পরিবেশ-প্রকৃতি ও পক্ষি প্রেমি গোলাম মোস্তফা-রাজাঃ রাজকীয় প্রস্থানঃ স্মরন
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ মানুষের জন্ম ও মৃত্যোর মধ্যবর্ত্তী-অন্তর্বর্তীকালীন সময় এর নাম জীবন। সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব-আশরাফুল মকলুখাত-নররুপী নারায়ন-এই মানুষের জীবন খুবই ক্ষনস্থায়ী। অ-নির্ধারিত। রিটার্ন টিকেট হাতে নিয়ে এই ধুলির ধরায় মানবের শুভাগমন। সময় শেষে মহান মৃত্যোকে আলিঙ্গঁন করতেই হবে। কারন পবিত্র আল কোরআনে মহান আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন- কুল্লীন নাফসীন-জ্যায়িকাতুল মউত-”। বাংলার কবিও বলেন সহায় সম্পদ যশ-আয়ূযন কালের বশ- পদ্মপত্রে নীড়”। সর্ব কালের সেরা কবি ও দার্শনিক শেখ সাদি ও বলেন- জিন্দেগী,এ্যহিত হ্যায় এক মুসাফির খানা, যানেহগা জরুর, কোয়ী আগে, কোয়ী পিছে”।
মৃত্যো চীরন্তন ও শাস্বত সত্য হলেও একজন মানব সন্তানের মৃত্যো- এই মায়াময় রঙ্গীঁন পৃথিবী থেকে চীর বিদায় মূর্দার স্বজন সহজে মেনে নিতে পারেন না, আকুল কান্নায় ব্যাকুল হন। আক্ষেপ-আহাজারি করেন। আত্বীয় স্বজনকে কঠিন দূঃসংবাদটি দেন-জানাজার নামাজ দাফন কাফনের আয়োজন করেন।
নিউক্লিয়াসের-জনক, রাষ্ট্রচিন্তক, তাত্বিক সিরাজুল আলম খান এর প্রশাসনিক সংস্কার মূলক চৌদ্দদফা- কর্ম্মসূচীর প্রসার-প্রচারে গঠিত চৌদ্দদফা চেতনা পরিষদ এর মুখপাত্র জাসদ নেতা এম.এ রহিম এই কঠিন ও দূঃসংবাদটি প্রথম আমাকে জানালেন-গোলাম মোস্তফা রাজা মিয়া আর নেই। হার্ট এ্যটাকে তিনি মারা গেছেন। মতিগঞ্জ রাজা ফিসারি ও হেচারিতে বাদ এশা তার নামাজে জানাজা।
মৃত্যো সংবাদ বরাবরই বেদনাদায়ক। দূঃসংবাদটি শুনে মনে খুবই কষ্ট পেলাম। ইন্না লিল্লাহি- পড়লাম। তাঁর রুহের তাৎক্ষনিক মাগফিরাত কামনা করলাম। বয়সে আমার সম সাময়ীক কিংবা কিঞ্চিত কনিষ্ট হলেও আত্বীয় ও সদালাপি হিসাবে তাঁর সঙ্গেঁ আমার খুবই সুসম্পর্ক ছিল। সম্পর্কে তিনি আমার মামা হলেও উল্টো আমাকে মায়া করে মামু- বলে ডাকতেন। তাঁর শ্রীমঙ্গলস্থ বাসা, অফিস, ফিসারিতে যাওয়া-খাওয়া ও দেখার জন্য তিনি অনেক দিন আন্তরিক ভাবেই আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু যাই যাই করে আর যাওয়া হয়নি, যখন গেলাম তখন তিনি লাশ। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, জাসদ নেতা এম.এ রহিম মরহুমের কনিষ্ট ভ্রাতা। আমি প্যারামাউন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রবীন মুক্তিযোদ্ধা এস.টি.পি করিমের সঙ্গেঁ যোগাযোগ করি। আমার এই প্রবীন বন্ধুও সদ্য প্রয়াত গোলাম মোস্তফা রাজার সঙ্গেঁ সুপরিচিত ও সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। আমার ফোন পেয়ে এস.টি.