“পীরানে পীর- ইয়েমেনী বীর হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনীর ৭০০তম বার্ষীক ওরশ বার্ষিকীঃ তুমি রহমতের নদীয়াঃ দোয়া কর মোরে হযরত শাহ্ জালাল আওলিয়া ॥

July 24, 2019,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ প্রাচীনকালে সমগ্র বৃহত্তর সিলেট- ১। লাউড়, ২। গৌড়, ৩। জৈন্তিয়া, ৪। তরফ ও ৫। ইটা এই পাঁচটি প্রধান সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই পাঁচটি প্রধান সামন্ত রাজ্য ছিল উন্নত, সম্বৃদ্ধ জনপদ। গৌড় এর সামন্ত রাজা ছিলেন গোবিন্দ। গৌড় রাজ্যের রাজা হিসাবে তিনি ইতিহাসে গৌড় গোবিন্দ হিসাবে খ্যাত। তান্ত্রীক পাত্র সম্প্রদায় ভূক্ত সামন্ত শাসক গোবিন্দ অত্যাচারী ও মুসলিম বিদ্বেসী শাসক ছিলেন। দ্বাদশ শতাদীতে তুর্কীবীর ইক্তিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গঁ বিজয়ের পূর্বেও অভিভক্ত ভারত বর্ষ ও প্রাচীন আরবের সঙ্গেঁ সুফী সাধক পীর আওলিয়া আরবীয় বনিক সমাজের আসা যাওয়া ছিল। মধ্যপ্রাচ্য ও আরবীয় ইসলাম প্রচারক সংসার ত্যাগী পীর আওলিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমান ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আসেন ভারতীয় মুসলিম শাসকগণ নহেন পীর ফকির আলেম ওলামাগনই ইসলাম প্রচারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। রাজা গোবিন্দের শাসনামলে কমসংখ্যক হলেও গৌড়-এ- মুসলমানদের বসবাস ছিল। গৌড়িও মুসলিম শেখ বু রহান উদ্দিনকে অত্যাচারি গৌড় গোবিন্দের ঝুলুম নির্য্যাতনের কথা লিখিত ইতিহাসের অংশ।

সকল তথ্য, তত্ব ও বহুবিধ গ্রহ্ণ মতে ১৩০৩ সালে ইয়েমেনী বীর পীর শাহ্ জালাল ৩৬০ আউলিয়া নিয়ে গৌড় বিজয় করেন। আউলিয়া বাহিনীর সিপাহ সালার ছিলেন হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন। হবিগঞ্জের মুড়ার বন্দে এই পীরে কামেলের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী পূর্ব পশ্চিমি মাজার অবস্তিত। সিপাহ সালার সৈয়দ নাসিরুদ্দীন তান্ত্রিক রাজা গোবিন্দের তেলেসমাতি তীর ধনুকে তীর সংযোজন করে বিস্মিল্লাহ বলে আল্লাহর নামে তীর ছুড়েন। গৌড় গোবিন্দের ধারনা ছিল এই তীর ধনুক কোন তান্ত্রীক ছাড়া কেহ ব্যবহার করতে পারবেন না, আউলিয়া বাহিনীর নির্ভয় অভিযান এবং সিপাহ সালার নাসিরুদ্দীনের তীর নিক্ষেপে অত্যাচারী শাসক গৌড় গোবিন্দ ভয়ে ভীত হয়ে আত্ব গোপনে গেলেন। মুসলিম বাহিনীর আল্লাহ আকবর-আল্লাহু আকবর-আজান ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হল- গৌড় গোবিন্দের রাজ প্রাসাদ ভেঙ্গেঁ খান খান হয়ে গেল। গৌড়ে ইসলামের বিজয় নিশান পত পত করে উড়ল। অত্যাচারী গৌড় গোবিন্দের গৌড় রাজ্য হল সিলহট-শিলাহট থেকে-সিলেট, শ্রীভূমি শ্রীহট্ট। সিলেট নামের সঙ্গেঁ ও পীরানে পীর ইয়েমেনী বীর হযরত শাহ্ জালারের উজ্জল স্মৃতি-কারামতি-বিজড়িত। পাহাড়ি টিলার উপরিভাগে অবস্থান কারী রাজা গোবিন্দ টিলার নি¤œ ভাগে অবস্থানরত আউলিয়া বাহিনীর প্রতি বিশাল প্রস্তর খন্ড নিক্ষেপ করলে আধ্যত্বিক শক্তির অধিকারী পীরানে পীর শাহ জালাল ইয়েমেনী বিসমিল্লা বলে আল্লাহর নাম নিয়ে আত্ববিশ্বাসের সঙ্গেঁ উচ্চারণ করলেন-সিল্হট। মহান আল্লাহর অপার রহমত, বরকত এবং এই পীর-এ-কামেলের কারামতিতে সিল-হটেই গেল, কারো গায়ে লাগল না। পীর শাহ জালালের উচ্চারণ সীলহট-ই-পরবর্তীকালে সিলহেট-সিলেটে রূপান্তরিত হয়েছে। পূণ্য ভূমি সিলেটকে জালালাবাদ ও বলা হয়।

