পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ কত ভারী?
এহসান বিন মুজাহির॥ বেলা শেষে সূর্য যেমন সব পাঠ চুকিয়ে বিদায় হয়। তাকে বিদায় নিতে হয়। দিবাকরের অস্ত পথ যেমন কেউ রুখতে পারে না, ঠিক তদ্রƒপ মানুষের মৃত্যুও সময় যখন আসন্ন হবে, মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি যবে বেজে উঠবে তখন কেউ মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না। নির্ধারিত সময় থেকে পূর্ব ও পরে মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম হবে না। মৃত্যুর মিছিলে অকস্মাৎ যাত্রী হলেন জাবেদ ভাই।
সাতসকালে ফেসবুকের নিউজ ফিডে যখন খবরটি দেখি তখন অন্তরটি মোচড় দিয়ে উঠে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। বারবার মনে মনে বলছিলাম, খবরটি মিথ্যা বা গুজব হোক। কিন্তু না, কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইকিং এর আওয়াজ কানে পৌছলে-একটি শোক সংবাদ! ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। মুসলিমবাগস্থ মাইশা মেডিসিন সেন্টারের সত্তাধিকারী জাবেদ খান, রাত সাড়ে ১১টায়, হৃদরুগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন! তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। পৃথিবীর সব চলে যাওয়াই কষ্টের। তবে মায়াময় এই পৃথিবীর রূপ-রসে সিক্ত হওয়ার আগেই ৩৬/৩৭ বছরের একজন যুবকের চলে যাওয়া সহজে মেনে নেয়ার মতো নয়।
মোগল সম্রাট শাহজাহানকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? তার উত্তর ছিল- পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ! জীবনের পড়ন্ত বেলায় সন্তানের লাশ কাঁধে যিনি নিয়েছেন হয়তো তিনিই বুঝেছেন তার ভার কতটা? পিতা অপেক্ষা করছেন পুত্রের জন্য। পুত্রের লাশের জন্য। কী অপেক্ষা! যে ছেলের আঙুল ধরিয়ে হাঁটা শিখিয়েছিলেন, সেই ছেলের কবরে মাটি দেয়ার অপেক্ষা। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ সর্বদাই সবচেয়ে ভারী; কিন্তু এ অপেক্ষার লাশ বেশিই ভারী এক পিতার জন্য!
৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুর বারোটায়, মুসলিমবাগস্থ দারুল আজহার ইনস্টিটিউটের টিফিনের বিরতিতে দুপুরের নাশতা করার জন্য দক্ষিণ মুসলিমবাগ (গাংপার) রাজুর চাসস্টলে গিয়েছিলাম। সাথে স্কুলের দুইজন স্যারও ছিলেন। এসময় হঠাৎ জাবেদ ভাইয়ের কণ্ঠে-‘এহসান’ ভাই, আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন, আপনাকে খুঁজছিলাম… কথাগুলো তিনি একসাথেই বলে ফেললেন। সময় জাবেদ ভাইয়ের সাথে আমার মহল্লার কয়েকজন যুবকও সাথে ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন-এহসান ভাই আপনি তো ব্যস্ত থাকেন, কিছু আলাপ ছিলো। সহজে পাওয়া যায় না আপনাকে। বললাম বলেন ভাই। তখন তিনি বললেন মসজিদে একটি ডিপকল বসানো হচ্ছে এবিষয়ে কিছু আর্থিক অনুদান কালেকশনে নেমেছি। এখন আপনার স্কুলে যেতে চাই, সব শিক্ষকদের পাওয়া যাবে কিনা। বললাম সবাইকে পাওয়া যাবে, দ্রুত চলে যান, এখন বিরতিও আছে। পরে তিনি কয়েকজন যুবকদের নিয়ে দারুল আজহারে চলে আসলেন।
এরপর রাতের কহিনী … ! সবাইকে কাঁদিয়ে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। চল্লিশ বছরও অতিক্রান্ত করতে পারেননি, এর আগেই নশ্বর পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার ডাক আসলো। এরই নাম মানুষের হায়াত আর মউত’। ইন্তেকালের কবল থেকে দুনিয়ার কোনো অর্থশক্তি, পরাশক্তি, কোনো প্রযুক্তি কাউকে বাঁচাতে পারবে না। এখানে সবাই অক্ষম। কিন্তু মানুষের জীবন তো এই ঠুনকো ভিতের ওপরই দাঁড়িয়ে। আর এই জীবন নিয়েই তো আমরা কত বড়াই, অহমিকা করি। অর্থ-সম্পদ-বাড়ি-ঘর তথা দুনিয়া কামাই এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অপরের গীবত, দুর্নাম, কপটতা, অন্যায়-দুর্নীতির প্রতিযোগিতা লিপ্ত থাকি! কবে হবে আমাদের শুভ বুদ্ধি?