পি করিম সাহেব দ্রুতই আমার বাসায় চলে এলেন। কাল বিলম্ব না করে আমরা দ্রুত গতিতে শ্রীমঙ্গল থানাধীন মোতিগঞ্জ রওয়ানা হই। গাড়ীর চালক-গাড়ীর মালিক এস.টি করিম নিজেই। করিম সাহেব চালকের আসনে থাকলে ইনশাল্লা ভ্রমন নিরাপদ। চালক হিসাবে তিনি খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞ। স্বাধীনতা পূর্ব কাল থেকেই গাড়ী হাকাচ্ছেন তিনি। শ্রীমঙ্গল শহরে এসে ডানদিকে মোড় দিয়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে আমরা ঢাকামুখী হয়ে রওয়ানা হলাম। কয়েক কিলোমিটার পেরুতেই রাস্তার উপর উত্তর পাশের্^ বিশাল সাইনবোর্ড-রাজা ফিশারী ও হ্যেচারি। শাশা করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে কেরিনা কার। আধার রাতে কালো বিশাল গাড়ী আকাবাঁকা রাস্তা পীচঢালা পথ শেষে আমরা কাঁচা মেঠো রাস্তায় এসে নামি। চালক এস.টি.পি করিম সাহেব এর দক্ষতার কারনে আমরা জানাজার নামাজে যোগ দেই। বিশাল হাইল হাওর এর দক্ষিন পশ্চিম এলাকাব্যাপী শত একর বিস্তৃত রাজা ফিশারী ও হ্যাচারি। স্থাপনাও আছে-তাঁর বাসগৃহ ছাড়া মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলাম শিক্ষা ও চর্চাকেন্দ্র, সমস্ত এলাকাটি বিদ্যোতায়িত। হাওর-বাওর আমার খুবই প্রিয় জায়গা আমিও হাওর পাড়ের ছেলে। ছোট কালে হাওরের কোলে বেড়ে উঠেছি-বড় হয়েছি-হাল চাষ ক্ষেত কৃষিতে নয়, সৌন্দর্য্য উপভোগ করা মাছমারা পাখি ধরায়। ইতিপূর্বেও হাইল হাওরের পশ্চিমাঞ্চলে আমি নব্বইর দশকে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের সঙ্গেঁ মাছের পোনা অবমুক্ত করনের অনুষ্টানে গিয়েছিলাম। বর্ত্তমানে হাইল হাওড়কে কেন্দ্র করে বেশ কতেক মৎস ও কৃষি খামার গড়ে উঠছে এতে দেশীয় অর্থনীতির ভিত মজবুত হচ্ছে। রাজা ফিশারি ও হ্যাচারি তেমনি একটি বিশাল মৎস খামার। রাতের বেলা এই হাওড়ের গ্রাম্য এলাকায় দেখে অনেকেই অবাক হলেন। পরিচিত অনেককেই পেলাম। গ্রামের মানুষ খুবই সহজ সরল। অনেকেই আমার কুশল জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। জানালাম মরহুম রাজা মিয়া আমার আত্বীয় এবং একজন ধর্মপ্রান মুসলমান সহজ সরল সাদা মনের সৎ মানুষ ছিলেন তাই তাকে শেষ বিদায় জানাতে তার নামাজে জানাজায় শরীক হতে, তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করতে এসেছি। বিপুল সংখ্যক গ্রামীন মুছল্লি মরহুমের নামাজে জানাজায় শরীক হলেন। সকলেই বল্লেন বড় ভালো মানুষ ছিলেন, গরীব দূঃখির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। জানাজার নামাজ শেষে মোনাজাত এর সময় ইমাম সাহেব হাউমাউ করে কান্না কাটি করে আল্লাহর দরবারে আরজি পেশ করে বল্লেন আল্লাহর এই বান্দা একজন ফরেজগার ইমানদার ধর্ম্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন আল্লা রসুল ও কোরআন হাদীস অর্ন্তপ্রান ছিলেন। আলেম ওলামা পীর মাশায়েখ গনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাকরতেন। নামাজে জানাজা শেষে গোলাম মোস্তফা রাজাকে মোতিগঞ্জের শ্যামল মাটির কোমল বিছানায় চীর শয়ানে শায়ীত করা হয়। আজ থেকে সত্তোর বৎসরাধিক কাল পূর্বে মৌলভীবাজার সদর উপজেলাধীন চাঁদনীঘাট ইউনিয়ন অন্তর্গত আশিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মৌলভী মোহাম্মদ ছনাওর এর ঔরসে যে মানব শিশুর জন্ম, বৃটেনে বেড়ে উঠা, সংসার, সন্তান, ব্যবসা বানিজ্য-দুনিয়াদারী শেষে সবাইকে ফেলে গোলাম মোস্তফা রাজা একা একা চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। একদিন তার কবরের মাটি শুকিয়ে যাবে, গজাবে ঘাস লতা,পাতা, হয়ত ফুটবে নাম না জানা ঘাসফুলও। তার মাটির শরীর মাটিতে মিশে যাবে, তিনিও প্রাকৃতিক নিয়মে হয়ত হারিয়ে যাবেন স্মৃতির গভীরে কিন্তু রয়ে যাবে তাঁর উজ্জল স্মৃতি, তার কথা ও কাজ, তার কর্ম-কির্তী তাঁর মসজিদ মাদ্রাসা, তাঁর ধর্মীয় প্রতিষ্টান গুলি-যা রোজ কিয়ামত পর্য্যন্ত তাঁর উজ্জল স্মৃতি বহন করবে। তার দাফন-কাফন-কবর যিয়ারত শেষে মোতিগঞ্জ পিছনে ফেলে আমরা চলে আসি। হয়ত আর কোনদিন সেখানে যাওয়া হবেনা, তাঁর কবর জিয়ারত ফাতেহা পাঠ হবে না। মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।
মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান গোলাম মোস্তফা রাজা মোহাম্মদ ছনাওর এর দ্বিতীয় পুত্র। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তখন সিলেটি তরুন-যুবাদের লন্ডনে যাবার জোয়ার ও ঝড়। তখন গ্রাম্য বাজারে-শহরে কবিগান প্রচলিত ছিল- আইলরে লন্ডনের ঝড়, তাড়াতাড়ি পাশপোর্ট কর- দিনত গইয়া যায় রে। আসিয়া, বালিকান্দি, মমরুজপুর, গদাধর, সাবিয়া শহরতলির বর্ধিষ্ণু গ্রামাঞ্চল। মহকুমা শহরের হাওয়া-বাতাস সহজেই লাগে। সেই সুবাদে ষাটের দশকের শুরুতে সেই সময়কার রেওয়াজ অনুযায়ী গোলাম মোস্তফা রাজা যুক্তরাজ্য গমন করতঃ সততা, কর্তব্যনিষ্টা এবং পরিশ্রমের ফলে বিত্ত বেসাতের মালিক হন। ঘর সংসার, ব্যবসা, বাসা সবই করেন। লন্ডনে নিজস্ব বাসাবাড়ি একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্টান, ঢাকার উত্তরায় বিশাল প্লট এর মালিক হন তিনি। পারিবারিক জীবনেও গোলাম মোস্তফা রাজা তিন পুত্র দুই কন্যার গর্বিত পিতা।
পরিনত বয়সে মানষিক পরিবর্তন আসে গোলাম মোস্তফা রাজার মনে। তাঁর মনে হয় বিদেশের এই বিত্ত বেসাত নাম ডাকই জীবনের সব কিছু নয়, জীবন মানে অন্য কিছুও। প্রবাসী গোলাম মোস্তফা রাজা নিজের দেশ নিজের এলাকার টানে চাকচিক্যময় লন্ডনী জীবন ফেলে বিপুল সম্পদের বিত্ত বেসাত নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসেন। মনু নদীর কুলে যিনি বেড়ে উঠেছেন টেমস নদীত তাঁকে আটকে রাখতে পারেনা। দেশে এসে তিনি গ্রামীন অর্থনীতির অবকাঠামোগত উন্নয়নে