শাহ জালালের সিলেট বিজয় নিয়ে শত শত পুস্তক, হাজার হাজার প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সঙ্গীঁত রচিত হয়েছে, তন্মধ্যে সুরমা পারের কবি-দিলওয়ার রচিত- “তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হযরত শাহ জালাল আউলিয়া আধ্যাত্বিক সঙ্গীঁতটি কালজয়ী সঙ্গীঁত হিসাবে খ্যাত স্বীকৃত। গণ মানুষের কবি দিলওয়ার যথার্থই বলেন-

“জায়নামাজ বিছাইয়া বাবায়

সুরমা দিলা পাড়ি,

শুনিয়া রাজা গৌড় গোবিন্দের

দিশা গুলি উড়ি—————

পাপি তাপি পাইল নাজাত

তোমার দরগায় যাইয়া

তুমি রহমতের নদীয়———-।

সিলেট বিজয়ের পর হযরত শাহ্ জালালের সফর সঙ্গীঁ হযরত চাষনী পীর তাঁর সঙ্গেঁ আনা মাটির সঙ্গেঁ সিলেটের মাটির পরিক্ষা করলেন। কথা ছিল সঙ্গেঁ আনা মাটির সঙ্গে যে মাটির মিল পাওয়া যাবে সেখানেই বসতি স্থাপন ও ধর্ম প্রচার করবেন পীর শাহ জালাল। সেকালে একালের মত সয়েল সায়িন্স-মৃত্তিকা বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞ না থাকলেও আল্লাহর ওলিগণ ঐশ্বরিক-আধ্যাত্বিক ক্ষমতা ও কারামতের অধিকারি ছিলেন। পিতৃভূমি ইয়েমেনে বাল্য শিক্ষা, কোরআন, হাদিস, ফেকাহ শাস্ত্রে জ্ঞানার্জন এর পর স্বীয় পীর শাহ জালালকে দোয়া করতঃ আল্লাহ ও রাসুলের পথে উৎসর্গ করলেন, এবাত-বন্দেগী-দ্বিনী খেদমতের বয়ান দিয়ে একমুষ্টি মাটি সঙ্গেঁ দিয়ে বল্লেন এ মাটির সঙ্গেঁ যে মাটির মিল পাওয়া যাবে সেখানেই যেনো তিনি বসতি স্থাপন করেন। পীর শাহ জালাল আল্লাহর রাহে অজানার উদ্দেশ্যে বেরুবার সময় তৎকালীন ইয়েেেমনের দুই যুবরাজ দুনিয়া দারি- আগামী দিনের বাদশাহীর প্রতি অনীহা প্রকাশ করতঃ যুবরাজ থেকে আল্লাহর ফকির হতে ইচ্ছা প্রকাশ করে আউলিয়া বাহিনীর সফর সঙ্গীঁ হন। দরগায় যুবাবয়সী দুটি শিশুর মাজার আছে। জানা যায় এই দুই মাজার শাহ্ জালালের সফর সঙ্গীঁ ইয়েমেনী দুই যুবরাজের। ইয়েমেনের সিংহাসন এখন সংকটাপন্ন। গৃহযুদ্ধ-কলহ-বিবাদে বিধ্বস্থ ইয়েমেন। ইয়েমেনের যে দুই যুবরাজ সিংহাসন-দুনিয়ারি-লোভ-লালসা পরিহার করে আল্লাহর রাহে ফকির হয়ে ছিলেন, তারা পরকালেও বেহেশত বাসি হবেন- বেহেশতি বাদসা হবেন। পীর শাহ্ জালালের মাজারের পাশে চীর শয়ানে শায়িত ইয়েমেনী দুই যুবরাজ। দিবারাত্রি ফুল-খুশবু-জিয়ারত পাচ্ছেন। ইনশাল্লাহ রোজ কিয়ামেতর দিন পর্য্যন্ত তারা এ সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সম্মানিত হবেন।

