মুজিবুর রহমান মুজিব॥ আধুনিক বৃহত্তর সিলেট প্রাচীন কালে পাঁচটি প্রধান সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই পঞ্চ রাজ্য হলঃ ১। লাউড়, ২। গৌড়, ৩। তরফ. ৪। জৈন্তা ও ৫। ইটা।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উপমাহাদেশের খ্যাতিমান পিরানে পীর হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী তিনশত ষাট আওলিয়ার আওলিয়া বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ও আধ্যাত্বিক শক্তি বলে গৌড় এর কুখ্যাত ও অত্যাচারী শাসক সামন্ত রাজা গোবিন্দকে পরাজিত করে গৌড়ে প্রথম ইসলামের বিজয় নিশান উড়ান। হযরত শাহজালালের নেতৃত্বাধীন আওলিয়া বাহিনীতে তিনশত ষাট জন আওলিয়া ছিলেন বলে সিলেট-কে তিনশত ষাট আওলিয়ার মুল্লুক- বলা হয়। কথাছিল হযরত শাহজালালের সঙ্গেঁ আনা মাটির সঙ্গেঁ যে মাটির মিল পাওয়া যাবে সেখানেই হুজরা স্থাপন করবেন হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনী। মহান আল্লাহর নামে ফানা ফিল্লাহ হয়ে ইয়া রাসুল আল্লাহ বলে আল্লাহ ও নবী প্রেমিক শাহ্ শালাল ইয়েমেনী পিতৃ ও জন্মভূমি ইয়েমেন ছেড়ে ইসলাম প্রচারে বেরিয়ে পড়েন। দেশ, জনপদ, মাঠ-ঘাট, প্রান্তর পেরিয়ে গৌড় আসেন বীর শাহজালাল। সঙ্গেঁ আনা মাটির সঙ্গেঁ এ মাটির মিল খুঁজে পান শাহ জালালের সফর সঙ্গীঁ চাষনী পীর। এখানেই বসতি-হুজরা স্থাপন করেন পীর শাহজালাল- বীর শাহজালাল। গৌড়ের অত্যাচারি শাসক তান্ত্রীক গোবিন্দের চুড়ান্ত পতন হল। আত্বগোপন করতঃ পালিয়ে গেলেন গৌড় রাজ-গোবিন্দ। রাজা এবং রাজ্যে এমন ছন্দমিল হয়ে ছিল যে গৌড় রাজ গোবিন্দকে গৌড় গোবিন্দ বলা হত। সিলেটের প্রাচীন ইতিহাসে এ কুখ্যাত শাসক- গৌড় গোবিন্দ – হিসাবেই খ্যাত।
গৌড় বিজয়ের পর আওলিয়া বাহিনী বিজয়ের আনন্দে আহ্লাদিত হয়ে শুধু আনন্দই উপভোগ করছিলেন না, বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্র ইসলাম প্রচারেই বেড়িয়ে পড়েন।
সিলেট বিজয়ে হযরত শাহজালাল এর প্রধান সেনাপতি হযরত সৈয়দ নাসিরুদ্দীন সিপাহ্ সালার আধুনিক -হবিগঞ্জ- এলাকাধীন -তরফ- রাজ্যে অভিযান চালান। তরফ রাজা আচক নারায়ন ক্ষমতাবান বিখ্যাত শাসক। বীর যোদ্ধা সিপাহসালার নাসিরুদ্দীন সৈয়দ জাদা তরফ বিজয় করে ইসলামের বিজয় নিসান উড়ান। হবিগঞ্জ জেলাধীন-মুড়ারবন্দে এই বীর যোদ্ধাও মহান পীরের – পূর্ব পশ্চিমি ব্যাতিক্রমি মাজার বিদ্যমান।
হযরত শাহজালালের বিশ^স্থ ও প্রিয় সহচর হযরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা বোগদাদী ইসলাম প্রচারে সিলেটের দক্ষিনাঞ্চল আধুনিক মৌলভীবাজার এলাকাধীন মোস্তফাপুর এলাকায় হুজরা স্থাপন করতঃ ইসলাম প্রচারে আত্বনিয়োগ করেন। এই অঞ্চলে বর্শিজুড়া পাহাড় এলাকায় তখন চন্দ্র সিং মতান্তরে চন্দ্র নারায়ন নামে একজন সামন্ত শাসক বসবাস করতেন। সামন্ত শাসক চন্দ্র সিং পীরের আগমন, হুজরা স্থাপন ও ধর্ম প্রচার সহজভাবে মেনে নিতে পারেন নি। পীরের দরবারে লোক সমাগমের সংবাদ পেয়ে নাখোশ হন রাজা চন্দ্র সিং। দূত মারফত সংসার ত্যাগী এই পীরকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হুকুম