আত্বনিয়োগ করেন-গড়ে তুলেন তার এই বিশাল মৎস ও কৃষি খামার। শেষ মেস ঢাকা শহরের মায়াও তিনি ছেড়ে দেন, রাজধানীর উত্তরার বিশাল সম্পত্তি বিক্রী করে মফস্বলের বাসিন্দা হন প্রকৃতি প্রেমি নিস্বর্গবিদ গোলাম মোস্তফা রাজা। তাঁর মৎস খামার ও বাঁশ ঝাড় কে ঘিরে একসময় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠে পাখ পাখালির অভয়াশ্রম। চিল, বক, সারস, হাস, পানকৌড়ি, সরালি ইত্যাদি দেশী বিদেশী পাখি মৎস খামার গুলিতে অবাধ বিচরন করতঃ পয়ামলি দিয়ে খামার সমূহের মৎস সম্পদ বিনষ্ট করায় সাধারনত খামার মালিক গন পাখ পাখালিকে সুনযরে দেখতেন না কিন্তু খামারি গোলাম মোস্তফা রাজা ছিলেন এর ব্যাতিক্রম। তিনি তার এলাকায় পাখ পাখালি ধরা ও শিকার বন্ধ করে দেন এবং তাদের অবাধ বিচরনে কোন বাধা দিতেন না ফলতঃ তার এলাকাও বাড়ি -পাখি বাড়ি- হিসাবে খ্যাতি পরিচিতি লাভ করে, স্বীকৃতি অর্জন করে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া রাজা মিয়ার পাখি বাড়ি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ-প্রচার করেন। এ ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন একুশে টিভি ও দৈনিক ভোরের কাগজের স্থানীয় প্রতিনিধি শ্রীমঙ্গঁল প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি বিকুল চক্রবর্ত্তী। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক-অনুসন্ধানী সাংবাদিক ¯েœহভাজন বিকুল চক্রবর্ত্তী এ প্রজন্মের প্রিয় সাংবাদিক হলেও প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য এবং প্রবীন প্রসঙ্গেঁ কাজ করতে উৎসাহী। শ্রীযুক্ত চক্রবর্তী জানতেন দেশবরন্যে নিসর্গবিদ প্রকৃতিপ্রেমি বৃক্ষমানব, দ্বিজেন শর্মার সঙ্গেঁ আমার সু-সম্পর্ক ও সখ্যতার কথা। বিকুল চক্রবর্ত্তী বায়না ধরলেন শ্রদ্ধেয় শর্মার সঙ্গে দেখা করবেন- তাঁর সাক্ষাতকার নেবেন। ইতোমধ্যে প্রফেসর দ্বিজেন শর্মা একুশে পদক প্রাপ্তিতে আমাদের জেলা সদরে পরিবেশ কর্মি ও লেখা লেখির অঙ্গঁনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দ্বিজেন শর্মা আমাদের জেলারই সু-সন্তান। কবি ও কবিতা সংগঠন অনুপ্রাশ-এ- আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্ত হল একুশে পদক প্রাপ্ত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মাকে আমরা সম্ভর্ধনা দেব। অনুপ্রাশ সম্পাদক কবি কিশোরী পদ দেব শ্যামল, জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি কবি আব্দুল মতিন আমাকে দায়িত্ব দিলেন দ্বিজেন শর্মার সঙ্গেঁ আলোচনা করে দিন তারিখ ঠিক করতে। সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্ত্তীকে শর্মা এই সংবাদ দিলে তিনি মহানন্দে আমার সফর সঙ্গীঁ হতে চাইলেন। বিকুল চক্রবর্ত্তীর সঙ্গেঁ সুসম্পর্ক যুক্ত পক্ষী বন্ধু ও প্রকৃতি প্রেমি গোলাম মোস্তফা রাজা দ্বিজেন শর্মার সঙ্গেঁ সাক্ষাত ও কথা বলতে চাইলেন। যেই কথা সেই কাজ আমি শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন শর্মার সঙ্গেঁ তার ইস্কাটনের বাসায় যোগাযোগ করে এ্যপয়েন্টমেন্ট করলাম। তিনিও খুবই খুশী হলেন।
সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকাস্থ ইস্কাটনের দশতলায় দ্বিজেন শর্মার বাস ভবনে কয়েক ঘন্টার সান্ধ্যকালীন আসর আমার জীবনের অন্যতম স্মরনীয় সন্ধ্যা। জ্ঞানতাপস দ্বিজেন শর্মা প্রগতি প্রকাশনী-মস্কো- তে তিন দশক কাজ করেছেন। আশি পেরিয়ে এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন, প্রকৃতি পরিবেশ ও বৃক্ষ প্রসঙ্গেঁ কলাম লিখছেন। সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্ত্তী তার লম্বা ইন্টারভিউ নিলেন। ঘরোয়া পরিবেশে খোলামেলা অনেক কথাই বল্লেন তিনি। একজন সাধারন প্রবাসী গোলাম মোস্তফা রাজা মিয়া দেশ বরন্যে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী প্রফেসর দ্বিজেন শর্মার সঙ্গেঁ দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতি প্রসঙ্গেঁ যে জ্ঞান গর্ভ আলোচনা করলেন তাতে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। আমার মামা শুনে দ্বিজেন শর্মাও তাকে মামা বলে সম্ভোধন করলেন, তাঁর মেধা ও জ্ঞানের পরিধির প্রসংশা করলেন। আমাদেরকে আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করলেন।
গোলাম মোস্তফা রাজা একজন পুস্প প্রেমিকও ছিলেন। তার একটি বিশাল গোলাপ বাগান ছিল। তাঁর সারল্যের সুযোগ নিয়ে কতেক প্রতারক ব্যবসা বানিজ্যের কথা বলে তার বিপুল পরিমান টাকা আত্বসাত করে। কিছু তামেশগীর ও মোসাহেব তাকে ভূল পরামর্শ দিয়ে তার লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষতি সাধন করে। প্রথমতঃ লজ্জায় তিনি আমার কাছে আসেন নি, মোসাহেব ও চাটুকার চক্রটি তাঁকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে রাখে। যখন তিনি এলেন তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, তাঁকে আমি আইনগত সহায়তা দিলেও আর্থীক লাভ দিতে পারিনি, কারন তখন সে সুযোগ ছিলনা। মামলা মোকদ্দমার ঝামেলার মাঝেও তাঁর একটা পরিচ্ছন্ন রুচীবোধ ছিল। কোর্টে এলেই তিনি আমার জন্য একটি বৃহদাকৃতির তাজা গোলাপের তোড়া নিয়ে আসতেন। আমার মনে আছে তখন আমি জেলা বারের সভাপতি। বর্ত্তমান সভাপতি এডভোকেট রমাকান্ত দাশগুপ্ত সম্পাদক। মহান আল্লাহর মেহের বানীতে জেলাবার সদস্যবৃন্দ আমাকে চারবার সভাপতি বানিয়েছিলেন। সেসময় একাত্তোরের বীর, একাধিক আইন গ্রন্থ প্রনেতা হাসান শহীদ ফেরদৌস সাহেব ছিলেন মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ। অসম্ভব রকমের সৎ, মেধাবী ছিলেন তিনি। তার পরিবার ঢাকা থাকার কারনে তিনি একা থাকতেন, আদালতের