মহান আল্লাহর অপার রহমত ও বরকতে আউলিয়া বাহিনীর সঙ্গেঁ আনামাটির সঙ্গেঁ সিলেটের মাটির মিল খুজে পাওয়া গেলে মহান মালিকের প্রতি শুকুর আদায় করে বিসমিল্লাহ বলে এখানেই বসতি স্থাপন করেন। অতি সাধারণ ভাবে তাঁর হুজরা স্থাপন করা হল। তাঁর সঙ্গেঁ আউলিয়া বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তিনশত ষাট জন ছিলেন বলে সিলেটকে তিনশত ষাট আউলিয়ার মুল্লক বলা হয়। যেমনি বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে বারো আউলিয়ার মুল্লুক বলা হয়। পীরানে পীরের সফর সঙ্গীঁ আউলিয়াগণ ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। সিলেটের দক্ষিনাঞ্চল আধুনিক মৌলভীবাজার এলাকায় ইসলাম প্রচারে তসরীফ আনেন হযরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা শেরে সওয়ার চাবুকমার বোগদাদী (র:)। দরগা মহল্লায় তাঁর মাজার অবস্থিত। এ ভাবে বৃহত্তর সিলেটে শাহ্ জালালের সফর সঙ্গীঁগণ ইসলাম প্রচারে আত্বনিয়োগ করেন, স্থানে স্থানে তাদের মাজার এবং ওয়ারিশগণ বিদ্যমান। শাহ পরান এলাকায় গরম পীর হিসাবে খ্যাত পীরে কামাল হযরত শাহ পরানের ঐতিহ্যবাহী মাজার অবস্থিত।

ওলি আল্লাহ হযরত শাহ্ জালাল ইয়েমেনী অত্যন্ত সাধারন জীবন যাপন করতেন, সাধারণ খাবার খেতেন, বেশির ভাগ সময় নফল রোজা রাখতেন, এবাদত বন্দেগীতে দিন কাটাতেন। মহান আল্লাহর বানী, রাসুলের জীবন দর্শন এবং পীর শাহ্ জালালের শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ ও বিনয়াচরনে বিমুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোকজন ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হন। ক্রমশ ইসলাম ধর্মের প্রচার প্রসার ঘটতে থাকে। ইসলামের সুশীতল ছায়তলে আশ্রয় নিয়ে সাধারণ জনগন একটি ইসলামী আদর্শ সমাজ গঠনে আত্ব নিয়োগ করেন।

হযরত শাহ্ জালালের সঙ্গেঁ আনা মাটির সঙ্গেঁ গৌড় গোবিন্দের- গৌড়- এর মাটির মিল খুঁজে পাওয়ায় এই মাটি মানুষ ও এলাকার আলাদা বৈশিষ্ট, স্বতন্ত্র স্বকীয়তা বিদ্যমান। শাহ জালাল, বীর শাহ জালাল দরগা মহল্লা এলাকায় চীর শয়ানে শায়িত। শাহ জালালের মাজার,ঝর্ণা, ডেগ, তরবারি, খড়ম দরগা মহল্লায় বিদ্যমান। সিলেট, শাহ জালালের সিলেট- দেশের আধ্যাত্বিক রাজধানী। ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞানে সিলেটের একটি আলাদা মর্য্যদা, স্বতন্ত্র স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট বিদ্যমান। দেশ-বিদেশে শাহ জালালের সিলেটি গণ সহজ সরল বন্ধু বৎসল অতিথি পরায়ন। সিলেটের সাম্প্রদায়ীক সম্প্রতি সমুজ্জল। একাত্তোরের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও বৃহত্তর সিলেট বাসির ভূমিকা গৌরবোজ্জল। গৌরবময়।

