প্রসঙ্গ : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ চালু করার চিন্তাভাবনা ভাবিয়া করিও কাজ 

May 11, 2020,

সায়েক আহমদ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে আগামী ৩০ মে এর পর নাকি সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠদান কার্যক্রম চালু হবে। এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর মানতে হবে ১৭ টি নির্দেশনা। যদি সত্যি সত্যি সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে খুব দ্রুত নির্দেশনাসমূহ প্রজ্ঞাপন আকারে চলে আসবে।

ইতোমধ্যে আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোতে দিন দিন করোনার প্রকোপ মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পাবার সংবাদ আমরা জানতে পেরেছি। আমাদের দেশেও কভিড-১৯ এর করাল গ্রাসে প্রথম ১০০ জন মৃত্যুবরণ করতে যে সময় লেগেছে, দ্বিতীয় ১০০ জন মৃত্যুবরণ করতে কিন্তু স্বল্প সময় লেগেছে। কাজেই আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে করোনা কি আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হচ্ছে, নাকি আরো ভয়ংকর রূপধারণ করে আবির্ভূত হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা যখন মহামারী আকারে আঘাত হেনেছে, তখন কিন্তু তাদের আবহাওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে। আমাদের দেশে যখন করোনা ক্ষুদ্র আকারে হুংকার প্রদান করেছে, তখন কিন্তু আমাদের গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে গেছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, করোনা আমাদের দেশে মহামারী রূপে দেখা দেয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আসলে আগামী আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে যখন শীত ঋতুর আগমন হবে তখনই করোনা তার আসল রূপ আমাদেরকে দর্শন করাবে।

সরকার বাধ্য হয়ে পর্যায়ক্রমে শপিংমল সীমিত আকারে খুলে দিয়েছে। মসজিদেও নির্দেশনা মেনে জামায়াতে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছে। সীমিত আকারে পরিবহনও চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা আর অন্য কিছু চালু করার মধ্যে রাতদিন পার্থক্য আছে।

সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের পাঠদান কার্যক্রম চালু করবে। কিন্তু এ ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে আমাদেরকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে অনেক কিছু। এরপরও যদি মনে হয় পাঠদান কার্যক্রম চালু করা জরুরী, তাহলে না হয় সিদ্ধান্ত নেয়াই যেতে পারে।

এবার আমরা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনুকূল ও প্রতিকুল বিষয়সমূহ একটু পর্যবেক্ষণ করি –

১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশিত মহামারী প্রতিরোধক মাস্ক, জীবাণুনাশক এবং নন-কন্ট্যাক্ট থার্মোমিটার সংগ্রহ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ তার প্রয়োগ বাস্তবায়ন করতে পারবে। পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণও জোরদার করতে পারবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই এসব ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব।

২. শিক্ষক, শিক্ষাদান কর্মী ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ জোরদার করা সম্ভব। কিন্তু সকাল ও দুপুরে পরীক্ষার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর নয়। কারণ এসব প্রক্রিয়া এবং পাঠদান প্রক্রিয়া একসাথে সামাল দেয়া মুখে বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবে অত্যন্ত কঠিন।

৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষার্থী এবং বহিরাগত শিক্ষাদান কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা নেয়া সম্ভব। যাদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি পাওয়া যাবে, তাদেরকে প্রবেশ করতে না দিলেই চলে। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে একাধিক সংখ্যা পরিলক্ষিত হলে প্রতিদিনের নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম অবশ্যই ব্যাহত হবে।

৪. শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ এবং পাঠাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বায়ুচলাচল ব্যবস্থা শক্তিশালী করা সম্ভব। কারণ বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বায়ু চলাচল ব্যবস্থা শক্তিশালী আছে। কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা বাংলাদেশে খুবই কম সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছে।

