পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আয়ুবী সামরীক স্বৈর শাসন বিরোধী আন্দোলনের নির্ভীক সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ্ আজিজুর রহমানের জীবনাবসান : স্মরন :

September 24, 2018,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ গত ষোলই সেপ্টেম্বের রোববার সকালে সিলেট বিভাগীয় সদরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করতঃ সহান মৃত্যোকে আলীঙ্গন করেন পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আয়ূবী সামরীক স্বৈর শাসন বিরোধী আন্দোলনের আপোষহীন নির্ভিক সৈনিক, একাত্তোরের বীর মুক্তি যোদ্ধা, সাবেক সাংসদ শাহ আজিজুর রহমান। তাঁর মৃত্যো আকস্মিক ও অসময়ের না হলেও নিঃসন্দেহে-ই নিদারুন বেদনাদায়ক। সাম্প্রতিক কালে সত্তোরের কোটায় এসে বার্ধক্য জনিত ব্যাধিতে ভূগছিলেন একাত্তোরের অকুতভয় বীর। গেল সপ্তাহে তার অসুস্থতা জনিত সংবাদ পত্রিকান্তরে দৃষ্টে সিলেটের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট-বৃক্ষ ও মানব প্রেমিক বন্ধুবর আফতাব চৌধুরী কে ফোন করে ভাতৃ প্রতিম শাহ আজিজুর রহমানের খুজ খবর নিতে দেখভাল করতে অনুরোধ করি। ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত আমার প্রিয় আজিজ ভাই পীর বংশী সহজ সরল বন্ধু ও ভ্রাতৃবৎসল সাদা মনের মানুষ ছিলেন। একাত্তোরের বীর শাহ্ আজিজুর রহমানের মৃত্যুতে সিলেটের রাজনীতি মুক্তিযোদ্ধা সমাজ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তার রাজনৈতিক সহকর্মি, রনাঙ্গনের সাথীগন তার মরদেহের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। হযরত শাহ জালালের দরগা শরীফ মসজিদ প্রাঙ্গঁনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার শেষে অনুষ্টিত হয় তাঁর বড় আকারের নামাজে জানাজা। তাঁকে তাদের গ্রামের বাড়ি বালাগঞ্জ পারিবারিক গোরস্থানে চীর শয়ানে শায়িত করা হয়। নিজ জন্ম ও কর্ম্ম ভূমি বালাগঞ্জের সর্ব শ্রেনীর নাগরিক সমাজ তাদের যোগ্য সন্তানের প্রতি শেষ সম্মান-শ্রদ্ধা ও বিদায় জানান।

একে একে নিভিছে দেউটি। রতœ গর্ভা সিলেট একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ জনপদ। ষাটের দশকে সিলেটের বীর ছাত্র যুবজনতা সামরীক স্বৈর শাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ূব খান বিরোধী সামরীক শাসনের বিরুদ্ধে দূর্বার ছাত্র-গনআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ঠিক তেমনি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সিলেটের বীর যোদ্ধাগন বীরত্বপূর্ন ভূমিকা ও কৃতিত্ব পূর্ন অবদান রাখেন।

