প্রাণিদের প্রতি ভালোবাসা
সায়েকা আহমদ॥ তোমাদের মধ্যে যাদের পশুপাখির প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা আছে, মানুষ হিসেবে তারা একটু অন্যরকম বলে আমি মনে করি। আমিও পশুপাখি ভালবাসি। পশুদের মধ্যে হরিণ এবং ঘোড়া আমার খুবই পছন্দ। হরিণের চোখগুলো খুব সুন্দর। হরিণের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। কয়েক বছর আগে আমার পাপা আমাদেরকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমার মা অসুস্থ ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, আমার মাকে ডাক্তার দেখাবেন। সময় ও সুযোগে আমাদেরকে নিয়েও ঘুরে বেড়াবেন। তখন আমি বেশ ছোট ছিলাম। স্কুলেও ভর্তি হইনি। আমরা সেবার লামিয়া ফুফিদের বাসায় উঠেছিলাম।
আম্মুকে ডাক্তার দেখানো হল। ডাক্তার সাহেব অনেকগুলো টেস্ট করার জন্য প্রেসক্রিপশনে লিখে দিলেন। সবগুলো টেস্ট করানো হল। রিপোর্ট পাওয়ার আগে একদিন অবসর পাওয়া গেল। মা অসুস্থ থাকায় পাপা আমাকে এবং আমার মাহদি ভাইয়াকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে হরিণের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। পাপা আমাদের ছবি তুলছিলেন। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার হাতের আঙ্গুল কে যেন জিহ্বা দিয়ে চাটছে। আমি চমকে উঠলাম। চেয়ে দেখি একটি হরিণ আমার আঙ্গুল খেয়ে ফেলছে। ভয় পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি আঙ্গুল সরিয়ে ফেললাম। এ দৃশ্য দেখে মাহদি ভাইয়া হাসতে লাগলো। আমি খুব লজ্জা পেলাম।
আমার অনেক শখ ঘোড়ার পিঠে চড়ব। কারণ আমার পাপার একটি ছবি দেখেছিলাম। সেখানে পাপা ঘোড়ার পিঠে বসেছিলেন। কিন্তু ঘোড়া পাবো কোথায়? পাপাকে বললাম একটি ঘোড়া কিনে ফেলার জন্য। কিন্তু পাপা বললেন, ঘোড়ার নাকি অনেক দাম। ঘোড়া কেনা সম্ভব নয়। আর ঘোড়া লালনপালন করা নাকি আরোও কঠিন। কি আর করা? তবে আমার শখ মেটানোর জন্য পাপা আমাকে ঘোড়ার গাড়ি চড়িয়েছিলেন। সেবার আমরা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে গুলিস্তান থেকে চকবাজার গিয়েছিলাম।
এবার আসা যাক পাখিদের প্রসঙ্গে। কারণ মোরগ মুরগীকে তো আর পশু বলা যায় না। আমার একটি সাদা মুরগী ছিল। আমি তার নাম দিয়েছিলাম ‘আ-য়া’। ‘আ-য়া’ বলে ডাকলেই মুরগীটি দৌড়ে আমার কাছে চলে আসতো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ‘আ-য়া’কে ভাত এবং চাল খাওয়াতাম। অবশ্য এজন্য আমার মা আমাকে খুব বকা দিতেন। কিন্তু তিনি তো আর জানতেন না যে, ‘আ-য়া’ আমার হাত থেকে খাবার খেতো। খাবার খাওয়ার সময় সে আমাকে মোটেও ভয় পেতো না। গত আগস্ট মাসের ১০ তারিখ ‘আ-য়া’ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো। মা বললেন সে আর বাঁচবে না। তাকে জবাই করে ফেলতে হবে। একথা শোনে আমার খুব কান্না পেল। আমি কিছুতেই তাকে জবাই করতে দেবো না। আমার মা অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমি ‘আ-য়া’কে সব সময় আগলে রাখায় তিনি আর তাকে জবাই করতে পারলেন না। কিন্তু তারপরও আমাকে কাঁদিয়ে সে মারা গেল। ‘আ-য়া’র মৃত্যুতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