৫. শ্রেণিকক্ষ, সর্বসাধারণ কর্তৃক ব্যবহৃত হয় এমন জায়গাসহ অন্যান্য জায়গার মেঝে ও ঘরের দরজার হাতল, সিঁড়ির হাতল এবং যেসব বস্তু বারবার ব্যবহৃত হয়, সেসব বস্তুরর তলপৃষ্ঠ ঘন ঘন পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাতে গোণা ২/৩ জনের বেশি কর্মচারীই নেই।

৬. খাবার থালাবাসন (পানির পাত্র) পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা এবং প্রতিবার পরিবেশনের পরে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য খাবার থালাবাসন জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মিড ডে মিল তিন স্তরে চালু আছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিজ নিজ বাসা থেকে টিফিন বক্সে করে তাদের খাবার নিয়ে আসে। কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিদ্যালয় থেকেই খাবার সরবরাহ করা হয়। তবে শিক্ষার্থীরা বাইরের খাবারের প্রতি মারাত্মক নেশাগ্রস্ত। এ কার্যটি বন্ধ করাও এক কথায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ শত-শত কিংবা হাজার-হাজার শিক্ষার্থী অধ্যূষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ এদেরকে টিফিন আওয়ারে নিয়ন্ত্রণ করতেই পারে না।

৭. দূরে দূরে বসে খাবার গ্রহণ এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব থালাবাসন বা ওয়ানটাইম থালা বাসন ব্যবহার করা সম্ভব। কারণ শিক্ষার্থীরা বাড়ি খাবার নিয়েই আসুক কিংবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মিড ডে মিল সরবরাহ করা হলে এ ব্যবস্থাটি অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হয়।

৮. প্রতিদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরের আবর্জনা পরিষ্কার এবং আবর্জনা সংরক্ষণকারী পাত্র জীবাণুমুক্ত করার কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ স্ব স্ব উদ্যোগে এমনিতেই গ্রহণ করবে। এটা অবশ্যই একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

৯. অফিস কার্যালয়ে কাগজের ব্যবহার সীমিতই থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে হোম ওয়ার্ক, ক্লাস টেস্ট, সাপ্তাহিক পরীক্ষা কিংবা সাময়িক ও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষাসমূহে কাগজের ব্যবহার সীমিত করা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ এসব কাজে কাগজ ব্যবহৃত হবেই। তবে শিক্ষাদান কর্মীদের পারস্পরিক শারীরিক যোগাযোগ কমানো সম্ভব নয়। কারণ এখনো বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শ্রেণিকক্ষ এবং ডেস্ক-বেঞ্চের অপ্রতুলতা রয়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জায়গা না থাকায় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়েই ক্লাস করে। তবে দূরবর্তী বা অনলাইন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া সম্ভব। কারণ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এখন গ্রামগঞ্জের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহও ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার আওতায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

১০. স্বাভাবিক অবস্থা না আসা পর্যন্ত কোনও প্রকার অভ্যন্তরীণ জমায়েত বা ক্রিয়াকলাপের আয়োজন না করার প্রসঙ্গটা হাস্যকর। কারণ বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষই বিশাল জমায়েতের একটি প্রধান ক্ষেত্র। কারণ শ্রেণিকক্ষগুলোতে ঠাঁই ধারণের জায়গাই তো থাকে না। আর এসব ক্ষেত্রে এক মিটারের কম বা সমান দূরত্ব বজায় রাখা শুধু হাস্যকরই নয়, অসম্ভব ব্যাপার।

১১. শিক্ষক, শিক্ষাদান কর্মী এবং শিক্ষার্থীদের বহির্গমন কমিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু শতভাগ কার্যকর করা সম্ভব নয়।

১২. শিক্ষাদান কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীরা মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়াসহ অন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে এসব কর্মসূচি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। শুধুমাত্র মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাসটা এখনো শতভাগ গড়ে ওঠেনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাসায় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্রুত হাত শুকানো জীবাণুনাশক বা জীবাণুনাশক টিস্যু ব্যবহার করার অভ্যাস ইতোমধ্যেই রপ্ত করে ফেলেছে। হাঁচি দেয়ার সময় মুখ এবং নাক ঢাকতে টিস্যু বা কনুই ব্যবহার করার অভ্যাসটাও সবার মধ্যে গড়ে ওঠেছে।

