার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম বলেই হয়ত অযোধ্যার কঠিন সময়ে এগিয়ে এলেন তিনি। হযরত মহল বিদ্রোহী সিপাহীদের স্বাধীনতা সমরকে সমর্থন করে তাঁর দশ বছর বয়সি বালক বিরজিস কাদার-কে অযোধ্যার নবাব যোষণা করে তিনি তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। “হযরত মহল”- হারেম থেকে বেরিয়ে এসে অযোধ্যার সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। হযরত মহলকে নবাব হেরেমে আনয়ন করা হয়েছিল নবাবের মনোরঞ্জনের জন্য। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের অনুপস্থিতিতে নবাব পরিবারের বিভিন্ন পদ-পদবী ধারী অভিজাত শ্রেণী যখন গোলামির শৃঙ্খল পরে ইংরেজদেরকে স্বাগত জানাতে মুসাহেবি-দালালি করার ফন্দি-ফিকির আটছিলেন তখন নবাবের এক সামান্য গুণবতী নর্তকি অযোধ্যা ও নবাবের মান-সম্মান রক্ষায় এগিয়ে এলেন। অযোধ্যার মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী বেগম হযরত মহলের গুনাবলীর প্রশংসা করেছেন খোদ ইংরেজ সাংবাদিক উইলিয়াম হাওয়ার্ট রাশেল। তিনি লন্ডনের “দি টাইমস” এর যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদদাতা হিসাবে ১৮৫৭ সালে ভারত সফর করেন। মিঃ রাসেল এর মতে “এই বেগম তার শক্তি ও সমর্থের প্রদর্শন ঘটিয়েছেন। বেগম আমাদের বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধের ঘোষনা দিয়েছেন।”
বৃটিশ সাংবাদিক মিঃ রাসেলের এই মন্তব্যে স্বাধীনতা সংগ্রামী হযরত মহলের ঐতিহাসিক উত্থান ও কর্ম তৎপরতা প্রসঙ্গে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা পাওয়া যায়। অযোধ্যার বেগম হযরত মহল বিদ্রোহী সিপাহীদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রদান করতঃ একটি সরকার গঠন করেন। তিনিই ছিলেন মূলতঃ সরকার প্রধান। তাঁর নেতৃত্বে সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি “যুক্তফ্রন্ট” গঠিত হয়। বৃটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য বেগম হযরত মহল নবাব বিরজিস কাদারের নামে বিভিন্ন ঘোষনা জারী করে দিলেন। বেগম হযরত মহল ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং সিপাহীযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন করতে অযোধ্যার পল্লীর বিভিন্ন প্রান্তরে সফর করেন। হযরত মহলের এই ব্যতিক্রমি সফর ও জনসংযোগ জনগনের মধ্যে বিপুল বাড়া জাগিয়েছিল। তিনি “নানা সাহেব” সহ তৎকালীন অনেক অভিজাত শ্রেণীর সংেেগ যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাঁর আহ্বানে এসব সম্মানিত জমিদার-তালুকদার শ্রেণী সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা সমরে সহায়তা করেন। হযরত মহল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও সমর বিদ্যায় পারদর্শিনী ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়। হযরত মহল ১৮৫৮ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারী হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্বয়ং সরজমিনে পরিদর্শন করতেন। হযরত মহল রাজধানী লক্ষেèৗকে সম্ভাব্য বৃটিশ হামলার মোকাবিলা করতে সামন্ত যুগের প্রথানুযায়ী লক্ষেèৗর চারদিকে প্রাচীর নির্মানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতঃ পাঁচ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেন। প্রায় ১ বৎসর ব্যাপী স্বাধীনভাবে পুত্র নবাব বিরজিস কাদারের নামে অযোধ্যা শাসন করেন বেগম হযরত মহল। অযোধ্যার এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধিতে শংকিত হয়ে উঠে কোম্পানী কর্তৃপক্ষ। ইংরেজ বাহিনী শক্তি সঞ্চয় করে লক্ষেèৗ আক্রমন করে। হযরত মহল ইংরজদের কাছে আত্মসমর্পন না করে অধিকতর শক্তি সঞ্চয়ের জন্য গৌরবজক পশ্চাদপরন করেন। খাগড়ানদী পাড়ি দিয়ে তিনি বাহরাইচ জেলার “বাউন্দি” দুর্গে আশ্রয় গ্রহন করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হযরত মহলকে বৃটিশরা এক নম্বর শত্রু ঘোষণা করে তাকে নির্মুল করার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। হযরত মহল বাউন্দি দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করতঃ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। এসময় তার অধীনে ষোল হাজার সৈন্যের এক বাহিনী ছিল বলে জানা যায়। বাউন্দি দূর্গে কামান বসিয়ে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় ও মজবুত করেন তিনি।