সমাজ সভ্যতার বিকাশ বিস্তৃতি অগ্রগতিতে সংসার ত্যাগী পীর ফকির দরবেশ ওলি আল্লাহগণ আল্লাহ ও রাসুল প্রেমে ফানাফিল্লাহ হয়ে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে ইসলাম প্রচার করেছেন-নগর জনপদ গড়ে তুলেছেন। সেকালে যোগাযোগ, নগর সভ্যতা ছিল না, জঙ্গঁলাকীন মুনুষ্যবিহীন বিরান ভূমিতে সংসার ত্যাগী পীর ফকিরগণ এর উছিলায় সেখানেই জনবসতি ও নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছে। ওলি আল্লাহদের ইন্তিকালের পর তাঁরা সেখানেই সমাহিত হয়েছেন, সেখানেই মাজার হয়েছে। তাঁদের ইসালে সওয়াব- ওফাত বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ওয়াজ-নসিহত-জিখির আজগার মিলাদ মাহফিল শিরনী সালাতের আয়োজন করা হয়, মাজার জিয়ারত দোয়া দূরুদ হয়, মাজারকে কেন্দ্র করে মসজিদ মাদ্রাসা এবাদত গৃহ মুসাফিরের খানা গড়ে উঠে। উপমহাদেশে গরীবে নওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির মাজার, হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া, হযরত কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকি, হযরত আলী ওসমান হুজাভিরি, হযরত আমানত শাহর মাজার, হযরত খান  জাহান আলীর মাজার, এ ওলি আল্লাহ গণের বার্ষীক ওরশ মোবারকে এবাদত বন্দেগী হয়। লক্ষ্য লক্ষ্য মুসল্লির সমাগম হয়।

পিরানে পীর ইয়েমেনী বীর হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনীর ৭০০তম বার্ষীক ওরশ শরীফ মহা সমারোহ, জাক জমক ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সিল সিলাহ মোতাবেক দুই দিন ব্যাপী আয়োজন করা হয়, তেইশ, চব্বিশে জুলাই। দ্বিতীয় দিন মহা আয়োজন- বার্ষীক ওরশ মোবারক এর সু-সমাপ্তি ঘটে। দেশ-বিদেশ থেকে লাখো-লাখো মুসল্লি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আগমনে অর্ধসপ্তাহ ব্যাপী শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংঙ্খল জন সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল সিলেট নগরী। আয়োজন অভ্যর্থনা-আপ্যায়নে ওরশ উদ্যাপন কমিটি ছিল আন্তরিক নিশ্চিদ্র নিরাপদ নিরাপত্তায় আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী ছিলেন আন্তরিক সদা প্রস্তুত। সিলেট সিটি কর্পোরেশন ও সেবা দিয়েছেন, সবিনয়ে। গঞ্জি কাসেবী-লাল প্রট্টিওয়ালা পট্টি ওয়ালি ভন্ড পীর পীরানীর প্রাদূর্ভাব মুক্ত ছহিহ-ইসলামীর তরিকা মোতাবেক কতেক দেশীয় সংকটের মাঝেও এমন আয়োজনের জন্য দরগা কতৃপক্ষ এন্তেজামিয়া কমিটি, প্রশাসন, আইন শৃংঙ্খলা রক্ষা কারি বাহিনীকে আন্তরিক মোবারকবাদ। পীর শাহ জালাল বীর শাহ জালালের উজ্জল স্মৃতির প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। এই ওরশ বাষিকীতে আমাদের মোনাজাত কবি দিলওয়ারের ভাষায়- “তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হযরত শাহ্ জালাল আউলিয়া।”

(সেক্রেটারি মৌলভীবাজার জেলা মসজিদ। সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট।)

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com