‘আ-য়া’র মতো আমার পোষা আরো দুটি কবুতরও ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সে কবুতর দুটোও মারা গিয়েছিল। আমার মা আমাকে অনেক বকা দিয়েছিলেন। কারণ আমি তাদেরকে জবাই করতে না দেয়ায় সেগুলো খাওয়া গেল না। শুধু শুধু কিছু টাকা নষ্ট হল।
আমার এরকম জেদের কারণে দুটো টার্কি মোরগও মারা গিয়েছিল। কেন যে এদের হঠাৎ করে অসুখ হয়, আর আমার মনে কষ্ট দিয়ে তারা মারা যায়, সে কারণটা আমি আজো বুঝতে পারলাম না।
আমার কষ্ট দেখে আমার পাপা আমার জন্য একটি মোরগ এবং দুটি মুরগী এনে দিলেন। মোরগটি দেখতে খুব সুন্দর। লাল, হলুদ, সোনালী, বাদামী, হালকা নীল, কালো ও সাদা রংয়ের অপূর্ব সমাহার মোরগটির পালকগুলোতে। দেশি মুরগীটির রং বাদামী ও হালকা নীল। পাকিস্তানী মুরগীটিকে এখনো বাচ্চাই বলা যায়। কালো ও গাঢ়ো হলুদ রংয়ের এ মুরগীটি বেশ ভীতু। সব সময় ভয় পায়। কিন্তু খুব দ্রুত আমার পোষ মেনেছে। তবে এটা আমাকে খুব বিরক্ত করে। হঠাৎ লাফ দিয়ে আমার মাথায় বা কাঁধে উঠে যায়। তখন আমার খুব খারাপ লাগে। শ্যাম্পু দিয়ে মাথা পরিস্কার করতে হয়।
বাদামী মুরগীটি দেরিতে হলেও আমার পোষ মেনেছে। তবে এ মুরগীটি খুব অলস। সে প্রায়ই ঘরে প্রবেশ করে একটি বাক্সের ভেতর বসে থাকতে চায়। মোরগটি খুব পাজী। তবে সেও খুব সামান্য পোষ মেনেছে। আমি হাতে খাবার দিলে সে খুব সতর্কতার সাথে আমার হাত থেকে খাবার খায়।
আমাদের ক্যাম্পাসে দুটো কুকুর আছে। আমি একদিন কুকুর দুটোকে খাবার দিয়েছিলাম। তখনো আমি স্কুলে ভর্তি হইনি। খাবার দেয়ার পর লক্ষ করলাম মেয়ে কুকুরটি আমার বাসায় চলে এসেছে। আমি তার নাম দিয়েছিলাম টমি। সে এখনো আমার বাসার সামনে এসে বসে থাকে। বাসা পাহারা দেয়। আমি খাবার ছুঁড়ে দিলে লাফ দিয়ে সে খাবার খায়। তবে আমার মা কুকুর পছন্দ করেন। তিনি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকেন, কখন না আবার কুকুর আমাকে কামড় দিয়ে বসে। কিন্তু পাঁচ বছর হতে চলল, এখনো কোন কুকুর আমাকে কামড়ায়নি। মায়ের ধমকের কারণে টমি সব সময় বাসায় আসতে পারে না। তবে এখন দেখছি মা বোধহয় টমিকে কিছুটা পছন্দ করতে শুরু করেছে।
আমি ক্লাস টুতে উঠার পর টমির সাথী পুরুষ কুকুরটাও একদিন বাসার সামনে চলে এল। কিন্তু তাকে আমার বেশ ভয় করত। কারণ কুকুরটি বেশ কয়েকটি ছাগলকে তাড়া করেছিল। কেউ কেউ বলে সে ছাগলগুলোকে কামড়ও দিয়েছিল। অবশ্য আমি কখনো তা দেখিনি। আমি তার নাম দিয়েছিলাম টম। সেও মাঝে মাঝে আসে। করোনার বন্ধের সময় টমও আমার পোষ মেনেছে। তবে কুকুর দুটো সকালে, দুপুরে, বিকেলে ও রাতে আমার বাসার সামনে চলে আসে। আমি খাবার দিলে খায়। আনন্দে লেজ নাড়ায়। আবার কোথায় কোথায় চলে যায়। কয়েকদিন ধরে টমিকে দেখছি না। পাপা বললেন, সে নাকি বাইরে কোথায় বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চারা বড় হলে তাদেরকে নিয়ে আসবে। তবে টম এখনো মাঝে মাঝে আসে।