জারী করলেন সামন্ত রাজা চন্দ্র নারায়ন। এমতাবস্থায় কিছু দিনের মধ্যে চন্দ্র রাজ্যের সিংহাসনে এক বিষধর বিশালাকৃতির সাপ বসে থাকে। লোকলস্বর মারফত সর্প বিতারনে ব্যার্থ হয়ে চন্দ্র রাজা সেকালের রাজকীয় রেওয়াজ অনুযায়ী রাজ গনকের স্মরনাপন্ন হন। রাজ গনক গননা-করতঃ ঘোষনা করলেন পাশ^বর্ত্তী জঙ্গঁলে বসবাস ও ইসলাম প্রচাররত এই পীর সাহেব ছাড়া এই সর্প বিতারনের সাধ্যি কারো নাই। সেমতে রাজ প্রতিনিধি গন সসম্মানে নবাগত পীর সৈয়দ শাহ মোস্তফা কে বর্শিজুড়া রাজবাড়ীতে নিয়ে আসেন। সর্ব শক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার অপার রহমত বরকতে সৈয়দ শাহ মোস্তফা বিসমিল্লাহ বলে একটি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে রাজ প্রসাদে গেলেন। রাজ সিংহাসনে বসে থাকা বিষধর সর্পকে চাবুকের মত হাত দিয়ে ধরে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে রাজ প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসেন। সেই থেকে তিনি – শেরে সওয়ার চাবুকমার বোগদাদী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। সামন্ত শাসক চন্দ্র নারায়ন সিং হযরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফার কারামতি ও অলৌকিত ক্ষমতা দেখে বিমুদ্ধ হন। এই পীরে কামেলের সঙ্গেঁ শত্রুতার পরিবর্তে সহযোগীতার আশ^াস দেন রাজা চন্দ্র নারায়ন।
হযরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা শেরে সওয়ার চাবুকমার বোগদাদী (রঃ) আল্লাহ্ প্রেমে ফানা ফিল্লাহ্ হয়ে ইসলাম প্রচারে আত্বনিয়োগ করেন। তাঁর বিনয়াচরন, সহজ সরল সাধারন জীবন যাপনে বিমুদ্ধ হয় দলে দলে লোকজন ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহন করতে থাকেন। পরবর্তী কালে এই পীরে কামেলের দুই ভ্রাতুস্পুত্র হযরত সৈয়দ ইয়াসিন এবং সৈয়দ ইসমাইল তাঁর সঙ্গেঁ এসে যোগ দেন। শাহ মোস্তফার মাজার এলাকায় পশ্চিম দক্ষিন কোনে এই দুই সাহেব জাদার মাজার শরীফ বিদ্যমান। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই বংশের বিখ্যাত ফারসি ভাষায় সুপন্ডিত ও অবসর প্রাপ্ত মুন্সেফ মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লা গোবিন্দশ্রী তে নিজ জমিদারী এলাকায় জনসাধারনের সুবিধার জন্য একটি ক্ষুদ্র বাজার প্রতিষ্টা করেন। মৌলভী সাহেব- প্রতিষ্টিত বাজারটি মৌলভীবাজার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। তৎকালীন বৃটিশ সরকার তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৮২ সালে সিলেটের দক্ষিনাঞ্চল নিয়ে মৌলভী সাহেবের বাজারকে কেন্দ্র করে – সাউথ সিলেট সাব ডিভিশন নামে একটি মহকুমা গঠন করে। সিলেটের কৃতি পুরুষ- আসামের শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া সি-আই-ই- সাহেব এই বংশেরই সু-সন্তান। মৌলভীবাজার সদরের মাননীয় সাংসদ, মরহুম সমাজ কল্যান মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর সহ ধর্মিনী সৈয়দা সায়রা মহসীন কাপ্তান মিয়া সাহেবের বংশের গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকার। সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা দরগা শরীফের বর্ত্তমান মোতাওয়াল্লী আলহাজ¦ সৈয়দ খলিলুল্লাহ ছালিক জুনেদ সাহেব বৃহত্তর সিলেটের একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ-গবেষক-লেখক ও সমাজ সেবকও বটেন।
