নিসর্গবিদ-বৃক্ষমানব দ্বিজেন শর্ম্মার মহাপ্রয়ানঃ একে একে নিভিছে দেউটি
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ প্রকৃতি প্রেমি ও নিসর্গবিদ- বৃক্ষমানব দ্বিজেন শর্ম্মাও অবশেষে চলে গেলেন – না ফেরার দেশে। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় পরিনত বয়সেই মৃত্যোবরন করেন বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী- মানব প্রেমিক দ্বিজেন শর্ম্মা। শ্যামলা-মায়াবী চেহারার দ্বিজেন শর্ম্মার আসি পেরিয়েও তাঁর মুখে ছিল মায়াবী মিষ্টি হাসি, যেনো হাতেও ছিল মোহন বাঁশি। বার্ধক্য জনিত ব্যাধিতে ভূগলেও বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি। পেশাগত জীবন থেকে অবসর গ্রহন করলেও বৈচিত্রময় কর্ম্মজীবন থেকে অবসর নেন নি কর্ম্মবীর দ্বিজেন শর্ম্মা। পেশাগত জীবনে ছিলেন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ-বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের গৌরবময় অধ্যায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নটরডেম কলেজে শিক্ষাগতা। স্বাধীনতা উত্তর কালে প্রগতি প্রকাশনী -মস্কোতে- অনুবাদকের চাকরি নিয়ে সপরিবারে মস্কো পাড়ি জমান অধ্যাপক দ্বিজেন শর্ম্মা। দীর্ঘ দেড় যুগ সুনাম সুখ্যাতি ও সগৌরবে মস্কোতে অনুবাদক এর চাকরী কালে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উপর রচিত অনেক মূল্যবান গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি। দেশে-বিদেশে কাজে-কর্ম্মে-জ্ঞানার্জনে-পঠন পাঠন ও গবেষনায় জ্ঞান তাপস দ্বিজেন শর্ম্মার মূল্যবান জীবন থেকে বহু বর্নীল বসন্ত বিদায় নেয়। সুকন্যা ডা. দেবী শর্ম্মা স্বামী দ্বিজেন শর্ম্মার মানব জীবনকে আলোকিত-মহিমান্বিত করেছেন। দ্বিজেন-দেবীর- সুখময়-প্রেমময় দাম্পত্য জীবনের ফল ও ফসল মহান ¯্রষ্টার দান দুই কৃতি সন্তান পুত্র ডা. সুমিত শর্ম্মা, কন্যা শ্রীমতি শ্রেয়সী শর্ম্মা। দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত। কর্ম্ম জীবনে সু-প্রতিষ্টিত। ইতি মধ্যে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। দ্বিজেন শর্ম্মা পরিনত বয়সে জীবন সায়াহ্নে। পরিনত বয়সে তিনি প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, তরুলতা জাতীয় বৃক্ষ ও প্রকৃতি বিষয়ক সংস্থার উদ্যোগে সহযোগিতা ও সহায়তায় পরিবেশ রক্ষা ও বৃক্ষ পরিচর্য্যা ও লালনে কালাতিপাত করছিলেন বৃক্ষ মানব দ্বিজেন শর্ম্মা। বৃক্ষ পরিচর্য্যা করেতেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্ম্মা জানতেন বৃক্ষ রাজি শুধু প্রকৃতিতে ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স-ভারসাম্যই রক্ষা করে না, বৃক্ষ রাজি মানুষের জীবন ধারনের জন্য অক্সিজেন বিতরন করে। ঢাকায়-বড়লেখায়-বাংলাদেশে দ্বিজেন শর্ম্মা রুপিত মূল্যবান বৃক্ষরাজি অনাদি-অনন্ত কালে মানব জাতির জীবন ধারনের জন্য অক্সিজেন বিতরন করবে। দেশ ও জাতি চীরকাল বৃক্ষ সখা দ্বিজেন শর্ম্মাকে স্মরন করবেন শ্রদ্ধায়। ভালোবাসায়। সুগভীর আন্তরিকতায়।
বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্ম্মার মৃত্যো আকস্মিক ও অকাল মৃত্যো না হলেও পরিনত বয়সে তাঁর মৃত্যো হলেও তার মৃত্যোতে রাজধানী-ঢাকায় তাঁর জন্মভূমি বড়লেখায় শোকের ছায়া নেমে আসে। দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমী ও একুশে পদক প্রাপ্ত জাতীয় এই বীরকে শ্রদ্ধাও সম্মান জানানো হয়। সসম্মানে শোকাবহ পরিবেশে তাঁর শেষ কৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছামত তাঁর দেহাবশেষ জন্ম ও পিতৃভূমি বড়লেখায় তারই রোপিত নাগ লিঙ্গঁম বৃক্ষের নিচে সমাহিত করা হয়। প্রকৃতিও মানব প্রেমিক দ্বিজেন শর্ম্মার কর্ম্ম জীবনের উজ্জল স্মৃতির প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, তাঁর বিদেহী আত্বার শান্তি ও সদগতি কামনা করছি। তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করছি।
সদ্য প্রয়াত স্বর্গীয় দ্বিজেন শর্ম্মার জন্ম মৌলভীবাজার জেলাধীন ঐতিহ্যবাহী বড়লেখা উপজেলায়। হাওর-বাওর-দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, পাহাড়-পর্বত-টিলার সমাহারে অপরূপ নিসর্গ মন্ডিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপরূপ লীলাভূমি ঐতিহ্যবাহী বড়লেখা এলাকা। বালক দ্বিজেন শর্ম্মার পিতা ছিলেন এলাকার বিশিষ্ট কবিরাজ। কবিরাজির কারনে তার গাছ-গাছালি-লতা পাতার প্রয়োজন হত। পেশাগত কারন ও প্রয়োজনে কবিরাজ বাড়ীর আঙ্গিঁনায় বিচিত্র বৃক্ষ রাজি-ঔষধি বৃক্ষ থাকত। এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান এবং পিতার পেশাগত প্রয়োজনে বাল্যকালেই বালক দ্বিজেন শর্ম্মা বৃক্ষ রাজির প্রেমে পড়েন। বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গেঁ তার বৃক্ষ প্রেম বাড়তে থাকে। মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়েই অধ্যায়ন করেন। কৃতিত্বের সাথে গ্রহন করেন মাষ্টার্স ডিগ্রী। কর্ম্ম জীবনও শুরু করেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে। নিজের গোটা মানব জীবনকে উৎসর্গ করেন একজন নিবেদিত প্রাণ প্রেম-প্রকৃতি-মানবও বৃক্ষ প্রেমিক হিসাবে হয়ে উঠেন একজন দ্বিজেন শর্ম্মা।
ষাটের দশক থেকে সাংবাদিকতা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও রাজনীতির সঙ্গেঁ কিঞ্চিত সম্পৃক্ত ছিলাম। আশির দশকের পর থেকে প্রেম-প্রকৃতি বৃক্ষ পরিচর্যা এবং পুস্তক রচনা, প্রকাশে প্রনয়নে জড়িত হই। এতদসংক্রান্ত কারনে মানব বৃক্ষ দ্বিজেন শর্ম্মার ভক্ত অনুরক্ত হয়ে যাই। তিনি লেখক হিসাবে বিজ্ঞান-বৃক্ষ-প্রকৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে একটি চমৎকার সমন্বয় ঘটান। দ্বিজেন শর্ম্মার কলাম, শ্যামলি নিসর্গ, কুরচি তোমার লাগি, বৃক্ষ বিষয়ক গ্রন্থ রাজি আমাকে দারুন ভাবে আলোড়িত করে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্ম্মাকে দূরে থেকে, কাছ থেকে জেনেছি, দেখেছি তিনি একজন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। মানব প্রেমিক মহৎ মানুষ। তাকে দেখার- কাছে থেকে কথা বলার বাসনা পূষন করছিলাম। সেইচ্ছা একদিন পূর্ন হল- আমাকে যেতে হয়নি, তিনিই দয়া করে আমাকে দেখতে