রতœগর্ভা সিলেটের একাত্তোরের বীরেরা এখন সত্তরোর্ধ-জীবন সায়াহ্নে। অনেকেই জীবনের লেনাদেনা চুকিয়ে এখন চীর তরে পর পাড়ে- না ফেরার দেশে। একাত্তোরের বীর যোদ্ধা ও সংঘঠকদের মধ্যে সর্ব জনাব দেওয়ান ফরিদ গাজি, দেওয়ান নূরুল হোসেন চঞ্চল, আখতার আহমদ, এনামুল হক চৌধুরী বীর প্রতীক, ইয়ামীন চৌধুরী বি.বি প্রমুখ এখন পরলোকে। ষাট-সত্তোর দশকের উজ্জল নক্ষত্র শাহ্ আজিজুর রহমানের মহা প্রয়ানে আরেকটি নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতি হল। ইদানিং লাশের মিছিল চলছেই চলছে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক সদ্য প্রয়াত অনুজ প্রতিম মাহফুজুর রহমানের শোক সভায় বসেই সংবাদ পেলাম আনোয়ার মেডিকেল এর মালিক ¯েœহ ভাজন আনোয়ার হার্ট এ্যটাক হয়ে অসময়ে আকস্মিক ভাবে চলে গেছে। বাদ আছর তার গ্রামের বাড়ী শ্রীরামপুরস্থ জামে মসজিদ প্রাঙ্গঁনে নামাজে জানাজা। ঘরোয়া- শাহবন্দর এলাকায় রাস্তাঘাট ভালো যেতে কোন অসুবিধা নেই। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুবর আলহাজ¦ গোলাম মওলার গাড়ীতেই আনোয়ার এর জানাযার নামাজে গেলাম। অতঃপর সংবাদ পেলাম জেলা যুবদলের সাবেক সাধারন সম্পাদক ¯েœহভাজন আনকার আলী সুলেমান ও মারা গেছেন। মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করলাম। মহান মালিক তাদের বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করলাম। স্বাধীনতার সংঘঠক সাবেক সাংসদ শাহ্ আজিজুর রহমানের সঙ্গেঁ আমার পরিচয় ও সম্পর্ক ষাটের দশকের শুরুতে। পরিচয় ও সম্পর্কটি ছিল আদর্শিক। রাজনৈতিক। আমি একজন ছাত্রলীগ কর্মি সংঘঠক ছিলাম। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্টার লক্ষে ১৯৬২ সালে গোপন সংঘঠন নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সম্পাদক তাত্বিক সিরাজুল আলম খান। তার ভক্ত ছিলাম। আছিও। ঐ দশকের শুরুতে ঐতিহ্যবাহী এম.সি কলেজ সিলেট এর ছাত্র ছিলাম। তখন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন দুটি শক্তিশালী ও ছাত্র প্রিয় ছাত্র সংঘঠন ছিল। ষাটের দশক বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের স্বর্নযুগ। ঐতিহ্যবাহী সিলেটে তখন ছাত্র লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে দেওয়ান নূরুল হোসেন চঞ্চল, আখতার আহমদ, শাহ আজিজুর রহমান, আশরাফ আলী, এনামুল হক, লুৎফুর রহমান এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে গুলজার আহমদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য। সেসময় আমাদের প্রজন্মের নেতা ছিলেন সৈয়দ মোস্তফা কামাল। তিনি “রং এর বিবি” গ্রন্থ প্রকাশ করে সিলেটের সাহিত্যাঙ্গঁনে আলো ছড়িয়ে ছিলেন, সাহিত্য ও ছাত্র রাজনীতির ভূবনকে প্রানময় বাঙময় করে তুলেছিলেন। স্যারদের মধ্যে ইংরেজীর অধ্যাপক এ.এইচ.মোফাজ্জল করিম ছিলেন কাব্যে-সাহিত্যে সকলের প্রেরনার উৎস। আয়ুবী স্বৈর শাসনামলে এবডো, প্রডো, পি.পি.আর জাতীয় নিবর্তন মূলক কালাকানুন জারী করে রাজনৈতিক দল সমূহকে সংঘটিত-বিকশিত হতে দেয়া হয়নি বিধায় ছাত্র সমাজকেই আন্দোলনে সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হত। সিলেটে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী ছাত্র সংঘঠন ছিল। ছাত্রনেতা শাহ্ আজিজুর রহমান একজন শক্তিমান সংঘটক এবং জ¦ালাময়ী অনল বর্ষী বক্তা ছিলেন। দেশ প্রেমিক এবং দূঃ সাহসী ছিলেন। পাকিস্তানের কথিত লৌহ মানব ফৌজি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আয়ূব খানকে সিলেট শহরে জুতা প্রদর্শন করে সাহসী ছাত্র নেতা শাহ আজিজুর রহমান যে দূঃসাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তা ইতিহাসের অংশ। তিনি সিলেট ছাত্রলীগের সভাপতি ও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