প্রত্যেক বৎসর পহেলা মাঘ এই পীরে কামেলের বার্ষীক ওরশ শরীফ অনুষ্টিত হয়। মোতাওয়াল্লী সাহেবের নেতৃত্বে ওরশ উদযাপন কমিটি এবং বিভিন্ন উপ কমিটি গঠিত হয়। বার্ষীক উরুস উদযাপনে প্রশাসন-জনগন নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ সহযোগিতা করেন। বার্ষীক উরুসে ওয়াজ, মিলাদ, জিকির আজগার শিরনী হয়। অনেকেই নিজ উদ্যোগে ওরসে গরু, খাসি, হাস, মুরগী, ডাল, চাল উপহার দেন। একটি মজাদার আখনী পোলাও রান্না হয়, বিতরন করা হয় ভক্তগনকে। এই শিরনীকে ভাতের মেলা বলা হয়। ইতিপূর্বে বার্ষীক উরুশ শরীফে প্রত্যেক বৎসর প্রবীন সাংবাদিক গবেষক মুজিবুর রহমান মুজিবের সম্পাদনায় আকর্ষনীয় তথ্যবহুল সচিত্র স্মারক সংকলন বের হত- যা এখন হয় না। ইতিপূর্বে বড় মসজিদ না থাকার কারনে বহিরাগত মুছল্লীয়ানের এবাদত বন্দেগী ও নামাজ আদায় সম্ভব হতনা, বর্ত্তমানে জেলার বৃহত্তম ও দৃষ্টি নন্দন স্থাপনায় আকর্ষনীয় মসজিদ নির্ম্মানের পর সে অসুবিধা দূর হয়েছে। বার্ষীক ওরশ উপলক্ষে দরগা মহল্লা এলাকায় প্রায় সপ্তাহ ব্যাপী দেশীয় পন্য সামগ্রীর বিশাল মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দোকানীগন তাদের পন্য নিয়ে আসেন-পসরা বসান- ব্যবসা করেন। উরুশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত উন্নতমানের। এখানে মদ-গাঁজা-নেশাখোর-হকমাওলা কিংবা লালপট্টি ওয়ালা কোন ভন্ড পির-পীরানীর প্রাদূর্ভাব নেই। জেলা পুলিশ আন্তরিক ভাবে দিবারাত্রি দায়িত্ব পালন করেন। ওরসের সপ্তাহ খানেক আশেকানের উচ্ছল পদভার জিগির-জিয়ারতে মুখরিত-প্রকম্পিত থাকে দরগা মহল্লা এলাকা। বৃহত্তর সিলেটের ইসলামি চিন্তাবিদ-আলীম-ওলামা-মোতাওয়াল্লী ছাহেবানদের সমাবেশ-সমাহারে- এক অপূর্ব মিলন মেলা। প্রানের মেলা। আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে বার্ষীক ওরশ শরীফ এর।
পীরে কামেল হযরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা শেরে সওয়ার চাবুকমার বোগদাদী দক্ষিন শ্রীহট্ট বাসীর একজন শ্রদ্ধেও নাম। বারোমাসই দরগায় ভক্তদের আনাগুনা ও জিয়ারত হয়। এই ওলির নামে মোস্তফাপুর গ্রাম, মোস্তফাপুর ইউনিয়ন, শাহ মোস্তফা সড়ক, শাহ মোস্তফা স্কয়ার, শাহ মোস্তফা কলেজ আছে। এই ওলি আল্লাহ আছেন জেলা এলাকাবাসির অন্তরে। অনুভবে। হৃদয়ের মনি কোঠায়।
হযরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফার বার্ষীক ওরশ শরীফ উপলক্ষে এই পীরে কামেলের উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। ওরসে আগত লাখো মুরীদান-মুছল্লীয়ান- আশেকান গনকে খোশ আমদেদ। আহলান ওয়া সাহলান।
[যুগ্ন আহ্বায়ক ওরশ উদযাপন কমিটি। সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]
Related
সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”
মন্তব্য করুন