কাজ ছাড়া লেখাপড়ায় ব্যস্থ থাকতেন। তিনি খুবই পুস্প প্রেমিক ও উন্নত নৈতিকতা বোধ সম্পন্ন বিচারক ছিলেন। আমি প্রায়ই তার সালাম পেতাম। সঙ্গঁ দিতাম। রাজা মামার তাজা ফুলগুলি উপহার দিতাম। হপ্তাহান্তে কিংবা মাসে একবার করে রাজা মামা ফুল সমেত আমার চেম্বারে আসতেন। আমার এখনও মনে পড়ে তার সেই বিনয়ী সহজ সরল চেহারা। মাঝারি উচ্চতার শ্যামলা চেহারায় গোলবাটা মুখে একটি গুয়ামেরি মিষ্টি হাসি। মুচকি হাসি। মাথার মাঝখানে টাক পড়ে গেছে। কেশের বাহার কিংবা বিন্যাস নেই। এলোমেলো। সাদামাঠা সাধারন সার্ট প্যেন্ট পরিধানে পোষাকের বাহাদুরি-ফোটানি নেই। এত অর্থ বিত্তের মালিক হয়েও লোক দেখানো কোন ভাব নেই। তার হাতে কোনদিন কোন বিড়ি সিগ্রেট দেখিনি। একদিন রাজা মামাকে বলেই ফেল্লাম তাজা ফুল আমাদের জজ সাহেবের খুবই প্রিয়। ফলতঃ ফুলের পরিমান তিনি বাড়িয়ে দিলেন। রাজা মামা জজ সাহেবের সঙ্গেঁ আমার দৃশ্যত ও অবস্থানগত সুসম্পর্কের সুবাদে তার মামলার জন্য তদবির কিংবা আমাকে নিয়ে জজ সাহেবের সঙ্গেঁ সাক্ষাত করতে চাননি, এমনটি আইনসিদ্ধ ও সৌজন্যমূলক নয় বিবেচনায় তিনি তা পরিহার করে চলেছেন। অথছ পেশাগত ও প্রাত্যহিক জীবনে আমাকে অনেকেই এমন প্রস্তাব করেন, আমি না করলে অনেকেই নারাজ হন। যাঁরা আমাকে ভালোভাবে চিনেন তারা যানেন আমি তদবীর ও ধান্দাবাজি করিনা, সাহেবদের তোষামুদি-মোসাহেবী করিনা, প্রয়োজনীয় ও প্রাপ্য সম্মান দেই। অসৎ জজ সাহেবদের সঙ্গেঁ আমি ও আমাদের জেলাবার সম্পর্ক রাখেন না। জেলা জজ সিকান্দর আলীকে এড়িয়ে চলেছি, সিকান্দর কা মুকাদ্দর হইনি, কারন তার বদনাম ছিল। একই কারনে নারী শিশু ট্রাইব্যুনাল জজ নূর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীঁর সরকারের উমেদার হইনি, তিনি মাস তিনেকের মাথায় পত্র পাঠে বিদায় হয়েছিলেন। রাজা মামা দীর্ঘকাল বিলেতে থাকার কারনে আইন আদালত সততা ও ন্যায় বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রসঙ্গঁত সবিশেষ উল্লেখযোগ্য আমাদের বর্ত্তমান জেলা ও দায়রা জজ শেখ মোহাম্মদ আবু তাহের সাহেব একজন সৎ ও নির্ভীক ন্যায় বিচারক। তাজা ফুলের বাগান মালিক রাজা মামা এমন জানলে-শুনলে ও দেখলে খুবই খুশী হতেন।
হার্ট এ্যটাকে হার্টফেল অকস্মাত ও আকস্মিক দূর্ঘটনা-এ্যটাক এন্ড ফিনিশ-আক্রান্ত ব্যক্তি হয়ত ভালো করে কলেমা শাহাদাত পড়তে পারেন না। একেবারেই সব শেষ। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাক্তার, নার্স, ঔষধ পথ্য-রাতবিরাত প্রানান্তপরিশ্রম অতঃপর বিশাল অংকের বিল যার টাকার অংকের পরিমান দেখলে মধ্যবিত্ত রুগীর সুস্থ স্বজনদের হার্ট এ্যটাক হওয়ার অবস্থা হয়। এ সপ্তাহে মাত্র ষাটের কোঠায় এসে সুদর্শন ও সুস্বাস্থের অধিকারি লেখক ও গবেষক মাহফুজুর রহমান এক এ্যটাকেই সব শেষ। হাসপাতালে নিলে ডাক্তার ঘোষনা করলেন সব শেষ-মৃত। এই জাতীয় আকস্মিক ও হঠাৎ মৃত্যোকে আমি নাম দিয়েছি -রয়েল ডিপারছার- রাজার্ষিক প্রস্থান। ধর্মপ্রাণ মুসলমান মানব প্রেমিক, পাখিসখা গোলাম মোস্তফা রাজার ও রাজকীয় প্রস্থানই হয়েছিল আঠারো সালের পহেলা জানুয়ারী।
মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গেল, আমার নিজেরই এখন শাহ আব্দুল করিমের ভাষায় গাড়ী চলেনা-চলেনা রে- অবস্থা। তাই মোতিগঞ্জ আর যাওয়া কিংবা তাঁর কবর জিয়ারত সম্ভব হয়নি। রাজা ফিশারি এন্ড হেচারির বাঁশবনে পাখপাখালির মেলা বসে কিনা আমি জানি না। বনের পশুপাখী কি তাদের বন্ধু রাজা মিয়ার কথা মনে করেĪ হয়ত করে, হয়ত করেনা, কি করে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন- কারন তিনি আলীমুল গায়েব-। তবে রাজা মামার গোলাপ বাগানে আর তাহা গোলাপ পাওয়া যাবেনা, কারন তাঁর মত এমন মায়ায় মমতায় আর কে করবেন এমন বাগান চর্চাĪ আর কোনদিন গোলাম মোস্তফা রাজা তাঁর বাগানের তাজা গোলাপ হাতে নিয়ে জেলা বারে- আমার চেম্বারে আসবেন না, মিষ্টি করে হাসবেন না, মায়া করে বলবেন না-“ মামু টেইক ইওর ফ্লাওয়ার”-।
পুস্প, প্রকৃতি ও মানব প্রেমিক গোলাম মোস্তফা রাজা মিয়া নিজের নামের পূর্বে অনেক সময় মাষ্টার গোলাম মোস্তফা লিখতেন। আমি প্রশ্ন করে এর উত্তর ও ব্যাখ্যা পাইনি, শুধু মিষ্টি করে মুচকি হাসতেন। তাঁর রুহের তৃপ্তি ও সম্মানার্থে তার নামের পূর্বে তার মত করে মাষ্টার বাক্যটি ব্যবহার করলাম। এমনিতে গোলাম মোস্তফা একটি অর্থবোধক এবং পবিত্র নাম। এই নামের সঙ্গেঁ আমাদের পিয়ারা নবী-আমাদের মহানবী মহামানব মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) এর পবিত্রতা ও পবিত্র নাম জড়িত। যদিও এই পবিত্র নামের উচ্চারন হওয়া উচিত গোলাম-ই-মোস্তফা, মোস্তফার গোলাম-নবিজীর গোলাম।
মাষ্টার গোলাম মোস্তফা রাজা মিয়া প্রচুর অর্থ ও বিশাল ভূ-সম্পত্তি রেখে গেছেন-তার ওয়ারিশানগনই তার মালিক। তার ওয়ারিশানের উদ্যোগে একটি রাজা স্মৃতি সংসদ, রাজা স্মৃতি পাঠাগার এবং পাখি পরিচর্য্যা ও সংরক্ষনের জন্য রাজা বার্ডসক্লাব- গঠিত হতে পারে।
তাঁর জন্ম ও মৃত্যো বার্ষিকীতে তার রুহের মাগফিরাত কামনায় ওয়াজ নসিহত মিলাদ মাহফিল এর আয়োজন করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে মরহুমের একান্ত ¯েœহ ভাজন ভ্রাতা দেশ ও সমাজ কর্মি এম.এ রহিম -কেই এগিয়ে আসতে হবে। আমার নিজের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই শর্তহীন সহযোগিতার আশ^াস দিলাম।
মানব প্রেমিক পাখি সখা গোলাম মোস্তফা রাজার উজ্জল স্মৃতির প্রতি গ্রভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।
[লেখক মরহুমের প্রিয় ভাগনা, প্রবীন আইনজীবী, সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট]
মন্তব্য করুন