১৮৫৮ সাল জুড়ে হযরত মহল তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখেন। সমগ্র সিপাহী বিদ্রোহ কোম্পানী বাহিনীকে সবচাইতে বেশী বেগ পেতে হয়েছে হযরত মহলকে পরাজিত করতে। ভারতের বীর নারী মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী হযরত মহলের শৌর্য্য, শক্তি, সাহস ও বীরত্ব গাঁথার কাহিনী অবশেষে ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়ার দরবারে পর্যন্ত পৌঁছায়। মহারানী ভিক্টোরিয়া তাকে ক্ষমা প্রদর্শন ও পেনশন মঞ্জুেেরর প্রস্তাব পাঠালে ভারতনেত্রী হযরত মহল ঘৃণাভারে সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে অযোধ্যার বালক নবাব বিরজিস কাদারের পক্ষে ঘ্ষোণা করেন “আমরা জনগনের সরকার”। অযোধ্যাবাসির অভিভাবক হিসাবে ঘোষনা করিতেছি যে, যেহেতু আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার আমাদের প্রজারাই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত হল।”
কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, অযোধ্যার স্বাধীনতা সংগ্রামী হযরত মহলের। ইংরেজরা অধিকতর শক্তি সঞ্চয় করে কতেক দেশীয় বেঈমানের সহযোগিতায় বাউন্দি দূর্গ আক্রমন করল। দুর্গের পতন হল। কোম্পানীর বিজয় হল। কিন্তু আত্মসমর্পন করেন নি বেগম হযরত মহল। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন অবস্থাতেই ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পন করবেন না, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন। ১৮৫৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কিছু বিশ্বস্থ সৈন্য নিয়ে অধিক সৈন্য সংগ্রহের আশায় হযরত মহল বাউন্দি দুর্গ ত্যাগ করে হিমালয়ের গভীর জংগলে প্রবেশ করেন। এর বৎসর খানেক পরে তিনি ১৮৫৯ সালের শেষভাবে নেপালে প্রবেশ করেন। কোম্পানীর প্রতিবাদ সত্বেও নেপালের রাজা হযরত মহলকে নেপালে আশ্রয় দেন। ১৮৭৪ সালের দিকে ঐহিত্যবাহী অযোধ্যার স্বাধীনতা সংগ্রামের আপোষহীন মহানায়িকা, পল্লীবালা, বেগম হযরত মহল এই মায়াময় পৃথিবী থেকে চীর বিদায় নেন। মৃত্যুকালে তাঁর পাশে তার প্রিয় পুত্র নবাব বিরাজস কাদার ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অসীম সাহসী মহিয়সী রমনীর কর্ম ও বর্ণাঢ্য জীবনের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। তেমন বইপুস্তক, তথ্যও নেই। উইলিয়াম ডেলরী স্পেল রচিত “দি লাষ্ট মুঘল, স” এবং জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু রচিত “সিপাহী বিদ্রোহের ভুলে যাওয়া কাহিনী এবং একটি ঐতিহাসিক অবিচার” গ্রন্থে কিঞ্চিত তথ্য পাওয়া যায় মাত্র।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ ছিল না। প্রকৃত পক্ষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহই ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ইং আগষ্ট পর্যন্ত পৌনে দুইশ বৎসর ব্যাপী অসভ্য, ধূর্ত ইংরেজরা এই উপমহাদেশে সীমাহীন লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষন করেছে।
৪৭ থেকে একাত্তোর সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী ঔপনিবেশীক শাসনামলে ইসলাম ও সংহতির নামে হয়েছে অনৈসলামিক মানবতা বিরোধী কাজ।
একাত্তোরের মহান মুক্তি সংগ্রাম আমাদের জাতীয় জীবনের সমকালিন ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্থানী বাহিনী সমকালীন সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসের জঘন্যতম কাজ খুন ধর্ষন অগ্নিসংযোগ লুটতরাজ করেছে।
লাখো শহীদের অমূল্য জীবন ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই প্রিয়তম স্বাধীনতা। বিজয়ের এই বার্ষিকীতে সকল শহীদানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।
অযোধ্যার মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী, এক মহকপরি, পল্লীবালা, হযরত মহলের কবর কোথায় আমাদের জানা নেই। তাঁর কবরে কেউ পুষ্পস্তবক দেয় কিনা, রুহের মাগফেরাত কামনা করেন কি না, কেউ কবর জিয়ারত করেন কি না তাও আমাদের জানা নেই। একালের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে, সেকালের স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তাঁর বেহেশ্ত নসীব করুন, এই মোনাজাত করছি।
[মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।]
মন্তব্য করুন