১৩. মহামারী প্রতিরোধকে জোরদার করা হয়েছে, এটা অবশ্যই সবাইকে স্বীকার করতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষাদানকর্মী ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের সময় নিয়ন্ত্রণ করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাস্তবায়িত হয়েছে।

১৪. শিক্ষক, শিক্ষাদানকর্মী বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোভিড-১৯ এর সন্দেহভাজন কোনও কেস থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে জানানো এবং যারা এই কেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের দ্রুত শনাক্ত ও কোয়ারেন্টাইন করার ব্যবস্থা ইতোমধ্যে দেশব্যাপী বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসুস্থতার তথ্য গোপন করা কিংবা স্থানীয় অতি উৎসাহী তরুণ-যুবকদের এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করাটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৫. কোয়ারেন্টাইনে অবস্থানরত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী বা শিক্ষার্থীদের পিতামাতার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানা এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করার জন্য একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারী যদি কোয়ারেন্টাইনে চলে যান তাহলে শ্ক্ষিা প্রতিষ্ঠানগুলো চলবে কি করে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অধ্যয়ন করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ১০/১২ জনের বেশি শিক্ষকই নেই। এত স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ৮/১০ অসুস্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাহলে পাঠদান কার্যক্রম চালানো কীভাবে সম্ভবপর?

১৬. কোনও নিশ্চিত কোভিড-১৯ কেস পাওয়া প্রসঙ্গে যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, তার কোন প্রয়োজনীয়তাই থাকবে না। কারণ একজন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পরদিন থেকেই শতভাগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আসবেই না। এক্ষেত্রে সরকারী কঠোরতাও কোন কাজে আসবে না। কারণ করোনাতংক সব কিছ্রুই উর্ধে।

১৭. যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা মাদ্রাসায় হোস্টেল আছে, সেক্ষেত্রে একত্রে বসে খাওয়ার মতো ডাইনিং পরিবেশ বন্ধ রাখা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনাসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে পরিলক্ষিত হয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এসব নির্দেশনা মেনে চলা খুবই কঠিন। তবে একটি পজিটিভ বিষয় হচ্ছে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালুকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ কার্যটি বাস্তবায়ন করা খুবই সহজ। সরকার সারাদেশকে ডিজিটালাইজেশন করতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকেও এর আওতায় সহজেই আনা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষকদেরকেও বারবার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন দেশের অধিকাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে পিসি, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এখন আর কাল্পনিক কোন বিষয় নয়। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ সরাসরি চালু না করে অনলাইন ক্লাস ব্যাপকভাবে চালু করার ব্যাপারে উৎসাহিত এবং সহযোগিতা করলেই বরং শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। মনে রাখতে হবে স্কুলগুলোতে ১ম সাময়িক পরীক্ষা, ২য় সাময়িক পরীক্ষা, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাসমূহ রয়ে গেছে। সাধারণত এসব পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার প্রায় শতভাগ থাকবেই। কাজেই করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হবার বিষয়টি অবশ্যই আতংকজনক এবং উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

এবার আসা যাক করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা বিভাগ কি কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা পর্যবেক্ষণ করা যাক।

সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস মহামারী রূপধারণ করায় বাংলাদেশেও এর ঢেউ ভয়াবহভাবে আঘাত করেছে। বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবকবৃন্দ, শিক্ষার্থীগণ হতভম্ব। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রশাসন ও সংস্থাপন শাখা থেকে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। উক্ত ছুটিকালীন সময়ে জনসাধারণ ও সকল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশমালা কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। আরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে সাধারণ ছুটিকালীন সময়ে কোন অবস্থাতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলা রাখা যাবে না। আরেকটি প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে শিক্ষকণ্ডলীকে প্রশাসনের উদ্যোগে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় গৃহীত সকল কর্মসূচিতে সহায়তা করতে হবে। এছাড়া সারাদেশে কৃষকদেরকে সাধ্যমত সহযোগিতার করার জন্যও শিক্ষকণ্ডলীকে অনুরোধ করা হয়েছে।

