প্রকাশনা জগতে সফল প্রকাশক শ্রীমঙ্গলের জহিরুল আবেদীন জুয়েল

July 18, 2016,

শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি॥‘ইত্যাদি’ একটি লিটল ম্যাগাজিন। আর এই লিটল ম্যাগাজিন থেকেই জন্ম আজকের দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ-এর। বছরে মাত্র ২/৩ ফরমার একটি ম্যাগাজিন, যার ধারাবাহিকতায় এখন শত শত ফরমার শত শত বই। কিন্তু কীভাবে? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো উদ্যোগী সৃষ্টিশীল কারো হাত রয়েছে? আর আমরা যারা কৌতুহলী জনতা বা জানতে আগ্রহী, তাদের সামনে এই উদ্যোগী মানুষটিকে তুলে ধরা প্রয়োজন। তাই এই মানুষটিকে নিয়ে পাঠককুলে কিছুক্ষণ বিচরণ মাত্র। যিনি এই কাহিনী বা বাস্তব গল্পের নায়ক তার পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই আমি বলতে পারি তিনি আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দ্বিতীয় পরিচয় একজন কলমযোদ্ধা, একজন মানবপ্রেমী সত্যভাষী আবেগপ্রবণ মানুষ। যার নাম জহিরুল আবেদীন জুয়েল। আরো একটু বিশেষায়িত করলে নিঃসন্দেহে বলতে পারি তিনি একাধারে একজন দক্ষ সংগঠক, সামাজসেবী ও প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব। আর বর্তমানে দেশের একজন খ্যাতনামা প্রকাশক।
স্মৃতি মন্থনে জুয়েলের পূর্বকথা হলো তিনি ছিলেন অধুনালুপ্ত বাংলার বাণীর সাংবাদিক। জন্মসূত্রে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক পরিবেশের অঞ্চল শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা। কাজ করতেন পাহাড় আর চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে। বাংলার বাণীতে কাজ করার সময় অনেক বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়ে গেল তার ঢাকায়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝিতে বের করেন একটি লিটল ম্যাগাজিন ‘ইত্যাদি’। শ্রীমঙ্গল থেকে এটির যাত্রা শুরু হলেও তা একসময় ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায় এবং ঢাকা থেকে সারা দেশে। মফস্বলে সাংবাদিকতা করে অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সর্বদাই অন্ধকারাছন্ন। এ বিষয়টি তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই জীবনের সন্ধানে বের হয়ে পড়েন ঘর ছেড়ে। ২০০০ সালের প্রথম দিকে জুয়েল ঢাকায় যান, চাকরি নেন বনানীর একটি রিক্রুটিং এজেন্সিতে। কিন্তু চাকরিতে মন বসাতে পারেন না। একবার যারা সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত হয়ে পড়েন চাকরিতে তাদের মন বসার কথাও নয়। আর জুয়েলের ক্ষেত্রেও তাই হলো। সারাক্ষণই সৃষ্টিশীলতা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার লিটল ম্যাগাজিনে সারা দেশ থেকেই লেখকরা লেখা পাঠাতেন। সখ্যতা গড়ে ওঠে লেখকদের সাথে। সাংবাদিকতা করার সময় ভাবনা ছিল লেখালেখির জগৎ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হবেন না, হনওনি। এখনো লেখালেখির মাঝেই আছেন, নিজে হয়ত এখন লেখায় মনোযোগ দিতে পারছেন না, তবে অনেককে দিয়ে লেখাচ্ছেন এবং প্রকাশও করছেন। এভাবেই এই সময়ের একজন সফল প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েলের যাত্রা শুরু।
চাকরি করলেও ‘ইত্যাদি’র প্রকাশনা কিন্তু বন্ধ করেননি। ঢাকার বাংলাবাজারের একটি প্রেস থেকে লিটলম্যাগটি ছাপা হয়। লেখালেখির সূত্রেই পরিচয় বন্ধু আদিত্য অন্তরের সাথে। আদিত্যও একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করতেন। বাংলাবাজারে সস্তায় ছাপা যায়, তাই আদিত্যের ‘নবযাত্রা’ নামের লিটল ম্যাগাজিনটিও বাংলাবাজার থেকে ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন জুয়েল। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? চাকরি যে আর ভালো লাগছে না তার। বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে জানালেন, তিনি আর চাকরি করবেন না, ব্যবসা করবেন। তাও কীনা যৌথভাবে বন্ধু আদিত্য অন্তর-কে নিয়ে। কিন্তু বাবা-মা তাতে সম্মতি দেয় না। তাদের এক কথা, ‘হয় চাকরি কর, নয় চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আস, কিন্তু ব্যবসা করার নামে টাকা নষ্ট করা চলবে না।’ বন্ধু আদিত্যের বাবা-মারও সম্মতি নেই ব্যবসার ব্যাপারে।
অনেকটা বিষাদক্লিষ্ট মনে দুই বন্ধু বাড়ি থেকে চলে আসেন ঢাকায়। আগ-পিছু না ভেবে, বিকল্প কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে চাকরি ছেড়ে দিলেন জুয়েল। চাকরি তো ছেড়ে দিলেন, কিন্তু কী করবেন এখন! সারাদিন বাংলাবাজারে আড্ডা দেন, রাতে মামা (আজিজুর রহমান)-এর বাসায় এসে ঘুমান। এ ছাড়া আর কাজ নেই। এভাবেই চলছে তাদের দুজনের দিন।
বাংলাবাজারে আড্ডা দিতে দিতে সিদ্ধান্ত হয় দুজনে মিলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। ২০০৩-এর আগস্ট। মৌলভীবাজার থেকে এক লেখক এলেন একটি পা-ুলিপি নিয়ে। পরামর্শ চাইলেন, তার পা-ুলিপিটি বই আকারে কীভাবে বের করা যায়। আদিত্যের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, বইটি তারাই বের করবেন। সেদিন রাতেই মৌলভীবাজারের আরেক কবি মুজাহিদ আহমদের উপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক হলো তার লিটলম্যাগের নামেÑইত্যাদি প্রকাশন। স্লোগানও ঠিক করা হলো, ‘আপনার সন্তানের হাতে বই তুলে দিন, সে বিকশিত হবে ফুলের মতো সৌরভ নিয়ে।’ প্রথম বইটিতে প্রকাশনার নাম ছিল ‘ইত্যাদি প্রকাশন’। কিন্তু পরবর্তীতে এ নাম পরিবর্তন করে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ রাখা হয়। সেই থেকেই শুরু ইত্যাদির পথচলা।
দেশের প্রকাশনা শিল্পে যে কটি প্রতিষ্ঠান সুনাম কুড়িয়েছে তার মধ্যে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ অন্যতম। বেশ অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠানটি সৃজনশীল প্রকাশনায় যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত বিরল। ইতোমধ্যে এ প্রকাশনা সংস্থা থেকে দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, ঔপনাসিক এবং বরেণ্য বহু লেখকদের বই প্রকাশ হয়েছে।
জুয়েল জানান, এখন তার একটাই লক্ষ্য, বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতে নতুনমাত্রা যোগ করে লেখক-প্রকাশকদের সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হাতে মানসম্মত সৃজনশীল ও মননশীল বই তুলে দেওয়া। এ ধারাবাহিকতায় তিনি নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে এ পর্যন্ত সাত শতাধিক বই প্রকাশ করেছেন। উল্লেখযোগ্য লেখকদের মধ্যেÑ সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, নির্মল সেন, রিজিয়া রহমান, আলী যাকের, বেলাল চৌধুরী, যতীন সরকার, সুলতানা কামাল, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মিহিরকান্তি চৌধুরী, বেগম মুশতারী শফী, কামাল লোহানী, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, মোহাম্মদ রফিক, ওমর আলী, হায়াৎ মামুদ, দেবদাস ভট্টাচার্য্য, ইসহাক কাজল, রব্বানী চৌধুরী, অপূর্ব শর্মা, শেখ ফজলে এলাহীসহ অগণিত লেখকের।
২০০৩ থেকে ২০১৬ খ্রি. মাত্র ১৪ বছরে নানা ধরনের প্রকাশনার জন্য তার অর্জনও অনেক। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০০৯ সালে সেরা মানের গ্রন্থ সম্মাননা এবং ২০১১ সালে সর্বাধিক মানসম্মত গ্রন্থ প্রকাশের জন্য শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, ২০১৫ সালে বাঙলার পাঠশালা কর্তৃক বাঙলার পাঠশালা সম্মননা এবং বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার ২০১৩ উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বই তিন বার এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার, একবার করে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ও জেমকন সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিত অংশগ্রহণ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত বইমেলাতেও রয়েছে ইত্যাদি’র অংশগ্রহণ।
দেশের বাইরে ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে তিনবার আমেরিকার নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব এবং ২০১২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। ২০১৫ সালে আগরতলা (ভারত) বইমেলাতেও অংশগ্রহণ করেন। এভাবেই উপরের সিঁড়ির দিকে চলছে জুয়েলের ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।
জুয়েল সাংবাদিকতা করার সময়ে দৈনিক প্রভাত, দৈনিক আজকের আওয়াজ, দৈনিক যায়যায়দিন প্রতিদিন, বাংলার বাণী পত্রিকায় শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয় দৈনিক, সাপ্তাহিকেও নিয়মিত লিখতেন। সেসময় সাংবাদিক সমিতি শ্রীমঙ্গল ইউনিটের দপ্তর সম্পাদক (১৯৯৯-২০০১) এবং শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি দমন সম্মিলিত ছাত্র সংগঠন, সাতগাঁও, শ্রীমঙ্গল-এর আইন সম্পাদক এবং বাংলাদেশ উদীয়মান লেখক ও কবি কল্যাণ পরিষদ-এর সাংগঠনিক সম্পাদকেরও দ্বায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (বাপুস)-এর একজন সদস্য।
জহিরুল আবেদীন জুয়েল-এর জন্ম শ্রীমঙ্গলের জামসী গ্রামে ১৯৭৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর। তার বাবার নাম জয়নাল আবেদীন, মায়ের নাম সুরজাহান বেগম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত। তার স্ত্রীর নাম জুলেখা আক্তার জুলি ও তাদের একমাত্র ছেলে মিনহাজুল আবেদীন সিয়াম। এখনও তার সময় কাটে বই পড়ে ও গান শুনে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com