নিখাদ মুজিব সৈনিক শাহ আজিজুর রহমান ছাত্র জীবন শেষে আর ডানে বায়ে তাকাননি, দলত্যাগী হননি, কিংবা দল পরিবর্তনও করেন নি ছাত্রলীগ থেকে সরাসরি আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে এসেছেন-নেতৃত্ব দিয়েছেন, এশর্^াদী স্বৈর শাসনামলে নিজ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায় নিজ উপজেলা বালাগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান এবং পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার প্রিয় দল আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নৌকা প্রতীকে এম.পি হন। তাঁর জনপ্রতিনিধিত্বে অসাধূতা, দূর্নীতি ও দূবৃত্তায়ন ছিলনা, তিনি ছিলেনন আপাদক মস্তক একজন সৎ মানুষ, মহত মানুষ, সাদা মনের নির্ভেজাল মানুষ। নির্লোভ মানুষ। তার উপজেলা চেয়ারম্যান এর কার্য্য কালীন তার সততা ও আড়ম্বরহীন সাধারন জীবন যাপনের গল্প করেন মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্য আমার প্রিয় কনিষ্ট কলিগ ও বেআই এডভোকেট অসিত ভট্টাচার্য্য, তখন তিনি নবীন আইনজীবী হিসাবে বালাগঞ্জ উপজেলা হাকিম আদালতে আইন ব্যবসায় রত ছিলেন। পূরুষালি গোফ, শেভহীন উশকো খুশকো কাঁচা পাঁকা দাড়ি, মাঝ মাথায় টাক সমেত শাহ্ আজিজুর রহমান সাধারন পোষাক পরিধান করে সাধারন জীবন যাপন করলেও ধূমপায়ী ছিলেন। তাঁর কোন বাহাদূরি.তকব্বরি, ডাট-ফাট-ফুটানি ছিলনা, বরং সাধারন পোষাকে সাদা মাঠা জীবন যাপনকারী শাহ্ আজিজ ছিলেন এক অসাধারন মানুষ। একটি ব্যাপারেই তাঁর ভীষন দূর্বলতা ছিল, তা হল ধূমপান। দামী সিগ্রেট কেনার পয়সা না থাকলে তিনি হুক্কা টানতেন। এই আধুনিক জমানায় সিলেটি ডাবা কিংবা হুক্কার এখন আর প্রচলন নাই। গ্রামের ধূমপায়ী কৃষক মজুর ও এখন বিড়ি সিগারেট পান করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আজিজুর রহমান বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদে দায়িত্ব পালন কালে নিয়মিত হুক্কা খেতেন, তবে তা হাতুয়া ডাবা নয়, নলওয়ালা বাহারী ফর্সি হুক্কা। চারদলীয় জোট সরকারামলে একটি জনস্বার্থ সংক্রান্ত কাজের জন্য আজিজ ভাই আমার বাসায় এসেছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন। আমি শুধু বলেছিলাম আপনি খবর করলে আমিই আপনার সঙ্গেঁ দেখা করতাম। তৃপ্তির হাসি হেসে শাহ আজিজ বলেছিলেন, তুমি খুবই ব্যাস্ত থাক, তাছাড়া তুমি আর ষাটের দশকের ছোট মুজিবটি নেই, তুমি এখন অনেক বড় হয়েছ, তোমার অনেক নাম ডাক। তোমার লেখার আমি একজন ভক্ত ও পাঠক। বিনয়ী ও বাক্যবাগীশ শাহ আজিজের সঙ্গে আর তর্ক করিনি। তাঁর কথা সহাস্য বদনে অধিক বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছিলাম।

সেই ষাটের দশকের শুরুতে ঐতিহ্যবাহী এম.সি কলেজে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে এলেও সিলেটের মাটি ও মানুষের সঙ্গেঁ সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় নি, বরং সেই থেকে শুরু, এই ক’ দশকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের বন্ধন আরো মজবুত হয়েছে। বিভাগীয় সদর ছাড়াও পীরানে পীর ইয়েমেনী বীর হযরত শাহ জালালের মাজার, -“ছিলটি”- ঐতিহ্য আমাদেরকে এক ও অভিন্ন করে রেখেছে। ষাটের দশকে -সেই স্বর্নযুগের আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার-রা, আমাদের নেতৃবৃন্দ, সতীর্থ ভাই বন্ধুগন এখনও একে অন্যের খুজ খবর করি, করেন। ইংরেজীর অধ্যাপক-আবৃত্তিকার ও সাস্কৃতিক আন্দোলনের নায়ক এ.এইচ.মোফাজ্জল করিম সি.এস.পি হয়ে সচিব মান্যবর হাই কমিশনার এর দায়িত্ব পারন শেষে দেশের শীর্ষ স্থানীয় কবি ও কলামিষ্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন, এখনও সেই ষাটের দশকের মত ছাত্র বৎ-মিত্র বৎ মায়ামমতা করেন। খুজ খবর রাখেন।

ষাটের দশকের একটি উজ্জল নক্ষত্র শাহ আজিজুর রহমান-আমাদের প্রিয় আজিজ ভাইর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করতঃ তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি, মহান মালিক তার বেহেশত নসীব করুন, এই মোনাজাত করছি।

[লেখক: ষাটের দশকে এম.সি কলেজের ছাত্র। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট। সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]

 

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com