সারাদেশের শিক্ষকগণের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন শিক্ষকগণ সেভাবেই চলছেন। তারা সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয়ের অনুরোধে সারাদেশে শিক্ষকবৃন্দ ধান কাটায় সহযোগিতাসহ কৃষকদের পাশেও এসে দাঁড়িয়েছেন। একদিনের বেতন কর্তন করে করোনা মোকাবেলা তহবিলে অর্থ প্রদানও করেছেন। এছাড়াও শিক্ষকদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা নিজেরাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সারাদেশে অসহায় ও গরীব প্রতিবেশিদেরকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করে সরকারকে সহযোগিতা করছেন। প্রতিটি কর্মসূচিতে শিক্ষকবৃন্দকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেই দেখা গেছে।

সংসদ টিভিতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশের স্বনামধন্য শিক্ষকবৃন্দের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস রেকর্ডিং করে তা প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া একটি দুঃসাধ্য কাজ। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে এ বিশাল উদ্যোগ গ্রহণ করে সাফল্যের সাথে তা বাস্তবায়নও করেছেন। এছাড়া টিভিতে লাইভ ক্লাসসহ শিক্ষার্থীবৃন্দের পড়াশোনা সংক্রান্ত সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকদের কাজ শুধু শিক্ষাদান করাই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মত কঠিন দায়িত্বও শিক্ষকবৃন্দ আন্তরিকতার সাথে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বৈশ্বিক এ মহামারীর কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হচ্ছে স্বেচ্ছায় গৃহে অন্তরীণ থেকে ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সহায়তা করা। দেশের সিংহভাগ জনগণ তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলায় বাংলাদেশে মহামারীটি আশংকাজনকভাবে এখনো বিস্তারলাভ করেনি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিশাল সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠি অধ্যূষিত দেশে তা কল্পনাও করা যায় না। তারপরও জনগণের সচেতনতায় বাংলাদেশ সে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। সারাবিশ্বে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ স্বল্প সময়ে প্রাণ হারালেও বাংলাদেশে এখনো সে অবস্থা মোকাবেলা করতে হচ্ছে না। বিচ্ছিন্ন কিছু দৃষ্টান্ত ছাড়া এটাকে বিরাট সাফল্য বলাটাই সমীচিন হবে।

এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও শিক্ষকবৃন্দ কিন্তু ঘরে বসে নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ শিক্ষাই হোক সকল বিভাগের শিক্ষকগণই স্ব স্ব উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যাতে ব্যাহত না হয় সে প্রচেষ্টাই সার্বক্ষণিক করে যাচ্ছেন।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরী, মাদ্রাসা কিংবা  উচ্চ শিক্ষাই হোক, সকল বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের ভূমিকাও এখানে লক্ষণীয়। সবাই নিজ নিজ দূরদর্শী চিন্তাভাবনায় প্রতিনিয়ত শিক্ষা বিভাগে গঠনমূলক নির্দেশনা প্রদান করে যাচ্ছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না। এর মধ্যে একটি নির্দেশনা হচ্ছে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারাদেশকে অল্প সময়ের মধ্যেই ডিজিটালাইজেশন করতে সক্ষম হয়েছেন। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহও এ ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম হতে বাদ পড়েনি। জনগণও বাদ যায়নি। এর অভূতপূর্ব সাফল্য এখন দৃশ্যমান। সারাদেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সকল বিভাগের শিক্ষকগণই এখন স্ব স্ব উদ্যোগে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। কোথাও বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কোথাও বা নিজ নিজ উদ্যোগে এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও প্রতিনিয়ত লাইভ ক্লাস গ্রহণ করে শিক্ষকগণ বিস্ময়কর সাফল্যও অর্জন করেছেন। হয়ত করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় জাতীয় পত্রিকাসমূহ হাতে না পাওয়ায় এ অভূতপূর্ব সাফল্যের সংবাদ সবাই জানতেও পারছে না।