জাবেদ ভাই ছিলেন একজন সৎ মানুষ। জাবেদ ভাইকে দেখেছি ছোটকে স্নেহ করতে, বড়কে সম্মান করতে এসব ছিলো তার স্বভাবজাত গুণ। এলাকায় মাইশা নামে একটি ওষুধের ফার্মেসির সত্তাধিকারী ছিলেন। ছিলো। এলাকা, প্রতিষ্ঠান-মসজিদ, রাস্তাঘাট, ড্রেনসহ বিভিন্ন ভালো কাজে ছিলেন জড়িত। খেলাফত মজলিস শ্রীমঙ্গল মুসলিমবাগ শাখার সেক্রেটারিও ছিলেন। সমাজসেবা-পরপোকারী ছিলো তার অন্যতম বৈশিষ্ট। রাত একট কিংবা ২ টা, যখনই ফোন দিয়ে বলছি ভাই দ্রুত আসেন আমার বাসায়, আব্বার প্রেসার চেক করতে হবে, ইনজেকশন দিতে হবে। কালবিলম্ব না করে চলে আসতেন । তার জন্য দোয়া করি এর বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন।
জাবেদ ভাইয়ের ইন্তেকালে মুসলিমবাগ, আর শুধু কালিঘাট রোডই নয়; শ্রীমঙ্গলজুড়ে শোকের মাতম চলছে। যুবক-আবাল-বদ্ধ এমনকি মহিলারাও তাঁর জন্য চোখের পানি ফেলছেন! সদা হাস্যোজ্জল, নির্মল, শান্ত-ভদ্র ও সুন্দর চরিত্রের অধিকারী এমন ভালো যুবক আমার এলাকায় পাওয়া বিরল! প্রিয় জাবেদ ভাই এলাকার মুরব্বিসহ সব যুবকদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন।
পরিশেষে বলা যায়-পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে চির ও অনড় সত্য হলো মৃত্যু। মৃত্যুও নির্ধারিত সময় থেকে এক সেকেন্ড কমবেশি করার ক্ষমতা দুনিয়ার কারো নেই। মৃত্যুর অনিবার্য স্বাদ সব প্রাণীকে পান করতে হবে। কবির ভাষায়-‘জন্মিলে মরিতে হবে, চিরদিন কে কোথায় রবে?’ মানুষ মরিবে সবে, নহে সে অমর ভবে’। প্রত্যেক মানুষই মৃত্যুর মিছিলের নীরব যাত্রী। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সবাইকে মৃত্যুর পেয়ালা পান করতে হবে। যে জন্মেছে সে মরবেই। এটা মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার চিরন্তন বিধান। এ অমোঘ বিধান ‘মৃত্যুকে’ ঠেকানোর ক্ষমতা মহান আল্লাহ ব্যতীত পৃথিবীর আর কারো নেই। দুনিয়ার সব দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন মানুষ মরণশীল। প্রাণ আছে এমন সৃষ্টজীব সবাইকে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
মন্তব্য করুন