আমার সবচেয়ে দুঃখ ও কষ্টের বিষয় হচ্ছে, আমি বিড়াল পছন্দ করলেও মা মোটেও বিড়াল পছন্দ করেন না। পাপা বললেন আমার ফুফুরাও নাকি বিড়াল পছন্দ করতেন না। তবে আমার যে দুই ফুফু বিড়াল পছন্দ করতেন না, তাদের জীবনে নাকি একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। পাপাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, একদিন ভোরে তিনি দেখলেন আমার দুই ফুফু তখনো ঘুম থেকে উঠেননি। তারা একই বিছানায় ঘুমাতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের মাঝখানে বিছানার মধ্যেই পোষা বিড়ালটি দুটি বাচ্চা দিয়েছে। পাপা তাদেরকে ডেকে তুলতেই ফুফু দুজন ঘুম থেকে উঠলেন। তারপর দৃশ্যটি দেখে ভয়ে আতংকে চিৎকার দিতে দিতে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর পাপা নাকি হাসতে হাসতে পেট ফুলিয়ে ফেলেছিলেন। অবশ্য ঘটনাটা শুনে আমারও প্রচণ্ড হাসি পেয়েছিল। পাপার কাছে প্রায়ই আমি বিড়ালের জন্য আব্দার করি। পাপা অবশ্য বলেছেন আমাকে একটি সুন্দর বিড়ালছানা এনে দেবেন। হালকা হলুদ ও সাদা রংয়ের সেই বিড়ালছানাটির একটি ছবিও দেখিয়েছেন। বিড়ালছানাটিকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমার মা প্রচণ্ড রেগে আছেন। তিনি হুমকি দিয়েছেন পাপা যদি বিড়ালছানাটিকে বাসায় নিয়ে আসেন, তাহলে নাকি বাসায় প্রচণ্ড যুদ্ধ লেগে যাবে। আমার খুব ভয় করছে। বিড়ালছানাটিকে বাসায় নিয়ে আসার ব্যাপারে কেউ কি আমাকে কোন বুদ্ধি দেবে?
আমার আরেকটি দুঃখের কথা বলি। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম রাস্তার যে সকল কুকুর ঘুরে বেড়ায়, তাদেরকে নাকি মেরে ফেলা হবে। পত্রিকায় দেখলাম এরকম দশ হাজার কুকুরকে নাকি মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। খবরটি পড়ে আমার খুবই খারাপ লাগছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দেবো। সে চিঠিতে আমি কুকুরগুলোকে না মারার জন্য আবেদন জানাবো। আমি আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার চিঠিটি পড়ে কুকুরগুলোকে না মারার জন্য নির্দেশ দেবেন। আমার অনুরোধ কেউ যেন কুকুরসহ কোন প্রাণীকে হত্যা না করেন। আমি জানি কুকুর আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু। কুকুর নিজে মরে গেলেও তার মনিবকে রক্ষা করে। এরকম অনেক গল্প নিশ্চয়ই তোমরা পড়েছো। অবশ্য দুষ্টু ও পাগলা কুকুরকে মেরে ফেললে কারো মনে কোন কষ্ট হবে না। কিন্তু নিরীহ প্রাণীকে মারলে সবার মনেই কষ্ট হবে। আমরা প্রাণীদেরকে ভালবাসব। তাদেরকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার দেবো।
[সায়েকা আহমদ, ৪র্থ শ্রেণি, বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।]
মন্তব্য করুন