সাফল্যের মধ্যেও কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে হয়ত কেউ নিজস্ব উর্বর মস্তিষ্কের অদ্ভুত অদ্ভুত সিদ্ধান্তে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করে থাকেন। এরকম একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে জানা যায়। ইতোমধ্যে অনলাইন পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচরে এসেছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (নজরুল ইসলা রনি) ও এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার একজন ইউএনও এর এরকম একটি ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্তে শিক্ষকসমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ইউএনও মহোদয়া হয়ত ভেবেছেন শিক্ষকরা মহানন্দে বাড়িতে বসে আছেন, বাড়িতে বসে বসেই বেতন পাচ্ছেন, ফাঁকিবাজি করছেন। তাই তিনি শিক্ষকগণকে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রশ্নপত্র দিয়ে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। পরীক্ষা গ্রহণের জন্য আদেশ দিয়েছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কীভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেন? সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষকগণ কীভাবে বাড়ি হতে বের হবেন? তারা কি নিজেরা করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হবেন নাকি শিক্ষার্থীদেরকে সংক্রমিত করবেন? যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে অবশ্যই সরকারি নির্দেশনা মেনে নির্দেশ প্রদান করতে হবে। আশা করি ইউএনও মহোদয়া বিষয়টি উপলব্ধি করে নিজের ভুলটি বুঝতে পারবেন এবং তা দ্রুত সংশোধন করবেন। শিক্ষার্থীদের উপকার করতে গিয়ে কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ করা যাবে না।

ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে একটি গল্প আছে। সে গল্পটির সারমর্ম হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মনে করে পাকস্থলী কোন কাজ না করে বসে বসে খায়। অথচ তারা কত কষ্ট করে খাদ্য সংগ্রহের কাজটি করে থাকে। চোখ দুটো খাদ্যের সন্ধান দেয়, পা দুটো খাদ্য সংগ্রহে অবদান রাখে, হাতদুটো খাদ্য খেতে সহযোগিতা করে, জিহ্বা স্বাদ গ্রহণের মত গুরুত্বপুর্ণ কাজ করে, দাঁতগুলো সে খাবার চর্বিত চর্বন করে পাকস্থলীতে প্রেরণ করে আর পাকস্থলী মহানন্দে তা খেতেই থাকে। অবশেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল পাকস্থলীকে আর খাবার দেয়া যাবে না। সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলে দেখা যায় পাকস্থলী দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সাথে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে সবার উপলব্ধি হল আসলে পাকস্থলী তো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করছে। অথচ বেঁচে থাকার জন্য তারা শুধু যোগান দেয়ার মত স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ কাজই করছে।

শিক্ষা বিভাগ বিপর্যস্ত হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীবৃন্দ পথভ্রষ্ট হয়ে দেশকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যাবে। কাজেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই সচল রাখতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী এবং তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এখন পর্যন্ত শিক্ষা বিভাগ সঠিক পথেই চলছে। অগ্রপথিকের সার্থক ভূমিকা রাখছে। এর চেয়ে যদি আর কোন উন্নত চিন্তাভাবনা থাকে তাহলে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। নয়তো নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। কাজেই হুট করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করার নামে এমন কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়, যাতে করে সারাদেশই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

তথ্য প্রযুক্তির স্বর্ণযুগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব, অনলাইনে পরীক্ষাগ্রহণও সম্ভব। কাজেই সরকারকে এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা বিভাগকেও দ্রুত উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আশংকামুক্ত করার লক্ষে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক। ০১৭১২-৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com