নিরাপদ সড়ক এবং আমাদের করণীয়

July 25, 2018,

মোহাম্মদ আবু তাহের॥ বছরের আগস্ট মাসে বি আর টি এর বরাত দিয়ে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে ঢাকায় ৫৪ হাজার ৭৮৮টি মোটরযান নিবন্ধ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৯ হাজার ২৩৬টি প্রাইভেট কার, ১ হাজার ৯৯৪ টি জীপ। ২ হাজার ১৮৬ টি মাইক্রোবাস ও ২৬ হাজার ৮৯৩ টি মোটর সাইকেল। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন ঢাকায় এমন অনিয়ন্ত্রিতভাবে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেলে অচিরেই এই মহানগরের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। সড়ক মহাসড়ক নিরাপদ করতে হলে অনাকাংখিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রত্যেক জেলায়ও অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন এর বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে, ট্রাফিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে হলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও বেশী আধুনিকায়ন করতে হবে। আমাদের দেশের বিশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতিই হলো যানযট। যানবাহনের চালক কখনো একহাতে সিগারেট এবং অন্যহাতে স্টিয়ারিং এ অবস্থায় গাড়ী চালান যার পরিণতি মারাত্মক দুর্ঘটনা। ২০১১ সালের ১১ জুলাই এ ধরণের একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের মিরেরশরাইয়ে ৪৮ জন কিশোর শিক্ষার্থীর মৃত্যু ট্রাজেডি দেশবাসী ভুলে যায়নি। ঐ যানবাহনের চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। এক হাতে ছিল সিগারেট এবং অন্য হাতে ছিল মোবাইল ফোন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সামনের দিক থেকে আসা যানবাহনের চালকও ছিলেন মোবাইল ফোনে আলাপরত। এ ধরণের দুর্ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। কমবেশী এমন শোকাবহ ঘটনা প্রায়ই দেশবাসীকে কাঁদায়। বেশীরভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে চালকের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে। ৭ জুলাই ২০১৮ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মৌলভীবাজার এর শেরপুরের কাছাকাছি সরকার বাজারের নাদামপুর নামক স্থানে সিএনজি ও প্রাইভেট কারের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের চারজন ও উভয় গাড়ীর চালকসহ মোট ছয়জন মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। চালকের অবহেলার কারণে আরও অনেক দুর্ঘটনাই ঘটে থাকে। এজন্য চালকদের সচেতনতা যেমন প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ আরও বেশী প্রয়োজন। পৃথিবীর সকল উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশে আইন বা নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য জেল জরিমানার বিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। এজন্য উন্নত দেশে চালকের অবহেলার কারণে যানবাহন দুর্ঘটনা খুবই কম পরিলক্ষিত হয়। আমাদের দেশে যত যানবাহন দুর্ঘটনা ঘটে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ী এবং আইন না মানা। অনেক ক্ষেত্রে ফিটনেসবিহীন গাড়ীকে সড়কে চলাচল উপযুক্ত বলে যারা ফিটনেস সার্টিফিকেট দিচ্ছেন তারাও জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে যানবাহন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় চালকের একটি মোবাইল ফোন সঙ্গে থাকা ও গাড়ী চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু মোবাইল এর অপব্যবহার রোধ করতেই হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে গাড়ী চালানো অবস্থায় কোন চালক মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। বৃটেনে কোন চালককে গাড়ী চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখিনি কেননা সেখানে আইন অমান্য করলে অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়। যুক্তরাজ্যের রাস্তায় চলার সময় দেখেছি একজন চালক ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার সাথে সাথেই পুলিশ ঐ দোষী চালকের কাছে এসে পড়েছে এবং জরিমানার কুপন ধরিয়ে দিচ্ছে। কোন তদবির নেই, ডান হাত বাম হাতের কারবার নেই। চালক বা গাড়ীর আরোহীরা বুঝতেই পারেনি কোথায় ঐ হাইওয়ে পুলিশ অবস্থান করছিল। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিষয়ে আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ সবসময় হয় না। যেমন গাড়ী চালানো অবস্থ্য়া মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ। কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ সব সময় হয় না। আমাদের দেশে অহরহ যে দুর্ঘটনা ঘটে এর মূল কারণ হলো দুর্বল আইন এবং আইনের প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। শাস্তির ভয় না থাকার কারণে অনেক চালক বেপরোয়া গাড়ী চালান। তারা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে প্যানেল কোডের ৩০৪(খ) ধারায় মামলা হচ্ছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছর। শাস্তি কম হওয়ায় দুর্ঘটনার ব্যাপারে চালকরা তেমন সতর্ক থাকেন না। পাশাপাশি তাদের মধ্যে কোন ধরণের ভীতিও কাজ করে না। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলনকারীরা সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তির শাস্তি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন ও সর্বনিম্ন ৫ থেকে ৭ বছরের জেল এবং জামিন অযোগ্য ধারার বিধান রেখে আইন করার দাবী জানিয়ে আসছেন। জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে আন্দোলন হচ্ছে। ২৪ জুলাই ২০১৮ ‘মৌলভীবাজারের উন্নয়নে আমরা’ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘নিরাপদ সড়ক ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে মৌলভীবাজার-৩ সংসদীয় আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসিন, মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল ড. ফজলুল আলী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, পুলিশ অফিসার সহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
যানবাহন দুর্ঘটনা কমাতে হলে চালকের অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইনের সংশোধন ও যথাযথ প্রয়োগের দাবী জানাচ্ছি। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নিম্নোক্ত সুপারিশ করছি-
১. চালকের অবহেলা বা চালকের দোষের কারনে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু হলে তাকে হত্যা হিসেবে গণ্য করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে আইনের সংশোধন করা প্রয়োজন।
২. গাড়ী চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক জরিমানা প্রয়োগ করার ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
৩. গাড়ী চালকরা যাতে বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালাতে না পারে সে জন্য কঠোর বিধি বিধান চালু করতে হবে এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. গাড়ী চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এস.এস.সি পাশ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
৫. গাড়ী চালকদের বয়সসীমা ২০ থেকে ৫৯ বছর নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৬. ফিটনেস বিহীন গাড়ী যাতে রাস্তায় চলাচল করতে না পারে সে জন্য কঠোর মনিটরিং করতে হবে।
৭. যানবাহনের গতির তারতম্য নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ Over Taking  I  Over Loading ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৮. সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে চালকদের দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষিত
চালকরাই কেবলমাত্র পেশাদার ড্রাইভার হিসেবে বিশেষ করে যাত্রীবাহী ও ভারী যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স
পেতে পারেন।
৯. চালক গাড়ী চালানোর সময় ধূমপান করতে পারবে না। ধূমপান করলে কমপক্ষে ১০০০/- টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা যেতে পারে।
১০. মহাসড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত যানবাহন (যেমন-সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন ইত্যাদি) চলাচল বন্ধ করতে হবে।
১১. সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক সহ গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক চারলেন করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় চীনের সঙ্গে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ মহাসড়ক শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রে নয় এর মাধ্যমে শিল্পায়নে পিছিয়ে পড়া সিলেটে ঘটতে পারে শিল্প বিপ্লব। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে মহাসড়কটি অর্থনৈতিক কড়িডোরের ভূমিকাও পালন করতে পারে। সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক চারলেনের দাবি সিলেটের মানুষের দীর্ঘদিনের। চারলেনের এই মহাপ্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কমে আসবে ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যাতায়াতের সময়। এতে একদিকে যেমন বাড়বে বৃহত্তর সিলেটের পর্যটকের সংখ্যা, অন্যদিকে বিকাশ ঘটবে পর্যটন শিল্পের। মহাসড়কটি চারলেনে উন্নীত হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও মহাসড়কটিকে অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। চারলেন হলে আমাদের মৌলভীবাজার ও সিলেটের এবং অন্যান্য জেলার প্রবাসীরাও বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। এতে শিল্পায়নে পিছিয়ে পড়া বৃহত্তর সিলেট অনেক এগিয়ে যাবে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। শেষ করার আগে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের ও সুকান্তের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করব- “বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ দেখিতে চাহিনা আর।”
“সাবাস বাংলাদেশ, বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
লেখক ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com