এলেন। আমাদের জেলা বারে। দিন তারিখ মনে নেই একদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই খ্যাতিমান লেখক-গবেষক প্রিয়ভাজন প্রফেসর নৃপেন্দ্র লাল দাস এবং অধ্যাপক আব্দুল খালিক তাকে নিয়ে এলেন। তখন আমার কাধ অব্দি ঝাকড়া বাবরি চুল এবং আকর্ষনীয় গোঁফ। -তোমাকে দেখতে এলাম হে ছোকড়া, বলে স¯েœহে জড়িয়ে ধরলেন। তোমার অনেক নাম ডাক শুনলাম। লেখাও পড়লাম তাই তোমাকে দেখতে এলাম-। আমি আনন্দে আবেগে তাঁকে স্বাগত জানালাম। সশ্রব্ধ চিত্তে পা-ছুঁয়ে সালাম করলাম। আমার কলিগদের সঙ্গেঁ পরিচয় করিয়ে দিলাম। ফেঞ্চ ফ্রাই ও কফি দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করলাম। খাবারের উন্নতমানে, এই মফস্বলে আজকাল কফি ও খাও নাকি- বলে তাজ্জব হলেন। আমি গর্ব ও গৌরবে উচ্চারন করলাম-আমাদের এলাকায় গ্রাম্য বাজার গুলিতেও আজকাল কফি পাওয়া যায়-খাওয়া হয়। একদা মস্কো প্রবাসী দ্বিজেন শর্ম্মা মফস্বলি কফির মান দৃষ্টে খুবই খুশী হলেন। তাঁর মুখাবয়বে একটি শিশু সূলভ সাবল্য এবং তৃপ্তির ভাব পরিলক্ষিত হল।
মানুষ দ্বিজেন শর্ম্মার সঙ্গেঁ সেই থেকে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগ। আমার কফি পার্টি (যা আমাদের জেলাবার এবং আমার চেম্বারে প্রায়ই হয়) এবং তাৎক্ষনিক সম্ভর্ধনা ও সম্মান প্রদানের কথা জেলা বাসি যে কাউকে দেখা হলেই বলতেন। অতঃপর তাকে পেয়েছি বার বার। একুশের বইমেলায় নজরুল মঞ্চে আমার গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে তাঁকে পেয়েছি। ঢাকাস্থ মৌলভীবাজার সমিতির বার্ষিক সভানুষ্টানে সমিতির আজীবন সদস্য হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছি-তাঁকে সম্মানিত অতিথি হিসাবে পেয়েছি।
অধ্যাপক দ্বিজেন শর্ম্মার একুশে পদক প্রাপ্তির পর জেলাবাসির অনেকেই তাকে সম্ভর্ধনা দিতে চাইলেন। একুশে টিভির জেলা প্রতিনিধি ¯েœহ ভাজন বিকুল চক্র বর্ত্তী আমাকে চেপে ধরলেন- তাঁর কাছে নিয়ে যেতে হবে। এ প্রজন্মের সঙ্গেঁ তাঁর পরিচয় ও সম্পর্কের প্রয়োজন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ গবেষক ভ্রাতৃপ্রতিম দীপংকর মোহান্তের কাছ থেকে তাঁর বাসার ল-কেশন নিয়ে আরেকজন প্রকৃতি ও পক্ষিপ্রেমি আমার আত্বীয় মাষ্টার গোলাম মোস্তফা রাজা সহ তাঁর খন্দকার গলির বাসায় গেলাম। তিনি খুবই খুশী হলেন। শারিরীক কারনে এখানে এসে সম্ভর্ধনা নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। সেদিনের সেই স্মরনীয় সন্ধ্যাটি আমার জীবনের অন্যতম স্মরনীয় সন্ধ্যা। বুড়া-বুড়ি- আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করলেন। ফটো সেশনও হল। প্রিয় বিকুল চক্রবর্ত্তী তাঁর একটি সাক্ষাতকার ও নিলেন। সেটিই ছিল তার সঙ্গেঁ আমার শেষ সাক্ষাত। এখন তিনি পরলোকে- হয়তো হারিয়ে যাবেন স্মৃতির গভীরে, কিন্তু তাঁর কাজ বেঁচে থাকবে অনাদি-অনন্ত কাল। পূনঃ প্রয়াত দ্বিজেন শর্ম্মার বিদেহী আত্বার শান্তি ও সদগতি কামনা করছি।
[দ্বিজেন শর্ম্মার ¯েœহভাজন। সিনিওর এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। কলামিষ্ট। মুক্তিযোদ্ধা ]
মন্তব্য করুন